ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

ভিয়েতকংদের কোচি টানেল, গেরিলা যুদ্ধে অবিস্মরণীয় চিহ্ন

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৩২ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১৩
ভিয়েতকংদের কোচি টানেল, গেরিলা যুদ্ধে অবিস্মরণীয় চিহ্ন

কোচি টানেলের কথা শুনেছিলাম ভিয়েতনামে নেমেই। গেরিলা যুদ্ধের অভিনবত্ব দেখাতে গাইড কেলভিন আমাদেরও নিয়ে গিয়েছিলেন সেই সুড়ঙ্গপথে।

তার আগে গিয়েছিলাম মার্কিনীদের সঙ্গে যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জাম আর হাজারো ছবি নিয়ে যুদ্ধ স্মৃতি জাদুঘরে।

কো-চি ট্যানেলের উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রা শুরুতেই কিছুটা বিলম্ব হয়েছিল সফরসঙ্গীদের আলস্যে। কথা ছিল ট্যানেল দেখার পর ওখানেই দুপুরের খাবার। কিন্তু নির্ধারিত  সময়ে শুরু করতে না পারায় কো চি পৌঁছুতেই দুপুর হয়ে গেল। তার আগে গিয়েছিলাম যুদ্ধ জাদুঘরে যার আনুষ্ঠানিক নাম ‘এক্সিভিশন হাউস ফর ক্রাইম অব ওয়ার অ্যান্ড এগ্রিশন’। শহরের মাঝখানে অবস্থিত এই ওয়ার মিউজিয়ামটি করা হয়েছে এমন জায়গায় যেটি আগে ছিল ‘মার্কিন তথ্য কেন্দ্র’।

১৮৭৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর প্রথমে ‘এক্সিভিশন হাউস ফর ইউএস অ্যান্ড পাপেট ক্রাইমস’ নামে এবং পরে ১৯৯০ সালে নাম পরিবর্তন করা হয়।   চারতলা তথ্য কেন্দ্রের তিনটি ফ্লোরেই রাখা হয়েছে যুদ্ধে ব্যবহৃত নানা ধরনের ছোট ছোট অস্ত্র। গ্যালারিতে অসংখ্য ফটোগ্রাফি, যা দেখে বোঝা যায় আমেরিকানরা কতটা নিমর্ম ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধে। অবশ্য যুদ্ধে তো আর ভালোবাসা দেখানোর কোনো সুযোগ নাই। হো-চি-মিন সিটি থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে কো-চি পৌছুতেই দুপুর হয়ে গেলো। তাই গেরিলাদের সুড়ঙ্গে ঢোকার আগেই মধ্যহ্ন ভোজ।
       
আমেরিকা ও ফরাসীদের সঙ্গে দীর্ঘদিন যুদ্ধ করলেও পশ্চিমাদের মতো ভিয়েতনামবাসীও সন্ধ্যার মধ্যেই নৈশভোজ শেষ করে। তাই দুপুর একটা বাজতেই খাবারের তাড়া গাইড কেলভিনের। একটি ছোটো নদী, যাকে দেশীয় ভাষায় খাল বলাই ভালো, সেই খাল পাড়ের উন্মুক্ত রেস্তোরাঁয় খাবারের বিশাল আয়োজন। এপাড়ে গাড়ি রেখে কাঠের সাঁকো পার হতে হয় রেস্তোরাঁয় যাবার জন্য।

চারদিক খোলা বড় এক  মিলনায়তনে এক সঙ্গে অনেক মানুষের খাবারের ব্যবস্থার পাশাপাশি পানির ওপর  ছোট ছোট কয়েকটি  খোলা কটেজও আছে এখানে। একটি টেবিলে ১০-১২ জন বসতে পারে। যথারীতি স্যুপ , ঘাস-লতা-পাতা সেদ্ধ এবং মাছ ও মুরগী দিয়ে ভিয়েতনামের ট্র্যাডিশনাল খাবার। চারিদিকে সবুজ বনানী, তবু কোথাও এক ফোটা নোংরা নেই। নয় জনের খাবার হিসেবে যা পরিবেশন করা হলো তা দিয়ে কমপক্ষে ১৮ জন খেতে পারবে। তবে কম  মশলা আর বেশী ঝাল-ভাজা না থাকায় প্রায় পুরো খাবারই সাবাড় করে দিল নয়জন বঙ্গসন্তান। বেশী খেলেও হাসফাস নেই, তাই সমানে হাত চললো সবার। সঙ্গে চিলড লোকাল বাবাবা বেয়ার।
IMG
পেট পুরে খাওয়া শেষ করার পর গাইড কেলভিনের ঘোষণায় একটু বিব্রত হবার উপক্রম। কারণ সে জানালো  কোচি টানেলের আয়তন সব মিলে দু’শ’ কিলোমিটার। কিছুটা কৌতুহল নিয়ে টানেলের দ্বার প্রান্তে পৌঁছে নিশ্চিত হলাম, দেখানো হবে বিশাল টানেলের অংশ বিশেষ। মার্কিন বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধের সময় ভিয়েতনামী গেরিলারা  দুর্গ হিসেবে ব্যবহার করেছে নিজেদের প্রযুক্তিতে তৈরি এই সুড়ঙ্গকে।   ভিয়েতনামের গেরিলা, যাদের আনুষ্ঠানিক নাম ছিল ভিয়েতকং, তারা নিজেদের হাতে বানানো  অস্ত্র দিয়ে লড়েছে মার্কিন সামরিক বাহিনীর অত্যাধুনিক সব মরণাস্ত্রের বিরুদ্ধে।

যুদ্ধ জয়ের স্মৃতি বিজড়িত সুড়ঙ্গ এখন অন্যতম ট্যুরিস্ট স্পট। ঢুকতে হলো টিকেট কেটেই।   শুরুতেই নিম্নমুখী সুড়ঙ্গ পথ। কিন্তু একটু পরেই ভুল ভাঙ্গলো। কারণ মাত্র দু’শ’ মিটার পরেই আবার হাজির হলাম মাটির ওপরেই।   এরপর বসানো হলো প্রজেক্টার আর টিভি স্ক্রিনের সামনে। মাল্টিমিডিয়ায় ব্রিফিং দিচ্ছিল এক তরুণ। পরে দেখলাম সেও একজন গাইড, যে বেশ কয়েকজন আমেরিকান ট্যরিস্টকে নিয়ে ঘুরছে কো-চি টানেলে, যেখানে গেরিলাদেও কাছে চরমভাবে পর্যুদস্ত হয়েছিল মাকির্ন সেনারা।

জানা গেলো, এই টানেল শুধু চলাচলের পথ নয়, বরং এটি ছিল একটি পূর্নাঙ্গ গেরিলা সেনানিবাস। তিন স্তরের ট্যানেলের ছবিসহ বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে জানানো হলো ট্যানেলটির খনন প্রক্রিয়া এবং  ব্যবহার পদ্ধতি । এজন্য সেনানিবাস বললাম, কারণ এখানে যেমন ছিল  অস্ত্রাগার, তেমনি ছিল  হাসপাতাল ।   নারী ও শিশুদের জন্য আলাদা জায়গা ছিল টানেলে। বিমান থেকে বোম ফেললে তা থেকে গেরিলাদের রক্ষা করা এবং টানেলের ভেতরে রান্না করলে তা ধোঁয়া দেখেও যেন গেরিলাদেও অবস্থান জানা না যায়, তারও বিশেষ ব্যবস্থা দেখে অবাক না হয়ে উপায় নাই।

১৯৬০ সালের পর এই টানেল তৈরির কাজ শুরু হয় এবং ভিয়েত-কং বাহিনী ট্যানেলটিতে  অবস্থান করে ১৯৭৫ সালে ভিয়েতনাম প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত। ১৯৬৬ সালের ৭ জানুয়ারি মার্কিন বাহিনী প্রথমবারের মতো ট্যানেলে কম্বাইন্ড অপারেশন চালায়। সুড়ঙ্গ ধ্বংস করতে  ৩০ টন বোমা ফেলে মার্কিন এয়ারফোর্স, তাদের সঙ্গে যৌথভাবে এই অভিযানে অংশ নেয় অস্ট্রেলিয়ান সেনারাও। তবে চার দিন একটানা  অপারেশন চালিয়েও গেরিলাদের ধ্বংস করতে সফল হয়নি বিশ্বের দুই আধুনিক সামরিক বাহিনীর সেনারা। পরপর আরো কয়েকটি অভিযান ব্যর্থ হয় গেরিলাদের দক্ষতায়।
 
আমরাও দেখলাম কয়েকটি মরন ফাঁদ, যেগুলোর কারণে বারবার পরাস্ত হয় মাকির্নিরা। যেমন ঘাস দিয়ে ঢাকা গালিচার মত জায়গায় পা দিতেই তা উল্টে যেত, আর মার্কিন সেনারা পড়তো মাটিতে পুঁতে রাখা সূচাগ্র শাবলে। একজন হাল্কা পাতলা চিকন গেরিলা ঢুকতে পারে এমন চৌকোনা গর্তে ওঁত পেতে বসে থাকতো ভিয়েতনামি গেরিলারা, যেগুলোতে মোটা শরীর নিয়ে ঢুকতেই পারতো না আমেরিকানরা। এমন একটি সুড়ঙ্গে নামার পর মনে হলো মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা তো কত কৌশলেই না পরাজিত করেছিল পাকবাহিনীকে। কিন্তু হায় তেমন কিছুই সংরক্ষণ করা হয়নি।

কো-চি ট্যানেলে অবস্থান নিয়েই ভিয়েত-কং বাহিনী তখনকার দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী সায়গনের (বর্তমান হো-চি-মিন সিটি) পতন ঘটায়। ৩৫ বছর আগের স্মৃতিচিহ্নকে আধুনিকভাবে সংরক্ষন করে দেখাচ্ছে ভিয়েতনামিরা। এমনকি মার্কিন বোমারু বিমান থেকে নিক্ষেপ করা বোমায় যে পুকুরের মত গর্ত হয়েছিল, সেটিকেও রাখা হয়েছে কোনো রকম পরিবর্তন না ঘাটিয়েই।
IMG 
আমাদেরকে দেখানো হলো এমন একটি স্যান্ডেল যা আমেরিকান সেনাবাহিনীর পরিত্যক্ত গাড়ির টায়ার কেটে তৈরি করা হয়েছে। গাইড কেলভিন একজোড়া স্যান্ডেল সু এগিয়ে দিয়ে পরীক্ষা দিলেন কিভাবে সেটা পায়ে দিতে হয় তা দেখানোর জন্য। আমি সফল হলাম কিন্তু পরীক্ষায় পাশ করলাম না। কারণ কেলভিন দেখালো আসলে সামনের দিকটি পেছনে দিয়ে একরকম উল্টো করে এই স্যান্ডেল পরতো ভিয়েতকংরা। ফলে কাদামাটির মধ্যে তারা যেদিকে হেঁটে যেত, মার্কিন সেনারা পায়ের ছাপ দেখে বুঝতো উল্টোদিকে গেছে গেরিলারা। ফলে ভুলপথে গিয়ে তারা গেরিলা এম্বুশের মুখে পড়ে জীবন দিত সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে যুদ্ধ করতে এসে।

ব্রিফিংয়ে জেনেছিলাম মূল ট্যানেলটি প্রায় আড়াইশ’ কিলোমিটার হলেও এরই মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে একটি অংশ। এখনও রয়ে গেছে প্রায় দেড় শ’ কিলোমিটারের মতো। এসব ট্যানেলে কোথাও কোথাও নেমে দেখতে পারেন ট্যুরিস্টরা, তবে সঙ্গে নিতে হবে টর্চলাইট।   আমরা যতক্ষণ ছিলাম টানেল এলাকায়, ততক্ষণই বোমা বিস্ফোরণ আর গোলাগুলির আওয়াজ শুনেছি, যা তৈরি হয়েছে আধুনিক সাউন্ড সিস্টেমের মাধ্যমে। আমার মনে হলো প্রতিবছর যারা জিপিএ-৫ পান এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষায় তাদের মধ্য থেকে যদি ঘুরিয়ে আনা যায় যুদ্ধের এমন একটি জীবন্ত স্মৃতি থেকে, তাহলে তারা হয়তো বুঝতে পারবে আমাদেও মুক্তিযোদ্ধারা কতটা কষ্ট করে দেশ মাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করেছে।

আমাদের টানেল পরিদর্শন শেষ হলো এক রকম গাছের পাতার চা খেয়ে। সঙ্গে গাছের গাছের মূল জাতীয় খাবার যা অনেকটাই আমাদের মিষ্টি আলুর মতো। জানানো হলো এই খাবারই বেশী সময় খেতো ভিয়েতনামী গেরিলারা । কারণ এই মূল শক্তি যোগাতো, কিন্তু রান্নার ঝামেলা করতে হতো না। চিকন সুড়ঙ্গের কথা বলেছি আগে, চায়ের কাপও দেখলাম ক্ষুদ্র আকারের। কম খেয়ে সুস্থ থেকে মোটাতাজা মার্কিন সেনাদের সঙ্গে ভিয়েতনামী কমিউনিস্টদের যুদ্ধ জয়ের প্রধান মন্ত্র ছিল দেশপ্রেম আর ঐক্যের দৃঢ়তা। সেই মনোবল নিয়ে এখন ভিয়েতনামিরা ব্রতী হয়েছে অর্থনৈতিক যুদ্ধে। বাৎসরিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অজর্ন করতেও সক্ষম হয়েছে তারা। হায় আমরা কি করবো? সম্ভাবনা তো আমাদেরও আছে, আছে মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাঁথাও।

বাংলাদেশ সময়: ০৩২৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১৩
জেডএম/জিসিপি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।