ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

আগুন আর মৃত্যু থেকে বাঁচতে চায় মানুষ

ফারুক যোশী, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১২৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৮, ২০১৩
আগুন আর মৃত্যু থেকে বাঁচতে চায় মানুষ

প্রতি মুহূর্তেই যেন খবর একটাই আবার কে পুড়লো। পুড়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো কোন হতভাগা।

এ এক বীভৎসতা। এই বীভৎস মৃত্যুর দায় কার?  আওয়ামী  লীগ বলবে, এ দায় বিএনপির, এ দায় জামায়াতিদের। আপাতদৃষ্টে তা-ই ধরে নেবো আমরা। কারণ লাদেন-স্টাইলে গুহার অভ্যন্তর থেকে ভিডিওবার্তায় অবরোধের ঘোষণা দিয়ে সারাদেশ উত্তপ্ত করে প্রাসাদের নিরাপদ অন্তরালে বসে থাকলে একে আর যা-ই হোক, আন্দোলন বলা যায় না।

 অবরোধ দিয়ে কি বোঝানো হয়?  অবরোধ মানেই কি পেট্রোলবোমা মেরে বাস পুড়িয়ে দেয়া কিংবা পুড়িয়ে মারা একজন মানুষকে? প্রতিদিন অবরোধের সময়সীমা বাড়ছে,  আর পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পেট্রোলবোমার সংখ্যা,  মানুষের মৃত্যু। অক্টোবরের ২৬ তারিখে থেকে এখন পর্যন্ত শিশু-মহিলাসহ অর্ধশতাধিক মানুষ মরেছে; পুড়েছে শতাধিক। এবং তা বাড়ছেই।

অবরোধের শিকার হচ্ছে কারা? নিরীহ মানুষ। অবরোধ যদি আন্দোলনের অংশ হয়, তাহলে মানুষ হত্যা করাও কি আন্দোলনের অংশ?  অবরোধ হতেই পারে,  আন্দোলনের অংশ হিসেবে অবরোধ নতুন কোনো ইস্যু নয়। যুগ যুগ ধরে এ রকমের আন্দোলন দেখেছে বাংলাদেশ। অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। যুদ্ধ বাঁধিয়েছিলো পাকিস্তানিরা । শুরুটা করেছিল তারাই, আমরা নই। সেভাবেই এখন যা হচ্ছে, যেন এক অঘোষিত যুদ্ধ। সাধারণ মানুষকে হত্যা করা, যেমন করেছে পাকিস্তানি হানাদাররা। ক্রোধ আর হিংসার রাজনীতিতে আমরা হয়ত তর্কের খাতিরে মেনে নিলাম আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পারস্পরিক মিত্র নয়। এমনকি ব্যক্তিগতভাবেও এরা একে অপরকে শত্রুই ভাবে। কিন্তু কি অপরাধ সাধারণ মানুষের? একজন ট্রাকচালক মেহেদী হাসান কিংবা কাজের বুয়া আনোয়ারা তো কাউকে জানিয়ে আর আওয়ামী লীগ-বিএনপি করে না। কিংবা ফ্যাসিস্ট জামায়াতিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসীর দাবি নিয়ে রাস্তায় নামে না। তবে কেনই বা সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে এই নির্মম নৃশংসতা?  এরা হয়ত ভোট দিতো। ভোটের রাজনীতিতে এরা উল্টে দিতে পারতো রাজনীতিকদের হিসেব-নিকেষ।

পঞ্চাশ-ষাটজন মানুষ জ্বালিয়ে কিংবা মানুষ পোড়ানোর আতংক ছড়িয়ে ঘর থেকে বের না হওয়ার জন্যে মানুষকে ভয় দেখানোর নাম কি আন্দোলন? একজন শ্রমিককে কাজ করে ভাত খাওয়া থেকে বিরত রেখে অনাহারে তার স্ত্রী-সন্তানদের অভুক্ত রেখে অসহ্য যন্ত্রণায় ঠেলে দেয়ার নাম কি অবরোধ?  মানুষের পেটে লাথি মেরে মানুষকে ভুখা রেখে আর যা-ই হোক আন্দোলন হয় না। যদি আন্দোলনের কথাই বলতে হয়, তবে মানুষকে নিয়েই আন্দোলন করতে হয়। স্যুট-টাই পরে কিংবা শিপন শাড়ি পরে মডেল সেজে ঘরের কোণে বসে থেকে মানুষের কথা বলা যায় না। সেজন্যেই আমরা তাদের ধরে নিতেই পারি, ক্ষমতায় যাবার জন্যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাবার নির্দেশদাতা হিসেবে।

আমরা আওয়ামী লীগ-বিএনপির মার দেখে অভ্যস্থ। আমরা লগি-বৈঠার আন্দোলন দেখেছি, আবার তার বিপরীতে দা-কুড়ালের জন্যে প্রস্তুতির উচ্চারণও শুনেছি। যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে আমরা চাঁদের দেশে সাঈদীর ভেসে বেড়ানো দেখেছি,  দেখেছি জামায়াতিদের তাণ্ডব সারাদেশে। এ সরকারের আমলে মূলত জামায়াতিরাই শুরু করেছে তাণ্ডব। পুলিশ-জনগণকে মারার পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনার ধারাবাহিকতাই মূলত আজকের মানুষ পোড়ানো। এই মানুষ পোড়ানোয় আছে হয়ত ক্ষমতার ভাগাভাগি। জামায়াত দুটো মন্ত্রী নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলো আগেও। এবারে মন্ত্রিত্ব না পেলেও তাদের কোনো কথা থাকবে না। তারা এখন তাদের অন্ধকারের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যে লড়ছে। তারা এখন যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায় কার্যকর করা ঠেকাতে মানুষ হত্যায় নেমেছে। আর সেজন্যেই ভর করেছে বিএনপি নামক দলটির উপর। ভাবতে বিস্ময় লাগে, একজন মুক্তিযোদ্ধার হাতে গড়া এই দল, বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী আছেন যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করেন তাদের হৃদয়ে, অথচ ঐ দলের নেতারাই ক্ষমতায় যাবার জন্যে কিভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, মানুষ পোড়ানোর হাতিয়ারে। এরা পরিণত হয়েছে অন্ধকারের শক্তিতে। এইসব রাজনীতিকের কাছে ক্ষমতা দেশসেবার অংশ নয়। ক্ষমতা আসলেও ওদের কাছে এক ‘আন্ধা ব্যাপার’। সেই অন্ধত্বেই এরা মানুষ পোড়ায়, গাড়ি জ্বালায়। কিন্তু তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কোনো নেতার গাড়ি পোড়ায় না বা পোড়াতে পারে না। এমনকি দেখা যাচ্ছে, খুব অল্প সংখ্যক নেতাই এইসব সন্ত্রাসী হামলায় আক্রান্ত হচ্ছেন। অর্থাৎ শ্রেণিগত বিচারে এরা যেন একই ধারায়। শুধু ক্ষমতার প্রয়োজনে সাধারণ নিরাপরাধ জনগণকে এরা করছে টার্গেট। হত্যা করছে,, পুড়িয়ে মারছে। রেললাইন উপড়ে শত-শত মানুষ হত্যা করার জন্যে যারা পরিকল্পনা করে,  তারা আর যা-ই হোক জনতার কথা এদের মুখে শোভা পায় না। একজন সাধারণ মানুষ তাজুল। দুই মাইল দৌড়ে গিয়ে হাজারো যাত্রী বাঁচানোর জন্যে ট্রেন থামান। আর আমাদের নেতারা মানুষ হত্যা করার জন্যে ভাড়াটে সন্ত্রাসী পোষেন ট্রেন লাইন উপড়ে দিতে।

এদিকে আওয়ামী লীগও যেন কোনো দিক নির্দেশনা যেন দিতে পারছে না। একতরফা নির্বাচন না করে অন্য দলগুলোকে নিয়ে সর্বদলীয় নির্বাচন করারও কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না। দেখাতে পারছে না আওয়ামী লীগ।

তাহলে এ কোন রাজনীতির খেলা চলছে এখন বাংলাদেশে ?

২) মুনীর চৌধুরীর ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ নাটকের একটা সংলাপ আমাকে বড় ভাবায় সেই গত ত্রিশ বছর ধরে: ‘’মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়, কারণে অকারণে বদলায়, সকালে বিকেলে বদলায়’। ‘’
 কথাটায় সত্যতা আছে। আসলেও বদলটা হয়। কিন্তু জাতীয় বদলটা এর আগে এভাবে দেখেনি বাংলাদেশের জনগণ। আমাদের নেতা-নেত্রীদের একটা বড় অংশ ঢালাও মিথ্যে বলেন। এমনকি টিভিতে লাইভ কথা বলেও মাঝে মাঝে তা বেমালুম অস্বীকার করে বসেন। এটা অনেকাংশে জাতীয় রাজনৈতিক চরিত্রের মধ্যে পড়ে। এভাবে নিজে বদলে যাবার কথাটা এর আগে স্বীকার করেনি কেউ। কিন্তু এবার হলো। এক অর্থে এটা একটা পজেটিভ দিক অবশ্য বাংলাদেশের রাজনীতির। একসময়ের স্বৈরাচারী এরশাদ খুব সরাসরি বলেছেন সে কথাটি। তিনি বলেছেন, ‘’লোকে বলে, আমি সকালে বলি এক কথা আর বিকেলে বলি আরেক কথা। ‘’ তিনিই স্বীকার করেছেন, তিনি প্রতি মুহূর্তে বদলাবেন। মুনীর চৌধুরীর নাটকের দার্শনিক উক্তিটাকে তিনি (এরশাদ) জাতীয়ভাবে একটা ভিত দিলেন। একটু বাড়িয়েই বললেন তিনি প্রতিমুহূর্তেই বদলাবেন। আমাদের রাজনীতির দুর্ভাগ্য, জামায়াতে ইসলামীর মতো একটা দল যেমন বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা ভিত্তি করে আছে, ঠিক তেমনি এরশাদের মতো একজন স্বৈরশাসককে নিয়ে আমাদের প্রধান দুটি দলই  টানাটানি করে। দুটো দলের কাছেই এরশাদ স্বৈরশাসক, আবার দুটো দলই তাকে টানে। ক্ষমতার কি বিস্ময়কর মিথ্যচার, কি অদ্ভুত স্ববিরোধিতা! আর সেজন্যেই কখন কার পাল্লায় এই পতিত স্বৈরশাসক উঠবেন তা এরশাদ আসলে নিজেও জানেন না, তাইতো তিনি সত্যি করেই বলেন, ‘আমি প্রতি মুহূর্তেই বদলাতে পারি’। বিস্ময় লাগে আমাদের জনগণও এইসব মিথ্যুকদের কথার সাথে শুধু হাসে এবং রাজপথে এদের সাথেই আবার স্লোগান দেয়।

৩) জানি আবার বদলাবেন এরশাদ। ক্ষমতার মোহ আছে তারও। জীবনের সন্ধ্যাবেলায় জেলের কষ্টকর জীবন তাঁর মতো বিশ্ববেহায়া রাজনীতিককে মানায় না। তাইতো একজন জনগণের নেতা (!) হয়েও গ্রেফতারের ভয়ে পিস্তল দিয়ে আত্মহত্যার কথা বলতে পারেন তিনি ভীরু কাপুরুষের মতো। জাতীয় ফুল-ফলের মতো জাতীয় ধর্ম ইসলামের প্রবর্তক কি অবলীলায় আত্মহত্যার মতো একটা ইসলামবিরোধী কথা বলতে পারলেন, তা অবশ্য ভাবতে আমাদের বিস্ময় লাগে না। বিস্ময় লাগে তখনই, যখন দেখি ঐ ভারসাম্যহীন নেতার সাথে এখনও দেশের প্রধান দলগুলো আছে, থাকতেও চায়্। শুনতে ভাল না লাগলেও এটাই সঠিক এই নেতাটিই এখন বাংলাদেশের রাজনীতির দাবার চালের প্রধান ব্যক্তি। সেজন্যে এরশাদকে বদলাতেই হবে। যদিও দেশ-জাতি চেয়ে আছে সকল দলের অংশ গ্রহণের মধ্যে দিয়ে একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের দিকে। একটা পরিবর্তনের প্রত্যাশায় এখন গোটা জাতি। আগুন-আগুন যুদ্ধ থেকে মুক্তি চায় মানুষ। বিএনপি-জামায়াতিদের সন্ত্রাসী ছোবল থেকে মুক্তি চায় বাংলাদেশের সকল নাগরিক।

ফারুক যোশী: সাংবাদিক ও কলাম লেখক , Faruk.joshi@gmail.com

বাংলাদেশ সময়: ২০১০ ঘণ্টা,  ডিসেম্বর ৮, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।