ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

ধ্বংসস্তূপের নিচে বাংলাদেশ

সাইফুলাহ মাহমুদ দুলাল, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭, ২০১৩
ধ্বংসস্তূপের নিচে বাংলাদেশ

সাভারের মর্মস্পর্শী দুর্ঘটনা আমাকে মানসিকভাবে প্যারালাইসিস বানিয়ে দিয়েছে। আজ দু’দিন ধরে আমি অসহায় হয়ে বাসায় বসে আছি।

টিভিতে নিউজ দেখে, ফেসবুকে ছবি দেখে চোখের জল থামিয়ে রাখতে পারিনি, নিজের অজান্তেই কেঁদেছি।

আশুলিয়ার তাজরীন গার্মেন্টের শ্রমিকদের আগুনের পোড়া গন্ধ না শুকাতেই আবার মৃত্যুর মিছিলে ভারী হয়ে উঠেছে সাভারের রানা প্লাজা। প্লাজার নিচে আটকে পড়া মানুষগুলো কিভাবে লাশ হয়ে যাচ্ছে, ধসে পড়া দেয়ালে চাপা পড়ে আছে মেহেদি মাখা হাত কিংবা একটি পা। কেউবা বেঁচে থাকার শেষ আকুতি জানিয়ে বলছে, হাত-পা কেটে হলেও আমাকে বাঁচাও। কেউ হাত-পা নাড়িয়ে বলছে, আমি বেঁচে আছি, আমি মরি নাই। আমাকে বাঁচাও।

এভাবেই নিষ্ঠুর মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে আমার সেলাই দিদিমণিরা। আবার কেউ লাশ হয়ে ঘুমিয়ে গেছে এরইমধ্যে। কংক্রিটে ঝুলে আছে দেহ। ধ্বংসস্তূপে জড়াজড়ি করে মরে আছে আমার ভাইবোন। অবর্ণনীয় এসব ভায়াবহ দৃশ্য দেখে আমি কী লিখবো? লেখার ভাষা চাপা পড়ে আছে ওই রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপে। ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে একটি প্রতিবাদী পা আমাকে বারবার প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিচ্ছে।

“এক পায়ে তার এই নূপুরটি আর কোনোদিন বাজবে না।
আমার বোন আর আলতা ফিতা চুড়ি পরে সাজবে না...
ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া পায়ের ছবি, পায়ের প্রতিবাদ...
এ ট্র্যাজেডির নেই ভাষা নেই, জমাট ব্যথায় পাষাণ বুকটি বাঁধ।
কাঁদ বাঙালি কাঁদ। আমার বোনের ক্ষোভ-ঘৃণা-শোক, পায়ের প্রতিবাদ”...

মনে হচ্ছে সেই পায়ের মতো সমগ্র বাংলাদেশটাই চাপা পড়ে আছে ধ্বংসস্তূপের নিচে। মনে হচ্ছে আমার নিজের একটি পা কিংবা একটি হাত রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপে আটকে আছে। আমিই যেন চিৎকার করে বলছি— আমি বাঁচতে চাই। আমাকে উদ্ধার করুন, আমাকে বাঁচান।

শুনলাম তদন্ত কমিটি হয়েছে, জাতীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। এ ধরনের ট্র্যাজিডি আগেও বহুবার হয়েছে কিন্তু কোনো শাস্তির নজির নেই। অকার্যকর তদন্ত কমিটি আর জাতীয় শোক দিয়ে কী হবে, কী হয়েছে কবে?

এই যে হাতির ঝিলের বিষফোঁড়া নামক ক্যান্সার বিজিএমইএ ভবন তো ৯০ দিনের মধ্যে ভেঙে ফেলতে সরকারের প্রতি হাইকোর্টের নিদের্শ জারি করেছে, তাতে কার কী? নির্লজ্জের মতো বিজিএমইএ ভবন দাঁত কেলিয়ে আমাদেরকে উপহাস করে যাচ্ছে।

বাকরুদ্ধ জাতি যখন ক্ষোভে স্তব্ধ, শোকে নিমজ্জিত; তখন হেফাজতে ইসলামও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বলেছে, “সাভারের ঘটনা আল্লাহর গজব। ” অথচ শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ তখন রক্ত ভিক্ষা করছে। বিরোধীদল তুলে নিয়েছে তাদের হরতাল। সাংবাদিকেরাও সংবাদ সংগ্রহ বাদ দিয়ে স্বেচ্ছাসেবীদের সাথে মিশে গেছে উদ্ধার কাজে। মানুষ মানুষের জন্য, সেই প্রমাণ করলেন বাবু। বাবু— জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একাই উদ্ধার করেছে ৩০/৩৫ জন চাপা পড়া শ্রমিক!!

আর আমরা যারা সাভারে যেতে পারিনি, অস্থির হয়ে উঠেছি। বন্ধু রিটন ফোন করেই প্রথমে শর্ত দিলেন যেন সাভারের ঘটনা নিয়ে কিছু না বলি। কারণ, সহ্য করা যাচ্ছে না। ঢাকার বন্ধু রুমা বাকরুদ্ধ হয়ে সারারাত নির্ঘুম! তরুণ কবিবন্ধু জুয়েল নিজের হাত কামড়াচ্ছে, আর পৃথিবীর নিষ্ঠুরতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে একের পর এক স্ট্যাটাস দিচ্ছে:


ক] “গরীবের জীবন। গরীবের মৃত্যু। গরীবের লাশ। গরীবের কবর। গরীবরা না নারী না পুরুষ। গরীবরা মানুষ না। গরীবরা কুকুরও না। গরীবরা পাঁচ বছর পরপর ভোটার। গরীবদের হাসি কত গরীব। গরীবের কান্না বুড়ি গঙ্গার পানি। গরীবের কখনো ক্ষুধা লাগেনা। গরীবরা কত বেকুব কখনো আগুনে পুড়ে, কখনো চাপা পড়ে মরে। মরতে মরতে ওরা এমন ভাবে মরে যে আমাদের একবেলা খারাপ লাগে।

খ] মনে হয় নিজের কলিজাটা টাইনা বাইর করি। কোনো জঙ্গলে কোনো প্রাণিরও কি এমন করুণ মৃত্যু কেউ কোন দিন দেখেছে? এ দুনিয়ায় এত বাতাস একটু অক্সিজেন নাই ওদের জন্য। বেঁচে থেকেও বাঁচতে পারলো না এতগুলো বাঁচার আকুতি। ... এ আহাজারি, এ জীবনের শেষ উচ্চারণ ধারণ করার শক্তি নাই রে মা...

গ] বুক ফুফরে উঠছে। অনেক মা বোন ভাইরা চাপা পড়ে আছে। চোখের সামনে ওদের বাঁচার আকুতি। যার পা চাপা পড়েছে, সে পা কেটে বেরুতে চায়। যার হাত চাপা পড়েছে সে হাত কেটে বেরুতে চায়। এক মা তার সন্তান প্রসব কেরেছ ধ্বংসস্তূপের ভেতর। আমরা এত নিরুপায় তাদের বের করে আনতে পারছি না। এই রাষ্ট্র কী জবাব দেবে? এ জবাব কে দেবে?”


একটি নয়, দু’টি নয়; তিন শতাধিক লাশ আর হাজার হাজার আহত মানুষকে উদ্ধার করে আনা হচ্ছে। এখনো ক্রলিং, হাইড্রলিক কাটার দিয়ে ভবন ছিদ্র করে হাতপা কেটে বের করা হচ্ছে। বাইরে অপেক্ষা করছে স্বজনহারা মানুষের দল। তাদের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠছে বাতাস।

চিৎকার করে এক জমজ বোন বিলাপ করছে— “আমরা জোড়া। জমজ বোন, আমি বেজোড় হতে চাই না। আমার বোনের নাম নার্গিস বেগম। সে এই ভবনের সপ্তম তলায় কাজ করতো। ..আমরা সারাজীবন একসঙ্গে থেকেছি। আজ আমার বোন আমারে রেখে কই গেল। আল্লাগো আমার বোনরে ফেরত দেও। আমি বেজোড় হতে চাই না। ”

এই স্বজনহারা বোনের সাথে আমিও আর্তনাদ করে বলতে চাই— আমরা আমাদের সেলাই দিদিমণিকে আর হারাতে চাই না। দেখতে চাই না— ধ্বংসস্তূপের নিচে বাংলাদেশ চিৎকার করছে।
* সাইফুলাহ মাহমুদ দুলাল, কানাডা প্রবাসী কবি-সাংবাদিক
saifullahdulal@gmail.com

বাংলাদেশ সময়: ১২২৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭, ২০১৩
সম্পাদনা: তানিম কবির, নিউজরুম এডিটর; নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।