ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

নারায়ণগঞ্জই তো বাংলাদেশ!

জাহিদ নেওয়াজ খান, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০৪ ঘণ্টা, মে ১৪, ২০১৪
নারায়ণগঞ্জই তো বাংলাদেশ! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টফোর.কম/ ফাইল ফটো

খুনোখুনি আর রক্তারক্তিটাই যা একটু বেশি। এর বাইরে নারায়ণগঞ্জ কি বাংলাদেশের বিচ্ছিন্ন কোনো জনপদ? নাকি নারায়ণগঞ্জই সমগ্র বাংলাদেশের এক প্রতিচ্ছবি?

নারায়ণগঞ্জে সাতখুনের ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত নূর হোসেন একজন রাজনীতিক।

নিহত ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলামও তাই ছিলেন।

তবে এমন না যে সেভেন মার্ডারের আগে শুধুই একজন রাজনীতিক ছিলেন নূর হোসেন। বরং তার বিরুদ্ধে হত্যা, সন্ত্রাস, মাদক ব্যবসা, জমি দখল, নদী দখল এবং চাঁদাবাজিসহ এরকম অভিযোগে মামলা ছিলো ২২টি।

অন্যদিকে একইরকম অভিযোগে নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে থানায় ছয়টি সাধারণ ডায়েরি ছাড়াও ১৫টি মামলা ছিলো।

তারা পরস্পরের প্রতিপক্ষ ছিলেন, তবে তাতে কোনো রাজনীতি ছিলো না। এই দুজন যে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব করতেন এমনও না, তারা একই দলে ছিলেন; তাদের মধ্যে যে সংঘাত ছিলো সেটা ছিলো আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই। সেই আধিপত্য চেষ্টার মূল কারণ অর্থনৈতিক। যে যতো বেশি শৌর্য দেখাতে পারবে তার ততো বেশি দখলিস্বত্ব, ততো বেশি অর্থনৈতিক লাভালাভ।

রাজনীতির নামে পুরো বাংলাদেশেই এ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই। নামের বাহারে কোথাও সেটা আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি, কোথাও পাতাবাহারের মতো একই দলে থেকে নানা নামে নানা গ্রুপে রক্তারক্তি আর খুনোখুনি।

এই খুনোখুনিতে যে শৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহারের অভিযোগ, সেটাও যে শুধু নারায়ণগঞ্জে এমন না। তিন কর্মকর্তাকে র‌্যাব থেকে প্রত্যাহারের পর তাদের মূল বাহিনী, সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনী থেকে অকালীন আর বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর পর শৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে এরকম হত্যাকা-ের আরো অভিযোগ আসছে।

জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করতে শৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করার কারণেই ব্যক্তি স্বার্থেও কাজ করার সাহস পেয়েছেন কিছু কর্মকর্তা। নির্বাচনের আগে পরে বিএনপির বেশ কিছু নেতা-কর্মীর গুম হয়ে যাওয়ার নেপথ্যে কোথাও কোথাও নিজ দলের দ্বন্ধও কাজ করে থাকতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। তবে সেই সাহস কর্মকর্তারা পেয়েছেন, সরকার তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের কারণে।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এভাবে একদিকে সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আর অন্যদিকে রাজনীতিকদের ব্যক্তি স্বার্থ পূরণের অংশ হওয়ায় সাধারণ মানুষের জীবন যে শংকার মধ্যে তার প্রমাণও নারায়ণগঞ্জ।

নজরুল ইসলামসহ ৫ জনকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার সময় তা দেখে ফেলেছিলেন কারো সাত-পাঁচে না থাকা আইনজীবী চন্দন সরকার। তার গাড়ির চালকসহ তাই অপহৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় সাতে। শেষ পর্যন্ত সাতজনই নিহত, শীতলক্ষ্যায় তাদের মরদেহ ভেসে উঠা।

নারায়ণগঞ্জে সর্বশেষ সেভেন মার্ডারের ঘটনায় চাপা পড়ে গেছে কিশোর ত্বকী হত্যাকা-সহ সেখানকার অতীতের অনেক অপরাধ। আড়ালে চলে গেছে ওসমান পরিবারের এমনকি সাম্প্রতিক অতীত কর্মকা-। অথচ এই নূর হোসেন এবং নজরুল ইসলাম দুজনই নারায়ণগঞ্জের গডফাদার হিসেবে পরিচিত শামীম ওসমানের কাছের লোক।

একটা না একটা ঘটনায় গডফাদাররা সবসময় এভাবেই আড়ালে থেকে যায়। রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে পুষ্ট এরকম ছোটবড় গডফাদার সারাদেশে অনেক।

আর তাদের যে মূল নেতা-নেত্রী তাদের কাছে ক্ষমতাই মুখ্য। এ কারণেই আজ র‌্যাবের প্রতিষ্ঠাতা বেগম খালেদা জিয়া র‌্যাবকে ‘মানুষখেকো’ এবং ‘রক্তচোষা’ দাবি করে বিলুপ্তি দাবি করছেন।

অন্যদিকে ২০০৮ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসা শেখ হাসিনা কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না বলার পরও অভিযুক্ত র‌্যাব কর্মকর্তারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।

কুমিল্লা এবং লক্ষীপুরেও একইরকম ঘটনা ঘটিয়ে আসার অভিযোগে অভিযুক্ত র‌্যাব কর্মকর্তা নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় চাকুরি হারালেও সহযোগীদেরসহ অন্ততঃ এখন পর্যন্ত তার গ্রেফতার না হওয়া এটাও প্রমাণ করছে, কিছু জায়গায় রাজনৈতিক শক্তি অসহায়, বিচার বিভাগও তাই।

নারায়ণগঞ্জ এভাবে সারাদেশের এক অসহায় চিত্র প্রকাশ করলেও মানুষের শক্তির প্রমাণও কিন্তু নারায়ণগঞ্জেই আছে। কয়েক বছর আগে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সন্ত্রাস-দুর্নীতি-সুবিধাবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জের মানুষ জনরায় দিয়ে প্রমাণ করে রেখেছেন, শেষ পর্যন্ত মানুষেরই জয় হয়।

বাংলাদেশ সময় ১৩০২ ঘণ্টা, মে ১৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।