ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

উপজেলা নির্বাচন: গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রায় নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা

সাইফ উদ্দিন আহমেদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০০ ঘণ্টা, মার্চ ৩০, ২০১৪
উপজেলা নির্বাচন: গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রায় নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা

৩১ মার্চ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে চতুর্থ উপজেলা নির্বাচনের পঞ্চম পর্যায়। ৭৪টি উপজেলায় এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।



প্রথম দুই দফার নির্বাচন মোটামুটি শান্তিপূর্ণ হলেও তৃতীয় এবং চতুর্থ দফায় সংঘর্ষ, মৃত্যু, কেন্দ্র দখল ও ব্যালট পেপার ছিনতাইসহ বিভিন্ন অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ধাপে ধাপে সহিংসতার পরিমাণ ও মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

প্রথম দুই পর্বে বিএনপি ও জামায়াত সমির্থত প্রার্থীরা এগিয়ে থাকলেও তৃতীয় ও চতুর্থ দফা নির্বাচনে উল্টো চিত্র ফুটে উঠেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি জনসমর্থনের চিত্রও পাল্টে যাচ্ছে। প্রাপ্ত ৩৮৫ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে এ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা ১৭০টি, বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা ১৪৪টি, জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীরা ৩৩টি, জাতীয় পার্টি সমর্থিত প্রার্থীরা ৩টি, স্বতন্ত্র ও অন্যান্য দলের সমর্থিত প্রার্থীরা ২৯টিতে জয়ী হয়েছেন। ভোটের হিসেবে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা ৫০%, বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা ৩৫%, জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীরা ১৩% এবং অন্যরা পেয়েছেন ২% ভোট।

নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ তথা গ্রহণযোগ্য জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান। এ লক্ষ্যে কমিশনকে আমাদের সংবিধান স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। দিয়েছে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার অগাধ ক্ষমতা।

নির্বাচনের সময় পরিপূর্ণ স্বাধীনতা এবং বলপ্রয়োগসহ সব ধরনের ক্ষমতা কমিশনের কাছে থাকা স্বত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন উপজেলা নির্বাচনকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করতে পারছে না।
 
স্থানীয় সরকার নির্বাচন পদ্ধতি নির্দলীয় হওয়ার পরও রাজনৈতিক দলগুলো দলীয়ভাবে প্রার্থী মনোনয়ন বা প্রার্থীদের সমর্থন প্রদানের ধারা অব্যাহত রেখেছে। পাশাপাশি একক প্রার্থী নির্ধারণের জন্য মনোনীত বা নির্ধারিত প্রার্থী ছাড়া অন্যান্যদের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। বিদ্রোহী প্রার্থী হলে বহিষ্কার করা হচ্ছে। বিষয়টি নির্বাচনকে প্রভাবিত করার শামিল, যা সু¯পষ্টভাবে নির্বাচনী আচরণবিধির লঙ্ঘন।

বিস্ময়কর ব্যাপার যে, রাজনৈতিক দলগুলোর এ অগ্রহণযোগ্য আচরণে নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ নীরব। রাজনৈতিক দলগুলো দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষার্থে বিদ্রোহী প্রার্থীর ব্যাপারে উদ্যোগী হবে এটাই স্বাভাবিক। তাই কমিশনকে উদ্যোগী হয়ে রাজনৈতিক দল এবং সরকারের সাথে কথা বলতে হবে। নির্বাচনটা নির্দলীয়ই থাকবে নাকি দলীয় ভিত্তিতে হবে সে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে নির্বাচনী বিধি-বিধান আমাদের মানতেই হবে।

স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবারই প্রথম কয়েকটি পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সারাদেশে এতগুলো নির্বাচন একসঙ্গে করার চেয়ে পর্যায়ক্রমে করাই উত্তম, যেমনটি ভারতসহ বিভিন্ন দেশে হয়ে থাকে। প্রথম দফার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর ভুলত্রুটিগুলো বিশ্লেষণ করে পরবর্তী ধাপে সেগুলো শোধরানোর সুযোগ পাওয়া যায়। নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সহজ হয় শান্তিপূর্ণ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার। কিন্তু নির্বাচন কমিশন কর্তৃক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে না পারার কারণে এই পদ্ধতির সুফল আমরা ভোগ করতে পারিনি। নির্বাচনী সহিংসতায় মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যা অনাকাঙ্ক্ষিত ।

আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত বিশাল আয়তনের এবং বহুভাষী। ভিন্ন ভিন্ন বর্ণ ও গোত্রের মানুষের দেশ হওয়া স্বত্ত্বেও সে দেশের নির্বাচন কমিশন জনগণের আস্থার প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিণত হতে পেরেছে। সরকার, বিরোধী দল, গণমাধ্যম ও জনগণ সবাই কমিশনকে সহায়তা করে।

সুষ্ঠু পরিকল্পনা, আইনের যথাযথ প্রয়োগ, সুষ্ঠু ও নিরেপক্ষভাবে দায়িত্ব পালন, সময়োপযোগী সৃজনশীল উদ্যোগ গ্রহণ এ সফলতার মূল রহস্য বলে জানিয়েছেন সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া ভারতের প্রাক্তন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এস ওয়াই কুরায়শী।

বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের পক্ষেও সম্ভব জনআস্থার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার। এজন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

প্রথমত: সার্চ কমিটির মাধ্যমে আমাদের নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের বাছাইকরণ  উদ্যোগটি প্রসংশনীয়। তবে বাছাই প্রক্রিয়ায় শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত এবং সমর্থন নিশ্চিত করা আবশ্যক। আমাদের দেশের আমলারা দক্ষ, যোগ্য এ বিষয়ে সন্দেহ নেই তবে নির্বাচন কমিশনে দায়িত্ব পালনে দক্ষতা, যোগ্যতার পাশাপাশি ব্যক্তিত্বস¤পন্ন সাহসী এবং সৃজনশীল নেতৃত্ব প্রয়োজন।

দ্বিতীয়ত: স্থানীয় এবং জাতীয় নির্বাচনের সময় ক্ষমতাসীনদের বিশেষ সুবিধা গ্রহণ একেবারে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে এবং সকল প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।

তৃতীয়ত: নির্বাচনকালীন সময়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য, টেলিভিশনে প্রচারিত খবর, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অভিযোগ প্রতিনিয়ত আমলে নিতে হবে এবং তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে হবে। গণমাধ্যম তথ্য ও ছবি দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করতে পারে।

চতুর্থত: নির্বাচনী আচরণবিধি প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিক সকলেই যাতে মেনে চলে তা নিশ্চিত করতে হবে কমিশনকে। কখন কোন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তার সূচি তৈরি করবে এবং তা নিশ্চিত করবে কমিশন।

রাজনৈতিক দল কিংবা সরকারের সুবিধা অসুবিধা বিবেচনা করে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে কমিশনের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা থাকবে না। ভারতের প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, ভারতীয় নির্বাচন কমিশন ১৯৫২ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত কোনো ডেডলাইন মিস করেনি।

পঞ্চমত: শুধু নির্বাচন অনুষ্ঠান নয়, নির্বাচনী পরিবেশকে উন্নত এবং উৎসবমুখর করতে কমিশনকে সৃজনশীল উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তরুণদের এবং নারীদের ভোটার হতে উদ্বুদ্ধ করতে প্রতিবছর বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারে কমিশন।

সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নারীদের জন্য আলাদা বুথ এবং বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হিসেবে নিতে হবে কমিশনকে। কমিশনের উদ্যোগে আচরণবিধি লিফলেট আকারে, পত্র-পত্রিকায়, রেডিও ও টেলিভিশনে প্রচার করতে হবে। নাটিকার মাধ্যমে ভোটার, প্রার্থী, রাজনৈতিক কর্মীদের নির্বাচনী আইন-কানুন, বিধি-বিধান স¤পর্কে সচেতন করতে হবে।

ষষ্ঠত: নির্বাচনকে কালো টাকার দৌরাত্ম থেকে মুক্ত করতে হবে। প্রত্যেক প্রার্থীকে নির্বাচনের পূর্বে ব্যাংক একাউন্ট খুলতে বাধ্য করতে হবে এবং তার মাধ্যমে যাবতীয় খরচ করতে হবে। আয়-ব্যয়ের ক্ষেত্রে আয়কর বিভাগের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। নির্বাচনকালীন ব্যয় পর্যবেক্ষণের জন্য মোবাইল টিম করে দিতে হবে।

সপ্তমত: প্রার্থীর আয়-ব্যয়, সম্পদ ও দায়-দেনার হিসাব যাতে এলাকার ভোটাররা ভোট প্রদানের পূর্বে জানতে পারে, কমিশনকে সে উদ্যোগ নিতে হবে। প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীদের তুলনামূলক তথ্য বিবরণী লিফলেট আকারে ছাপিয়ে প্রার্থীদের নির্বাচনী এলাকায় ভোটারদের মাঝে বিতরণ করতে হবে যাতে ভোটাররা জেনে-শুনে-বুঝে সৎ ও যোগ্য প্রার্থী বাছাই করতে পারে।

আশাকরি পঞ্চম পর্বের নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে সকল প্রকার বিতর্ক ও সহিংসতামুক্ত করতে নির্বাচন কমিশন এবং সরকার সর্বশক্তি প্রয়োগ করবে। নির্বাচনী ব্যবস্থা যদি কলুষমুক্ত করা যায় তাহলে আমাদের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করা সহজ হবে।

গণমাধ্যমকে সহযোগী করে রাজনৈতিক দলগুলোকে আইন মানতে বাধ্য করা গেলে এবং জনগণকে প্রার্থী স¤পর্কে জেনে-শুনে-বুঝে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট দেওয়ার সুযোগ করে দিতে পারলে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন হতে পারে জনগণ, গণমাধ্যম, বিরোধী দল এবং সরকারি দলের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান।

সাইফ উদ্দিন আহমেদ
সিনিয়র প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর (গর্ভন্যান্স), দি হাঙ্গার প্রজেক্ট
ই-মেইল: saifahmed71@yahoo.com
 
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।