ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

বন্ধ হোক ডাক্তারদের কর্মবিরতি সংস্কৃতি

ড. জিনিয়া জাহিদ, কনট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪৭ ঘণ্টা, মে ৭, ২০১৪
বন্ধ হোক ডাক্তারদের কর্মবিরতি সংস্কৃতি ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম (ফাইল ছবি)

বেশ কয়েকদিন ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলোতে ডাক্তারদের সাথে সাধারণ রোগী বা তার পরিজনের মধ্যে বাকবিতন্ডা, হাতাহাতি এমনকি মারামারির খবর সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে। ডাক্তারদের কর্মস্থল ফেলে রাজপথে ধর্মঘট করার ঘটনাও পরিলক্ষিত হচ্ছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিমের অনুরোধ এমনকি হুমকি-ধামকিতেও আন্দোলনরত ডাক্তারেরা থোড়াই কেয়ার করছেন।
 
নিজের আপনজন যখন কোনো রোগে ভোগেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই সেই রোগীর পরিবার বিপর্যস্ত থাকেন। আপনজনকে সুস্থ করার লক্ষে ভালো চিকিত্সার আশায় তারা ডাক্তারদের শরণাপন্ন হন। পছন্দের ডাক্তারের কাছে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করে মোটা অঙ্কের ফিস দিয়ে যখন ডাক্তারের দেখা পান, তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, রোগীর বৃত্তান্ত কোনো মতে শুনেই ডাক্তার প্রয়োজন থাকুক আর না থাকুক হরেক রকমের টেস্ট করার জন্য বিশাল একটি লিস্ট ধরিয়ে দেন রোগীর হাতে। আবার সেই প্রেসক্রিপশনের মাথায় লেখা থাকে কোথায় কোন সেন্টারে গিয়ে টেস্ট করতে হবে। অর্থাৎ আপনি যদি নির্দিষ্ট সেই স্থানে টেস্ট না করেন তবে ডাক্তার সাহেব সেই রিপোর্ট ছুয়েও দেখবেন না।
 
doctor_01বিশাল অঙ্কের টাকা দিয়ে এই টেস্ট সেই টেস্ট করে ডাক্তারকে আবার মোটা অঙ্কের ফিস দিয়ে রিপোর্ট দেখিয়ে তবেই আপনি ঔষধ পাবেন। সেখানেও লেখা থাকে নির্দিষ্ট ঔষধ কোম্পানির ঔষধ। আবার সেই ঔষধ নির্দিষ্ট ডিস্পেন্সারী ছাড়া পাওয়াও নাকি যায় না।

আপনার ভাগ্য যদি অতি খারাপ হয়, অর্থাৎ ডাক্তারের চিকিত্সায় যদি আপনি সুস্থ হয়ে না ওঠেন তবে যদি অন্য কোনো ডাক্তারের কাছে যান, তবে দেখবেন নতুন ডাক্তার আবার আপনাকে এক গাদা টেস্ট করতে লিস্ট হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন। অথচ সপ্তাহখানেক আগেই আপনি হুবহু একই টেস্ট করেছেন। সেই রিপোর্ট যদি নিয়ে যান, নতুন ডাক্তার সেগুলো ছুঁয়েও দেখবেন না। তার পছন্দের ডায়াগনিস্টিক সেন্টার থেকে ওই একই টেস্ট যদি আপনি করিয়ে আনতে পারেন তবেই তিনি তা ছুয়ে দেখবেন এবং আপনার চিকিত্সা শুরু করবেন।

সব থেকে ভয়াবহ ব্যাপার হয় তখনই যখন প্রথমজন বলেন যে, আপনার এই অসুখ হয়েছে আর পরের জন ভিন্ন আরেকটি অসুখের কথা বলছেন। আপনি তখন পুরাই কনফিউজড। কাকে বিশ্বাস করবেন? তৃতীয় কোনো ডাক্তার? যদি আপনার পয়সা একটু বেশি থাকে বা যদি ধার করার মত আত্মীয় পরিজন থাকে তবে আপনি বাংলাদেশের এইসব চিকিত্সকের উপর সম্পূর্ণ আস্থা হারিয়ে নিদেনপক্ষে ভারতের ভিসার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে পরবেন।

এ তো গেল ডাক্তার দেখানো পর্ব। এখন আসুন হাসপাতাল পর্বে।

বাচ্চা ডেলিভারির মত খুব নরমাল কিছু নিয়ে অথবা একটু বেশি সিরিয়াস রোগ নিয়ে প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ভর্তি হলে হয় আরেক কাহিনী। আমাদের ডাক্তারদের বেশিরভাগেরই নরমাল ডেলিভারি করতে যে সময় দরকার হয়, তার জন্য অপেক্ষা করার মত সময় ও ধৈর্য কোথায়? আর তাছাড়া বিশাল অঙ্কের টাকারও তো একটা ব্যাপার স্যাপার আছে। মাঝে মাঝে তো সন্দেহ হয়, নরমাল ডেলিভারির জন্য যে দক্ষতার প্রয়োজন হয়, প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর ডাক্তারদের আদৌ কি তা আছে? তা না হলে সিজারিয়ান করার জন্য তাদের এত আগ্রহ কেন? অমুক দিন আসুন। তারপর কথা নেই বার্তা নেই পেট কেটে বাচ্চা বের করে কমপক্ষে ৫ থেকে ৭ দিন ক্লিনিকে রেখে দিতে পারলেই বিশাল অঙ্কের টাকা।
 
DMCH_01অথচ সরকারী হাসপাতালে উল্টা ব্যাপার। থাকুক পরে রোগী হাসপাতালের বারান্দায়। লেবার পেইনে কাতরাতে কাতরাতে যখন সঙ্গিন অবস্থা, তখন হয় নরমাল ডেলিভারি। বাংলাদেশে কোনো গরিব রোগীদের তো সিজার করার কথা শুনি না।

সরকারী হাসপাতালে রোগীদের সাথে নার্স, আয়া থেকে শুরু করে ইন্টার্নি ডাক্তার এমন কি বড় (?) ডাক্তাররাও রোগীর সাথে তেমন ভালো ব্যবহার করেন না। এখানে রোগীর থেকে রোগীর প্রতিপত্তি হলো আসল। রোগীর ভিজিটরেরা যদি পোশাকে-আশাকে, ঠাটবাটে সেই রকম হয়ে থাকেন তবে নার্স, আয়াদের খেদমতগিরি বেড়ে যায়। অন্যথায় ১০০ বার ডাকলেও একবারও সাড়া পাওয়া যায় না।
 
হাসপাতালগুলোর অব্যবস্থাপনা, হয়রানি, দুর্ব্যবহার তদুপরি মোটা টাকার গচ্চা এসবের কথা আপনি তখনই ভুলে যেতে পারবেন, যখন সৃষ্টিকর্তার অসীম রহমতে রোগী নিয়ে কোনমতে বাড়ি ফিরতে পারবেন। কিন্তু যদি আপনি বুঝতে পারেন যে. ডাক্তারদের ভুলে আপনার রোগীর চরম কোনো ক্ষতি হয়েছে, পাঁচটা মিনিট আগে সঠিক চিকিত্সা পেলেও হয়ত বা আপনার রোগীর ভাগ্য অন্যরকম হতে পারত, তখন আবেগের বশে ডাক্তারের সাথে বাকবিতন্ডায় লিপ্ত হওয়া কিন্তু অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার না।
 
তবে সকল ভুক্তভোগীই যে বাকবিতন্ডায় লিপ্ত হচ্ছেন, তা কিন্তু নয়। হাতে গোনা কয়েকজন অনিয়ম, ভুল চিকিত্সার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন।
 
কিন্তু দু-একজন রোগীর পরিজনদের দু-একজন সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের সাথে এই অপ্রীতিকর ঘটনার জের গায়ে মেখে সকল ডাক্তারদের আর সব রোগীদের চিকিত্সা না করে প্রতিবাদে মুখর হয়ে রাজপথে নেমে আসা কতখানি যুক্তিসঙ্গত?
 
ডাক্তারেরা কি বুকে হাত দিয়ে জোর গলায় বলতে পারবেন যে, তাদের গোত্রের কারো একজনের ভুল চিকিত্সায় কোনো রোগী আজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যান নি? কেউ মারা যান নি? অযথাই দরকার না হলেও প্রয়োজনীয় টেস্ট করতে রোগীকে উদ্বুদ্ধ করেন নি? নরমাল ডেলিভারি হবার সব লক্ষণ থাকার পরেও রোগীর সিজার করেন নি? অন্যায় জেনেও হাসপাতালের অব্যস্থাপনায় মুখ বুজে থাকেন নি? ঔষধ কোম্পানির কাছ থেকে, প্যাথলজি সেন্টার থেকে কমিশন নেন নি? সরকারী হাসপাতালের ডাক্তার হয়েও অফিস আওয়ার ফাকি দিয়ে প্রাইভেট প্রাকটিস করেন নি? ট্র্যাক্স ফাঁকি দেন নি?
 
doctor_02যদি এসব প্রশ্নের একটির উত্তরও হ্যা হয়, তবে বিবেকের কাছে প্রশ্ন করুন কেন আপনারা সাধারণ রোগীদের চিকিত্সা না দিয়ে আন্দোলন করছেন? কিসের জন্য করছেন? সম্মানের জন্য? আন্দোলন করে সম্মান আদায় করে নেবেন?
 
রোগী যখন সুস্থ হয়ে ওঠে তখন যে সম্মান ও কৃতজ্ঞতা আপনারা সুস্থ হয়ে যাওয়া সেই ব্যক্তি ও তার পরিজনের কাছে পেয়ে থাকেন তা কি আপনাদের উদ্বুদ্ধ করে না অপ্রীতিকর এসব ঘটনা এড়িয়ে আরো ভালো সেবা দেবার জন্য?
 
আপনারা যদি পেশায় ডাক্তার ও নৈতিকতায় প্রকৃত মানুষ হতেন, তবে অবশ্যই প্রতিবাদে মুখর হতেন সেদিন যেদিন ৬ বছরের বাচ্চার কিডনি কেটে নিয়ে মৃত্যুর মুখে ফেলে পালিয়ে গিয়েছিল আপনাদের মত কোনো ডাক্তার। প্রতিবাদে মুখর হতেন তখন, যখন সামান্য লিফটে চড়া ইস্যু নিয়েও মারামারিতে লিপ্ত হয় শিক্ষানবিশ কোনো চিকিত্সক। প্রতিবাদে মুখর হতেন তখন যখন রোগীর জন্য বরাদ্দ সরকারী ঔষধ বিক্রি হয় বাজারে। প্রতিবাদে মুখর হতেন তখন যখন আপনাদের কোনো ডাক্তারের অপারেশনের সময় রোগীর পেটের ভিতর ব্যান্ডেজ, গজ-ফিতা রেখে ভুল চিকিত্সায় মারা যান কোনো রোগী।
 
একজন ডাক্তারের কিংবা একজন রোগীর ঔদ্ধত্য আচরণে কেন সব ডাক্তারেরা কর্মবিরতি নিয়ে অন্য সকল রোগীদের জীবন বিপন্ন করে তুলবেন? এই শিক্ষাই কি একজন ডাক্তার হিসেবে আপনারা ধারণ করেন? মানবসেবার ব্রত নিয়ে এই পেশায় কি আপনারা আসেন নি?
 
তাই ডাক্তার-রোগী যদি অনাকাংখিত অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ঘটেই যায়, তবে তা সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্মকর্তা বা আইনি তদন্তের মধ্যেই নিস্পত্তি হোক। ঢালাওভাবে সকল ডাক্তারদের কর্মবিরতি নিয়ে সকল রোগীদের জীবন যেন আর বিপন্ন না হয় সেটাই কাম্য।

একজন ডাক্তার/রোগীর পরিজনের কর্মকান্ডের জন্য ঢালাওভাবে সকল রোগীকে জিম্মি করে ডাক্তারদের আন্দোলন করার এই সংস্কৃতি অবিলম্বেই আইন করে নিষিদ্ধ করা হোক। কঠিন শাস্তির কঠোর আইনই পারে সাধারণ রোগীদের এইসব ডাক্তারদের জিম্মি অবস্থা থেকে মুক্ত করতে।

 

ড. জিনিয়া জাহিদ: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক

 

বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৯ ঘণ্টা, মে ০৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।