ঢাকা, শুক্রবার, ২৪ শ্রাবণ ১৪৩২, ০৮ আগস্ট ২০২৫, ১৩ সফর ১৪৪৭

মুক্তমত

বসুন্ধরা কিংসের খেলোয়াড় তৈরির কারখানা

ইকরামউজ্জমান, সৌজন্যে: বাংলাদেশ প্রতিদিন  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০:৪২, আগস্ট ৮, ২০২৫
বসুন্ধরা কিংসের খেলোয়াড় তৈরির কারখানা ইকরামউজ্জমান

খেলোয়াড় জন্মায় না, সৃষ্টি করতে হয়। মেধা ও প্রতিভা থাকলেই হবে না, এটি বিকশিত করতে না পারলে তো সবকিছু অর্থহীন।

জনমিতিক লভ্যাংশ (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) অধরাই থেকে যাবে। সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে বিশ্বজুড়ে ক্রীড়াঙ্গনে চিন্তাশীল প্রক্রিয়া।

আর এই প্রক্রিয়ায় কার্যক্রম শুরু হয় একদম ‘এন্ট্রি লেভেল’ থেকে। যে দেশগুলো খেলাধুলায় এগিয়ে চলেছে, এগিয়ে আসার সর্বাত্মক চেষ্টা করছে, তাদের সংস্কৃতিতে ‘ক্যাচ দেম ইয়ং’ স্লোগানটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের অধিকারী। বর্তমান ও ভবিষ্যতের ক্রীড়াঙ্গনের গতিপথ নির্মাণের মৌলিক উপাদান তো এখান থেকেই জোগান দেওয়া হয়। হঠাৎ করে জোড়াতালি দিয়ে ভবিষ্যতের পথ তৈরি করা যায় না।

ক্রীড়াঙ্গনে বড় সত্যি হলো এন্ট্রি লেভেল থেকে স্বপ্নের পথ ধরে হাঁটা শুরু। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখানেই লুকিয়ে আছে আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং স্বপ্ন। ছোট ছোট ছেলে ও মেয়ে স্বতঃস্ফূর্ত এবং আনন্দের সঙ্গে ফুটবল খেলার জন্য এগিয়ে আসছে, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ক্রীড়াঙ্গনে আধুনিক বিজ্ঞানের চর্চার এখন জয়জয়কার।

বিজ্ঞান ছাড়া ক্রীড়াঙ্গন ভাবা যায় না। দেহ ও মনোবিজ্ঞানের সমন্বয়ে খেলার চর্চা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, এটি কারো পক্ষে বলা সম্ভব নয়। ক্লাবের ফুটবল একাডেমিতে প্রবল উৎসাহ নিয়ে সম্পৃক্ত হচ্ছে শিশু, কিশোর ও তরুণ। একাডেমির পাকা জহুরিরা তাদের ঘষে-মেজে ছাঁচমাফিক তৈরি করে দিচ্ছেন।

দেশে দেশে ক্লাবগুলো খেলোয়াড় সৃষ্টি করে থাকে তাদের একাডেমি ও সুস্থ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।

ক্লাবের আবাসিক ও অনাবাসিক একাডেমি হলো খেলোয়াড় তৈরির আসল কারখানা। ক্লাব তার একাডেমির মাধ্যমে নিজস্ব চাহিদা পূরণের পাশাপাশি তৈরি করা খেলোয়াড়দের অন্যদের কাছে নিয়মিতভাবে বিক্রি করে। এটি একটি বহুল স্বীকৃত রমরমা ব্যবসা। এই সংস্কৃতিতে আমাদের দেশের ফুটবল ইন্ডাস্ট্রি অনেক পিছিয়ে আছে। তবে আশার কথা, ফুটবল ক্লাবের একাডেমির প্রয়োজনীয়তা এবং গুরুত্ব নিয়ে সচেতনতা বাড়ছে। ফুটবলে পেশাদারির কোনো বিকল্প নেই। ফুটবল তো শুধু খেলা নয়, শিল্পের চর্চাও বটে।

স্বাধীনতার পর গত পাঁচ দশকের বেশি সময়ে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ফুটবল চত্বরে দুটি ক্লাবের আগমন ও ভূমিকা স্মরণীয় এবং উল্লেখ করার মতো। একটি হলো আবাহনী ক্রীড়া চক্র, বর্তমানে ঢাকা আবাহনী লিমিটেড হিসেবে পরিচিত এবং অন্যটি হলো খেলোয়াড় ও ক্রীড়াপিপাসু পরিবারের মালিকানাধীন দেশের বৃহৎ করপোরেট গ্রুপ বসুন্ধরার ‘বসুন্ধরা কিংস’। দুটি ক্লাবের শুরু এলাকার ক্লাব হিসেবে হলেও জাতীয় ক্লাবের পরিচিতি পেতে সময় লাগেনি। ক্লাব দুটির পরিচিতি শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও আছে। তবে ফুটবলের জন্য আধুনিক কাঠামো নির্মাণ, আদর্শ পরিবেশ সৃষ্টি এবং পেশাদার ক্লাব হিসেবে বসুন্ধরা কিংস ঢাকা আবাহনী লিমিটেডের চেয়ে অনুপাতে অনেক ওপরে। বসুন্ধরা গ্রুপ সময়কে পড়তে পেরেছে বলেই এগিয়ে চলেছে।

বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ‘এন’ ব্লকে আধুনিক মাল্টিস্পোর্টস কমপ্লেক্সে বসুন্ধরা কিংসের নিজস্ব আধুনিক অ্যারেনা নির্মাণের পাশাপাশি (অ্যারেনাটি ফিফা ও এএফসি কর্তৃক স্বীকৃত) কয়েকটি উন্নতমানের প্র্যাকটিস গ্রাউন্ড নির্মাণ করা হয়েছে, যেটি দক্ষিণ এশিয়ায় আর কোনো প্রাইভেট ক্লাব এখন পর্যন্ত করেনি। বসুন্ধরা গ্রুপ প্রথম থেকেই চেয়েছে দেশের ফুটবলের মানোন্নয়নের পাশাপাশি খেলার সংস্কৃতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন সাধন করতে! গ্রুপের চেয়ারম্যান ক্রীড়ানুরাগী আহমেদ আকবর সোবহান প্রথম থেকেই চেয়েছেন শুধু গ্রুপের নিজস্ব ক্লাব বসুন্ধরা কিংস নয়, ফুটবলসংশ্লিষ্ট সব ক্লাব ও অংশীদারকে সম্পৃক্ত করে হারিয়ে যাওয়া ফুটবলের গৌরব পুনরুদ্ধার করতে এবং মানুষকে আবার ফুটবল মাঠের প্রতি আকৃষ্ট করতে।

বসুন্ধরা কিংসের প্রেসিডেন্ট মো. ইমরুল হাসান জানিয়েছেন, ‘আমরা কখনো চেয়ারম্যান স্যারের নীতি, দর্শন এবং স্বপ্নের বাইরে যাইনি। বিভিন্ন সময়ে প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছে, আর এটাই জীবন, সবকিছু মোকাবেলাও করা হয়েছে পেশাদার মনোভাব নিয়ে। আমরা বিশ্বাস করি, একতাবদ্ধ শক্তি কখনো পরাজিত হয় না। আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবই। ’

২০২২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনার উদ্বোধন করেন গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান। সেদিন তিনি বলেন, ‘আমাদের স্বপ্ন হলো ক্লাবের বড় একটি আবাসিক একাডেমি, যেখানে এক হাজার ছেলে থেকে ফুটবল খেলা শিখবে। ’ একাডেমি বিল্ডিংয়ের কাজ শেষ হওয়ার আগে ছোট পরিসরে অনাবাসিক একাডেমি শুরু হয়ে যাবে। সেদিন তিনি আরো বলেছেন, দেশের বাইরে থেকে বেশ কয়েকটি ক্লাব একাডেমিতে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছে।

২০২৪ সালের ৫ অক্টোবর তিন গ্রুপে ছয় থেকে ১০, ১১ থেকে ১৪ এবং ১৫ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত ১৮০ জন ছেলে নিয়ে অনাবাসিক ফুটবল একাডেমির উদ্বোধন করেন বসুন্ধরা কিংসের প্রেসিডেন্ট মো. ইমরুল হাসান। এর মধ্যে একটি মেয়েও প্রবল উৎসাহ নিয়ে ফুটবল খেলা শিখতে এসেছিল। সে এখনো ফুটবলে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। খেলে কম বয়সের ছেলেদের সঙ্গে। ১৮০ জন নিয়ে একাডেমির যাত্রা হলেও ভালো কোচের অধীনে ফুটবল রপ্ত করে ভালো ফুটবল খেলার জন্য ৪৩০ জনের বেশি ছাত্র একাডেমিতে একসময় ভর্তি হয়েছিল। বর্তমানে প্রায় ৩০০ বিভিন্ন বয়সের ছেলে তিন গ্রুপে সপ্তাহে পাঁচ দিন ট্রেনিং করে পাঁচটি মাঠে। মজার বিষয় হলো, যখন ছেলেরা বিশেষ করে ছুটির দিন ট্রেনিং করতে আসে, তাদের অভিভাবক যাঁরা সঙ্গে আসেন, তাঁদের অনেকেই পাশের খালি মাঠে মজা করে ফুটবল খেলেন। এই আনন্দটা সত্যি অন্য রকম।

অনাবাসিক একাডেমির পূর্ণাঙ্গ দায়িত্বে আছেন ক্লাবের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর বায়েজিদ আলম জুবায়ের নিপু। ফুটবলের এই বিশেষজ্ঞ বাফুফের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর ছাড়া বাফুফের ফুটবল একাডেমির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বসুন্ধরা কিংসের সঙ্গে প্রথম থেকেই জড়িত। তাঁর ডিজাইন করা প্রশিক্ষণ কর্মসূচি (প্র্যাকটিক্যাল এবং থিওরি ক্লাস) বাস্তবায়িত করার দায়িত্বে আছেন বেশ কয়েকজন অভিজ্ঞ এএফসি লাইসেন্সধারী এবং এএফসি ডিপ্লোমা হোল্ডার কোচ। এ ছাড়া আছেন ফিজিওথেরাপিস্ট, চিকিৎসক এবং অন্যরা। কোচরা হলেন মো. মাহবুব হোসেন রক্সি, এ কে এম নুরুজ্জামান, সৈয়দ গোলাম জিলানী, সেলিম মিয়া, তৌফিকুল ইসলাম পলাশ প্রমুখ।

ভবিষ্যতে ভালো খেলোয়াড় হতে চায়, বসুন্ধরা কিংসের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে চায়, চায় জাতীয় দলের হয়ে খেলতে—এই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্য নিয়ে ঢাকা ছাড়াও ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, শরীয়তপুর, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা ছেলেরা একাডেমিতে নিয়মিতভাবে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। ২০ থেকে ২৫ জন ছেলে তো কিংস অ্যারেনার পেছনে ‘ডুমনীতে’ থেকে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। সবাই যে ছাত্র তা কিন্তু নয়, কয়েকজন শ্রমজীবীও আছে। সবার স্বপ্ন ভালো কারখানায় ফুটবল খেলা শিখে একটি সময় নিজকে তুলে ধরা। ১৪ থেকে ১৮ বছরের গ্রুপে ১০০ জনের বেশি ছেলে আছে। কোচরা মনে করছেন, তাদের কারো কারো ক্লাবের অনূর্ধ্ব-১৮ দলে খেলার মতো যোগ্যতা অর্জন করতে খুব একটা সময় লাগবে না। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো ফুটবলের প্রতি অনুরাগ ও মনঃসংযোগ।

বসুন্ধরা কিংসের খেলোয়াড় তৈরির কারখানায় বর্তমানে জিমের ফ্যাসিলিটিসহ যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা আছে, এটি তো দেশের দুই শর বেশি অনাবাসিক ফুটবল একাডেমির আর কোথাও নেই। কোথাও নেই এত টেকনিক্যাল পারসন। কোথাও নেই শতভাগ ‘সিস্টেমেটিক’ ভাবে প্রশিক্ষণকার্য পরিচালনা। আর এ ক্ষেত্রে জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্ব রয়েছে পেশাদারির। একাডেমির জন্য বিল্ডিংয়ের নির্মাণকাজ শেষ হলে যখন আবাসিক একাডেমি কাজ করতে শুরু করবে, তখন দেশি-বিদেশি আরো ফুটবল বিশেষজ্ঞদের একাডেমির সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হবে। লক্ষ্য একটিই, দেশের ফুটবলের মানোন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রাখা। দেশের ফুটবলের প্রেক্ষাপট এবং চিন্তা-ভাবনায় পরিবর্তন সাধন করা।

লেখক: কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া    

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।