ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

যে জাতি ফর্মালিনের ফাঁদে

ড. খুরশীদ জাহান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৫ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০১৪
যে জাতি ফর্মালিনের ফাঁদে

আমাদের দেশের জনসংখ্যার বিরাট একটি অংশ অপুষ্টির শিকার। বলা যায়, শতকরা ৪০ ভাগ শিশু অপুষ্টির শিকার, একই সঙ্গে মায়েরাও।

এর ফলে দেখা যাচ্ছে, তাদের নতুন যে বংশধর, তারা অপুষ্টি নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে। কেননা, মায়ের অপুষ্টির কারণে তার পেটে যে শিশুটি আছে, সেও পর্যাপ্ত পুষ্টি পাচ্ছে না। জন্মগ্রহণ করা শিশুটি পরিপূর্ণ শিশু হিসেবে জন্ম নিচ্ছে না। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। তার বেড়ে ওঠা, বড় হওয়া অর্থাৎ জীবনকালে সে যখন ভেজাল খাবে, তার মধ্যে যে পুষ্টির অপূর্ণতা ছিল, তার ফল তাকে নানাভাবে ভোগ করতে হবে। এমনকী এর পরের বংশধর এবং তার পরের জনরাও এর শিকার হতে পারে।

অপুষ্টির শিকার হওয়ার নানা কারণ আছে; যেমন, দারিদ্রতা, খাদ্যের স্বল্পতা, কম ক্রয়ক্ষমতা ইত্যাদি। ‘মেল ডিস্ট্রিভিশন অব ফুড’ যেখানে দেখা যাচ্ছে, মায়েরা খাচ্ছে কম, লিস্ট অ্যাট লাস্ট, যা অবশিষ্ট থাকে। এছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ  বিষয় হলো, অনিরাপদ খাবার পানি। পানি এক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আমরা যদি নিরাপদ খাবার না পাই, সেক্ষেত্রে প্রচুর খাবার থাকা সত্ত্বেও আমরা ঝুঁকিমুক্ত নই। যতক্ষণ পর্যন্ত আমার খাবারটা নিরাপদ না হবে, তা পুষ্টিগত দিক থেকে হোক বা অন্যদিক থেকেই হোক।

এখন কথা হলো, নিরাপদ খাবার বলতে আমরা কী বুঝি। নিরাপদ খারার বলতে আমরা সেই খাবারটাকেই বুঝি, যে খাবার কোন রোগজীবাণু দ্বারা দুষ্ট নয়, কোন ক্ষতিকারক কেমিক্যাল দ্বারা প্রভাবিত নয়, তেমন খাবারকে আমরা নিরাপদ খাবার বলব। এরকম খাবারই ভারসাম্যপূর্ণ খাবার।

বর্তমানে অনিরাপদ খাবারের বিষয়টি আমাদের সামনে বিরাট এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ব্যাপ্তি অনেক দূর পর্যন্ত। যেমন— কেমিক্যালের ব্যবহার। আমরা কী ধরনের কেমিক্যাল দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি, তার উৎস কোথায়— এসবের খোঁজ বিরাট এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কৃষিজমিতে বা চাষাবাদের সময় নানারকম রাসায়নিক বা কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। এর ফলে জনস্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ফসলে কীটনাশকের মাত্রারিক্ত ব্যবহারের ফলে প্রকৃতির অতি উপকারী প্যারাসইড; যেমন, ব্যাঙ, সাপ, পাখি, সরীসৃপ ইত্যাদি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে প্রকৃতির ভারসাম্য। ফলে দেখা যায়, খাবার উৎপাদনের সময়ই নানা ধরনের ক্ষতিকারণ কেমিক্যাল তাতে ঢুকে যাচ্ছে। নাইট্রেট, জিংক বা ফসফরাসের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া জিংক অক্সিসালফেটে রয়েছে ক্যাডমিয়ার এবং সীসা। এসব ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ নানাভাবে আমাদের দেহে প্রবেশ করছে। এসব শাক-সবজি বা ফলমূল চলে যায় পাইকারি বাজারে। সেখানেও ব্যবসায়ীরা খাবারকে দীর্ঘস্থায়িত্ব দিতে ফর্মালিনসহ নানা ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করে থাকে। সেখান থেকে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে আসা খাদ্যদ্রব্যে, ফলমূলে কেমিক্যাল ব্যবহার করে। উদ্দেশ্য, দীর্ঘদিন যাতে তা নষ্ট না হয়।

মাছে কেমিক্যাল ব্যবহার করছি, ফল বা শাকসবজিতে ফর্মালিন ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি একটি মারাত্মক অপরাধ। কেননা এটি আমাদের দেহের নানা ক্ষতির কারণ হিসেবে বিবেচিত। মূলত খাবার দীর্ঘক্ষণ তরতাজা রাখার জন্য ফর্মালিন ব্যবহার করছে ব্যবসায়ীরা। বিপজ্জক হয়ে ওঠা এসব খাবার আমাদের শরীরে যাচ্ছে এবং এগুলোর ফলে পড়ছে কিছু স্বল্পকালীন প্রভাব, কিছু  দীর্ঘকালীন।

সারাবছর তো আছেই, তবে বিশেষত ফলের এই মৌসুমের সময়টায় কেমিক্যালের ব্যবহার বেড়ে যায়। আমরা বাঙালিরা মৌসুমি ফল খেতে খুব পছন্দ করি। তাছাড়া পুষ্টির ক্ষেত্রে বলা হয়, ব্যালেন্স ফুড তখনই হবে, যখন আপনি প্রতিদিন একটি করে ফল খাবেন। ফলগুলো থেকে, শাকসবজি থেকেই আমরা মাইক্রো নিউট্রেন পাই। আমাদের পুষ্টির শতকরা ৮০ ভাগ আসে এসব উপাদান কতৃক। চাল, ফলমূল, শাকসবজি এসব আমাদের পুষ্টির অন্যতম যোগানদাতা। কিন্তু এসব খাবারই যদি ক্ষতিকারণ কেমিক্যাল দ্বারা বিষাক্ত করে ফেলা হচ্ছে।

এখান দেখা যাক, আসলে ফর্মালিনটা কী? ফরমালডিহাইডের (রাসায়নিক সংকেত HCHO) ৩৭ থেকে ৪০ শতাংশ জলীয় দ্রবণই হলো ফরমালিন। ফরমালডিহাইড ছাড়াও ফরমালিনে থাকে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মিথানলের মিশ্রত । ফরমালিন অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল বা সংক্রামক ব্যাধি নাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আমরা যখন ঢাকা মেডিক্যাল পড়তাম, তখন বডিকে ফর্মালিনের ট্যাঙ্কে ডুবিয়ে রাখতাম, যাতে তা সতেজ থাকে, সহজে নষ্ট না হয়। ফলে দেখা যাচ্ছে যে, মৃত মানুষকে সতেজ রাখার জন্য ফর্মালিন ব্যবহার করা হয়। অনেক মেডিক্যাল কলেজ আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের ল্যাবে পশু-পাখিকে সতেজ রাখার জন্য ফর্মালিন ব্যবহার করা হয়। অনেক শিল্প-কারখানায়ও ব্যবহার করা হয়। এটা জীবাণুনাশক একটা কেমিক্যাল। শিল্প-কলকারখানা জীবাণুমুক্ত রাখতে তা ব্যবহার করা হয়।

কিন্তু এই ফর্মালিনটা যদি আমরা খাবারে দিই, তাহলে কী কী ক্ষতির সন্মুখীন হব। যদি আমরা মাছ ফর্মালিন মিশানো পানিতে ছুবিয়ে রাখি, তাহলে দেখা যাবে এর অনেকটাই মাছের আঁশে ঢুকে যাচ্ছে। এর ফলে এই মাছ খেয়ে মানুষের হাইপার এসিডিটি বেড়ে যায়। শর্টটাইমে বড়দের ক্ষেত্রে এটা হয়তো ঘটে। অন্যদিকে শিশুদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ফর্মালিন বেশি থাকায় ওরা খাবার খেয়ে অনেকক্ষেত্রে বমি করে দেয়। অনেক সময় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। আসলে তাদের শরীর এ বিষ নিতে পারে না। তাছাড়া দীর্ঘকাল সময় বিবেচনা করলে দেখা যায়, এটা আমাদের রক্তের সঙ্গে কিডনি বা লিবারে চলে যায়। এর ফলে লিভার ডিসিজের প্রবণতা আগের থেকে বেড়ে গেছে, ক্যান্সারের প্রবণতাও আগের থেকে অনেক বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এগুলোর জন্য এসব ক্ষতিকারণ কেমিক্যাল দায়ী অনেক ক্ষেত্রে। আরও ভয়াবহ হলো, গর্ভকালীন সময়ে মায়েদের যে জরায়ু তাও এর শিকার হতে পারে। মায়েদের জরায়ুর যে বেরিয়ার রয়েছে, যা শিশুকে অনেকরকম জীবাণু থেকে রক্ষা করে। এসব কেমিক্যাল সে বেরিয়ার নষ্ট করে দেয়। তাছাড়া মায়েদের দুধেও এর প্রভাব পড়ে। এভাবে বংশপরম্পরায় প্রভাব পড়ে।  

এটা গেল ফর্মালিনের কথা, আরেকটা হলো ক্যালসিয়াম কার্বাইড। ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করা হয় ফল পাকানোর জন্য। এর ফলে কাঁচা ফলটাকে, যা এখনও অপোক্ত, তাকে পাকানো হচ্ছে। এতে ফলের রঙের পরিবর্তন হয় এবং ফলটি নরমালি পোক্ত হলে যেসব উপাদান থাকার কথা,তার কিছুই তেমন থাকে না। এদিকে কার্বাইড ব্যবহার করে ফলটি পাকানো হচ্ছে, অন্যদিকে তা দীর্ঘস্থায়ী করতে দেয়া হচ্ছে ফর্মালিন। এতে স্বাভাবিক স্বাদ এবং গুণ সবই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে কেমিক্যালের প্রভাবে স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়।

এখন কথা হলো, আমরা যদি এটাকে প্রতিরোধ করতে না পারি, তাহলে অপুষ্টিতে যতো শিশু মারা যাচ্ছে, ক্ষুধার্ত অবস্থায় যতো শিশু মারা যাচ্ছে, বিষাক্ত বা ভেজাল খাবার খেয়ে হয়তো তার থেকে বেশি মারা যাবে। এক্ষেত্রে অপুষ্টি বা ক্ষুধার্ততার কারণে মারা যাওয়া শিশুদের পরিসংখ্যান থাকলেও ভেজাল বা বিষাক্ত খাবার খেয়ে মারা যাওয়া শিশুদের কোন পরিসংখ্যান নেই। এক্ষেত্রে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে, জনগণকে সচেতন করতে হবে। তারা ইতিমধ্যে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছেন, নানা জায়গায় তল্লাসি চালাচ্ছেন, এটা অব্যাহত রাখতে হবে। আর যারা এর সঙ্গে যুক্ত, এমন ভয়াবহ অন্যায়ের অন্যায় করে যাচ্ছেন, তাদের নিজেদের কথাও ভাবা উচিত। তাদের এমন ভূমিকায় গোটা জাতি এক বিরাট স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে। ফলে তাদেরও এমন অন্যায় থেকে নিজেকে বিযুক্ত রাখতে হবে। তাহলেই এর থেকে পরিত্রাণ সম্ভব।

লেখক : অধ্যাপক, পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।