ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

আলুচাষীদের বাঁচাতে হবে এখনই

ইসলাম চৌধুরী তুহিন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯১০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৯, ২০১৪
আলুচাষীদের বাঁচাতে হবে এখনই ছবি: ফাইল ফটো

বাংলাদেশে শীতের সবজিগুলোর মধ্যে আলু অন্যতম। সারাদেশে প্রায় চার লাখ ৪৪ হাজার হেক্টর জমিতে প্রায় ৯০ হাজার কৃষক এ বছর আলু চাষ করেছেন বলে কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়।



আর এ বছর আলুর ফলনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮৪ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু, বর্তমানে এর লক্ষ্যমাত্রা ৯০ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

গত কয়েক দিন ধরে বাংলানিউজসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক সারাদেশের আলুচাষীদের খবরগুলি গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করছে।

বিশেষ করে গত ৫ ফেব্রুয়ারি দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার মহাসড়কে আলু বিছিয়ে চাষীদের আহাজারির খবর বিভিন্ন দৈনিকে ফলাও করে প্রচারিত হওয়ায় জাতীয় সংসদসহ সচেতন মহলে ভাবনার খোরাক যুগিয়েছে।

কৃষকের এ ধরনের প্রতীকী আর্তনাদের খবরগুলি বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হলেও এ বিষয়ে আমরা উল্লেখযোগ্য কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখিনি।

যদিও মাননীয় কৃষিমন্ত্রী জাতীয় সংসদে শিগগিরই এ অবস্থার উত্তরণ ঘটবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। শুধু আশাবাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সরকার কার্যকর কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

কতটুকু অসহায় হলে একজন কৃষক তার ঘাম ঝরানো কষ্টের  উৎপাদিত আলুকে রাস্তায় ফেলে দেয়, তা আমাদের ভাবতে হবে!

যে আলু বিক্রি করে মহাজনদের ঋণ পরিশোধ করার কথা, বোরো চাষের খরচ মেটানোর কথা, পরিবারের সদস্যদের প্রয়োজন মেটানোর কথা, সে আলু কৃষক কেন জমিতেই নষ্ট করে অথবা রাস্তায় ফেলে দেয়, তা বিশেষভাবে ভাববার সময় এখন হয়েছে।

এই সামান্য চাহিদাটুকু মেটানোর জন্যই কত রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে তারা ফসল ফলায়। মাত্র কিছুদিন আগে হরতাল-অবরোধের সময় দেখলাম সিরাজগঞ্জের কৃষকরা বড় ক্রেতা না পেয়ে প্রতিকেজি সিম বিক্রি করেছে চার থেকে পাঁচ টাকায়। যশোরের সবজি চাষীরা প্রতিটি ফুলকপি বিক্রি করেছে দুই থেকে তিন টাকায়। অথচ ঢাকার বাজারে ঠিক একই সময়ে সিম ও ফুলকপি বিক্রি হচ্ছিল যথাক্রমে ৪০ থেকে ৫০ ও ৩০ থেকে ৩৫ টাকায়।
_1_229
প্রশ্ন হলো, সব সময় কেন লোকসান শুধু কৃষককেই দিতে হবে? এমনিতেই কৃষি কাজের প্রতি মানুষের আগ্রহ প্রতিনিয়ত কমছে। আর এ অবস্থা চলতে থাকলে এটি আরো ত্বরান্বিত হবে।

অন্যদিকে, পেঁয়াজের মতো সবজি আমদানি করতে গেলে তার দাম কোথায় গিয়ে ঠেকবে, সে কথা হয়ত সময়ই বলে দেবে।

কৃষক অনেক প্রতিকূল পরিবেশে একটু লাভের আশায় তাদের শস্যকে দিনের পর দিন যত্ম করে গড়ে তোলেন। তাদের পরম যত্মের এ উৎপাদন যেন কখনো কখনো গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। তখন আর তাদের হতাশার শেষ থাকেনা।

বাজার ঘাঁটলে দেখা যায়, গত বছর যেখানে আলুর কেজিপ্রতি দাম ছিল সাদা ৫/৬ টাকা এবং লাল ১০/১২ টাকা, একই সময়ে এ বছর আলুর দাম কেজিপ্রতি যথাক্রমে দেড় টাকা ও ৪/৫ টাকা।   কোথাও কোথাও তার চেয়েও কম দাম।

এই অবস্থা এখন চলছে বৃহত্তর বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, যশোর, কুষ্টিয়াসহ সারাদেশে। আবার অন্যদিকে পর্যাপ্ত সংরক্ষণাগারের অভাবে কৃষকরা এ আলুগুলোকে সংরক্ষণ করে পরবর্তীতে বাজারে বিক্রি করবেন, সে সুযোগ থেকেও বঞ্চিত।

সূত্র মতে, দেশে যে সব সংরক্ষণাগার রয়েছে, তাতে মাত্র ৪০ থেকে ৪৫ লাখ মেট্রিক টন আলু সংরক্ষণ করা সম্ভব। বাকি অর্ধেকেরও বেশি পরিমাণ আলু অসংরক্ষিত-ই থেকে যায়। ঠিক একই চিত্র দেখা যায়, অন্যান্য সবজির বেলাতেও।
 
জিডিপিতে একক খাত হিসেবে কৃষির অবদান সবচেয়ে বেশি। অথচ সঠিক নীতির অভাবে দিনের পর দিন কৃষি ব্যবস্থার ওপর যে আঘাত আসছে, তা মোকাবেলা করে কতদিন কৃষক তাদের এ আশা টিকিয়ে রাখতে পারবেন, সেটিই এখন দেখার বিষয়!

একদিকে, আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাওয়া, অন্যদিকে সার ও বীজ সংকট, কৃষি উপকরণের দাম বৃদ্ধি, জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পাওয়া, উপকূলীয় অঞ্চলের জমিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক নানান দুর্যোগ ইত্যাদি নানা সমস্যায় জর্জরিত আমাদের কৃষি। তার ওপর উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া যেন এখন একটি স্বাভাবিক ঘটনা। আর  হরতাল অবরোধেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের অপার সম্ভবনাময় এ খাতটিই।

২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আলুর বাম্পার ফলনে সরকার প্রচার মাধ্যমকে ব্যবহার করে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ‘বেশি করে আলু খান, ভাতের ওপর চাপ কমান’-এ স্লোগানকে সারাদেশে ছড়িয়ে দিয়েছিল।

যদিও এতে খুব বেশি লাভ হয়নি। তাই, আমাদের স্থায়ী সমাধানের পথে এগুতে হবে। বিজ্ঞানের এ যুগে আমরা পিছিয়ে থাকতে পারিনা। চীন, জাপান, থাইল্যান্ড এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও নেপাল শস্যের বহুমুখী উপযোগিতার দিকে ঝুঁকছে। আর এতে নতুন নতুন কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ ইন্ডাস্ট্রি তৈরি হচ্ছে। ওই দেশগুলির অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।

আমরাও যদি প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করি, তাহলে আমাদের কৃষককে তখন আর তাদের উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাতকরণ নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাতে হবে না। আর অন্যদিকে শিক্ষিত বেকার যুবকরাও তাদের কর্মসংস্থানের জায়গা তৈরি করে নিতে পারবে।

এ ছাড়া উন্নত দেশসমূহ কৃষিখাতকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দিয়ে তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে। জাপানে কৃষিখাতকে গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় কর্ম পরিচালনা করা হয়। অথচ বাংলাদেশের বেলায় এর উল্টো।

বাংলাদেশের কৃষক ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সব সময়ই উপেক্ষিত। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকার কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও তা চলে যায় মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের পকেটেই। তাই এখন সময় হয়েছে এ নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করার।

এ দেশের কৃষি ও কৃষককে বাঁচাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এগিয়ে আসবে এ প্রত্যাশা-ই করছি।
  
লেখক: কৃষিবিদ
সহকারী অধ্যাপক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
ইমেইল- mticsau@yahoo.com   

বর্তমানে তিনি মনবসু স্কলারশিপে উচ্চশিক্ষার জন্য জাপানে অবস্থান করছেন

বাংলাদেশ সময়: ১৯০৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।