ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ ভাদ্র ১৪৩২, ২৬ আগস্ট ২০২৫, ০২ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

মুক্তমত

উদার ও সেক্যুলার ভারতের জন্য নরেন্দ্র মোদি কি হুমকি?

সানি হুন্দাল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪:৫৯, মে ১৮, ২০১৪
উদার ও সেক্যুলার ভারতের জন্য নরেন্দ্র মোদি কি হুমকি?

সানি হুন্দাল ব্রিটিশ সাংবাদিক ও ব্লগার। এশিয়ার নানা ইস্যু নিয়ে বেশ কিছু প্রকাশনাসহ ‘গার্ডিয়ান’, ‘নিউ স্টেটম্যান’ পত্রিকায় লেখালেখি করেন।

  ১৬ মে, মোদির বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পর সানি হুন্দালের এই লেখাটি ‘সিএনএন’-এর মতামত পাতায় প্রকাশিত হয়। সেখান থেকে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এর পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন পারমিতা হিম

পৃথিবীর বৃহত্তম নির্বাচনে জয়লাভ করে মোদির প্রধানমন্ত্রিত্ব এখন একদম নিশ্চিত।

১৯৫৯ সালে সেক্যুলার ও উদার জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর, এই প্রথম ভারতের মসনদে অলিখিতভাবে হিন্দু জাতীয়তাবাদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলো।

এ ঘটনা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের অবতারণা ঘটিয়েছে; মোদি কেমন প্রধানমন্ত্রী হবেন? ভারতের ওপর দুর্নীতির যে কালিমা রয়েছে তিনি কি তা মুছে ফেলে দেশে আবার সুদিন ফিরিয়ে আনতে পারবেন? নাকি দেশটির ধর্মীয় উত্তেজনাকে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাবেন?

তার বেশি সমালোচনা হচ্ছে ২০০২ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে। যে দাঙ্গায় শত শত, সম্ভবত হাজারো, মুসলমানকে হিন্দু জনতা নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। এবং সে সময় মোদি সরকার চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কোনো ভূমিকাই পালন করেনি।

.....................................

তার লিবারাল সমর্থকরা হয়ত নিজেদেরকে প্রবোধ দিয়েছেন এই ভেবে যে, ভারতের লিবারাল, সেক্যুলার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে হুমকির মুখে ফেলার ক্ষমতা মোদির নেই, তবে অসাধারণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটানোর ক্ষমতা তার আছে। তিনি ক্ষুদ্র গুজরাটকে যে বিরাট পাওয়ার হাউজে পরিণত করেছেন সেটা তারা মনে রাখছেন, কিন্তু তাঁর চোখের সামনে যে বিরাট দাঙ্গা হয়েছিল সেটা তারা বেমালুম ভুলে গেছেন।

.....................................

 

ক্ষমতায় থাকাকালে, এই বিজেপি প্রার্থী আইনের শাসনের প্রতি উদ্বেগজনক অশ্রদ্ধা দেখিয়েছেন, রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য কয়েক ডজন বিচার বহিভূর্ত হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রভাবিত করেছেন, তার স্বজনপ্রীতিমূলক পুঁজিবাদ (যাকে বলা হয় ক্রনি ক্যাপিটালিজম) এর তীব্র সমালোচনা হয়েছিল। ধর্মান্ধ লোকজন দিয়ে সবসময় পরিবেষ্টিত থাকা ছাড়াও তার নিজের রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নিজের ভূমিকাকে অতিরঞ্জিত করে দেখিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। তাছাড়া নির্বাচনী প্রচারণায় তার পক্ষের লোকজনের কোন কোন মন্তব্য এরই ইঙ্গিত দেয় যে, মোদি সরকার সমালোচনা সহ্যকারী নয়; গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিরোধী, এবং দেশটিতে ধর্মীয় বিভেদ সৃষ্টি করে মেরুকরণের পক্ষে।

বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের কথাই ধরা যাক। ২০১২ সালে, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০০৩ থেকে ২০০৬ সালে ঘটে যাওয়া অন্তত বিশটি হত্যাকান্ডের তদন্তের আদেশ দিয়েছিলেন। যেগুলোতে পুলিশের হাতে নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু হয় বলে মনে করা হচ্ছিল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের হিসাব অনুযায়ী, সেসময় গুজরাট পুলিশের সাথে ‘এনকাউন্টারে’ কমপক্ষে একত্রিশ জন লোককে বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে।

২০০৪ সালে, এক ঘটনায় পুলিশ দাবি করে যে তারা মোদীকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে এমন চার সন্ত্রাসীকে হত্যা করেছে। এদের মধ্যে ইসরাত জাহান নামে ঊনিশ বছর বয়েসী এক মেয়েও ছিল। কোনো ধরনের সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়াই মোদী তাকে তাঁর হত্যাপ্রচেষ্টার ষড়যন্ত্রকারী বলে ঘোষণা দেন। সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই)-এর তদন্তে বেরিয়ে আসে যে এটা পুরোটাই ছিল একটা সাজানো নাটক। অভিযুক্ত চারজনকে তুলে নিয়ে গিয়ে পুলিশের হেফাজতে হত্যা করা হয়েছিল, যেখানে অস্ত্র-টস্ত্র সবই রাখা হয়েছিল সাজানো নাটকের অংশ হিসেবে। রাজ্য সরকার এ হত্যাকাণ্ডে মোদির জড়িত থাকার বিষয়টি একেবারে অগ্রাহ্য করে। তাঁকে এই ঘটনার সাথে জড়িত কোনো বিষয়ে কখনোই অভিযুক্ত করা হয়নি।

২০১০ সালে, মোদির ডান হাত হিসেবে পরিচিত, গুজরাটের হোম মিনিস্টার অমিত শাহকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। তার বিরুদ্ধে সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই) হত্যা, ষড়যন্ত্র, অপহরণ ও দখলবাজির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এনেছিল। এবারের নির্বাচনের প্রচার প্রচারণার সময় সে মোদির পক্ষে প্রচারণা চালাতে গিয়ে নানারকম জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়েছেন। যেমন ধরুন— ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রতিশোধ নেয়া হবে, বা যেসব দলে মুসলমান প্রার্থী আছে তাদেরকে প্রত্যাখান করার আহ্বান জানিয়েছেন। এসব মন্তব্যের কারণে নির্বাচন কমিশন তার র‌্যালি সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। অবশ্য যথেষ্ট প্রমাণের অভাবে পরে এ আদেশ প্রত্যাহার করা হয়।

তবে শুধুমাত্র অমিত শাহই এমন বিতর্কিত প্রচার প্রচারণার লোক নন। বিজেপির অন্যতম শীর্ষ নেতা, গিরিরাজ সিং বলেন, মোদির সমালোচকদের স্থান পাকিস্তানে, ইনডিয়ায় নয়। আরেক নেতা, বিজেপির অঙ্গসংগঠন ভিএইচপি-র সভাপতি প্রবীণ তোগাদিয়া বলেন, হিন্দুদের এলাকা থেকে মুসলমানদের বাড়িঘর উচ্ছেদ করা উচিত।

মোদি অবশ্য এরকম কিছু বলেননি। তিনি শুধু সুশাসনের ওপর জোর দিয়েছেন। তবে গুজরাটে তার শাসনের ইতিহাসও একদম সাফ নয়।

লোকে যখন দাবি করে যে মোদি সরকারের সময়ে গুজরাটের অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটেছে, তখন কিন্তু তারা আসলে অন্য রাজ্যগুলোকে বাদ দিয়েই বলে। ২০০০ সাল থেকে এ দশক পর্যন্ত গুজরাটের চেয়ে বিহারের জিডিপি বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। গত তিন দশক ধরে অন্যান্য প্রদেশ— যেমন হরিয়ানা, পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্র এসব রাজ্যের গড় আয় গুজরাটের চেয়ে বেশি। ১৯৯০ সালে উদারনীতি গ্রহণের পর থেকে গুজরাট নিঃসন্দেহে ভালো করেছে। তবে একই কথা মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, কেরালা, বিহার, তামিল নাড়ু এসব রাজ্যের ক্ষেত্রেও সমান প্রযোজ্য। তবে কেন সব কৃতিত্ব মোদি একাই পাবেন? মোদি একাই কৃতিত্ব পাবার মত এমন কি করেছেন কিংবা কেন অন্য রাজ্য বাদ দিয়ে গুজরাটের কথাই বলতে হবে— এসব বিষয় কিন্তু কেউ বলেন না।

এদিকে, ২০১০ সালে গুজরাটকে সবচেয়ে দূষিত শহর হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর তিনটি নদীকে ভারতের সবচেয়ে দূষিত তিনটি নদী হিসেবে ধরা হয়। তার ওপর স্বজনপ্রীতি পুঁজিবাদের অভিযোগ তো আছেই! শোনা যায়, মোদি তার সহযোগীদের কাছে পানির দামে বিভিন্ন চুক্তি পাইয়ে দেয়ার কারণে ভারত সরকারের অনেক চুক্তি হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল।

তার লিবারাল সমর্থকরা হয়ত নিজেদেরকে প্রবোধ দিয়েছেন এই ভেবে যে, ভারতের লিবারাল, সেক্যুলার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে হুমকির মুখে ফেলার ক্ষমতা মোদির নেই, তবে অসাধারণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটানোর ক্ষমতা তার আছে। তিনি ক্ষুদ্র গুজরাটকে যে বিরাট পাওয়ার হাউজে পরিণত করেছেন সেটা তারা মনে রাখছেন, কিন্তু তাঁর চোখের সামনে যে বিরাট দাঙ্গা হয়েছিল সেটা তারা বেমালুম ভুলে গেছেন।

তবে আরো বড় প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে বিষয়টা দাঁড়ায় এই যে, ভারত এখন সেইসব হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের মুঠোয় যারা জোর করে বই নিষিদ্ধ করে, সাংবাদিকদের ভয় দেখায় এবং তাদের নেতার সমালোচনা করার কারণে লোকজনকে হুমকি দেয়। এসব হিন্দু জাতীয়তাবাদের অসহিষ্ঞুতার জোয়ার এখন সারা ভারত জুড়ে দেখা যাচ্ছে। মোদী সবসময়ই ডানপন্থী সংগঠন ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ’ (আরএসএস নামে পরিচিত) এর সদস্য এবং কট্টর সমর্থক। এ সংগঠনটির লক্ষ্য সমগ্র ভারতকে এক হিন্দু জাতিতে পরিণত করা এবং তাদের মর্জিই অন্য ধর্মের লোকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া।

মোদির সরকার পরিচালনার ধরণ বদলানোর সম্ভাবনা খুব কম। পরিবর্তনকে স্বাগত জানানোর চাইতে এটিই বরং সবচেয়ে দুশ্চিন্তার বিষয়।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।