ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

সংসার ও সংসারী

প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৬ ঘণ্টা, আগস্ট ১, ২০১৪
সংসার ও সংসারী

‘সংসার’ একটি বহুল পরিচিত শব্দ। একজন মেয়ে বা ছেলে সাবালক-সাবালিকা হয়ে ওঠার সাথে সাথে সংসার সম্পর্কে মোটামোটিভাবে একটা ধারণা পেয়ে যায়।

আবার এই শব্দটি বিভিন্ন শব্দযোগে ও ব্যবহৃত হয়। এই যেমন জগৎ সংসার জীবন সংসার, ঘর সংসার ইত্যাদি। কিন্তু সংসার বলতে মানুষ স্বভাবত যা বোঝে তা হল একজন পুরুষ এবং একজন নারী পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়ে যখন একই ছাদের নিচে বসবাস করে তখন তাদের এই মিলনের নামই সংসার। যেখানে তাদের উপর ভর করে সন্তান সন্ততি, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, বিরহ, প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা ইত্যাদি থাকবে। পৃথিবীতে জন্ম নিলে সকল নারী-পুরুষ সংসারী হওয়ার অধিকার লাভ করে। তাই দেখা যায় অপরিণত বয়সেও অনেক ছেলে মেয়ে সংসার করছে। অন্ধ, খঞ্জ, বিকলাঙ্গ, ধনী-দরিদ্র, মূর্খ-জ্ঞানী, যোগ্য অযোগ্য সবাই সংসার করছে। এক সংসারে অতৃপ্ত অনেকের আবার একাধিক সংসার আছে। জীবনের প্রান্ত সীমানায় এসে আবার অনেকে নতুন করে সংসার গড়ে তুলছে।

 এক কথায় সংসার মানে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। বিভিন্ন প্রকারের বিবাহ হচ্ছে। এই যেমন একক বিবাহ, বহুবিবাহ, বাল্য বিবাহ। এই বিবাহসমূহ আবার বিভিন্নভাবে সম্পন্ন হচ্ছে। যেমন সামাজিক বিবাহ, ভালোবাসার বিবাহ, চুক্তিভিত্তিক বিবাহ এবং বর্তমান সময়ের বিবাহের জনপ্রিয় পদ্ধতি কোর্ট ম্যারেজ। কিছুদিন আগে পত্রিকায় দেখলাম এক ব্যক্তির চার কন্যা আছে। ওই চার কন্যা প্রথমে বিভিন্ন ছল চাতুরি ও ছলাকলার মাধ্যমে প্রথমে কোনো সহজ সরল ছেলেকে বশিভূত ও অনুগত করেন। তারপর সল্প সময়ের মধ্যে বিয়ের পিঁড়িতে বসান। এই সুযোগে বড় ধরনের কাবিননামা বাগিয়ে নেন। কিছুদিন যেতে না যেতেই বিবাহ বিচ্ছেদের টালবাহানা শুরু করেন এবং সীমিত সময়ের মধ্যে সংসার ভাঙ্গার কাজটা করে নেন। অতপর কাবিননামার টাকা আদায়। ফলাফলে সহজ সরল বর ফতুর হয়ে অচিরেই পথে নামেন। এই বিবাহ পদ্ধতির নাম আপাতত টেমপোরারি ম্যারেজ দেওয়া যায়। আগে দেখা যেত অশিক্ষিত কনের অশিক্ষিত বর। সময়ের বিবর্তনে এখন শিক্ষিত বরের শিক্ষিত কনে। ক্ষেত্র বিশেষে উচ্চ শিক্ষিত পাত্র পাত্রীর সংসার। আগেরকার সংসারী এবং আধুনিক সংসারীদের মধ্যে দূরত্ব কি ? কিছু পার্থক্য অবশ্যই আছে। আগে সংসার ছিল পুরুষ-কর্তা নির্ভর। স্ত্রী তার জীবনের মৌলিক সকল চাহিদা পূরণের জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে স্বামী-নির্ভর ছিল।

 তারা কোনো চাকরি বাকরি করত না। ঘররক্ষা অর্থাৎ রান্নাবান্না, ধোয়া মোছা, সন্তান জন্মদান, তাদের লালনপালন, স্বামী, শ্বশুর শাশুড়ির সেবা ইত্যাদি কাজগুলো করে দৈনন্দিন জীবন কাটাত। আধুনিক সংসারে স্বামী-স্ত্রী উভয়ে চাকরিজীবী। স্ত্রী মৌলিক চাহিদা পূরণে সব কিছুর জন্য তার স্বামীর উপর নির্ভরশীল নয়। চাকরিজীবী কনের পক্ষে সবসময় ঘরবাড়ি নিয়ে পড়ে থাকা সম্ভব নয়। চাকরিজীবী মার পক্ষে স্বামী, সন্তান নিয়ে ব্যস্ত থাকা সম্ভব নয়। আধুনিক সংসারে এমন ও অসংখ্য সন্তান আছে যারা টিউবের বাট শুষে গুরুর দুধ বা গুড়ো দুধ পান করে বড় হচ্ছে। ঘরের বুয়ার আদর স্নেহে লালিত পালিত হচ্ছে। আধুনিক পিতা মাতার আদর স্নেহ এবং মায়ের বুকের শালদুধ বঞ্চিত এসব হতভাগ্য সন্তান বড় হয়ে মায়ের চেয়ে ধাইমাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। দেওয়াটা স্বাভাবিক। ধান ভানতে শিবের গীত ধরব না। আমার এই প্রবন্ধ হল সংসার ও সংসারীকে কেন্দ্র করে। মানুষের সংসারকে চার ভাগ করে দেখানো যায়। ১) অসুর-অসুরীর সংসার ২) দেব-দেবীর সংসার ৩) অসুর-দেবীর সংসার ৪) দেব-অসুরীর সংসার। আগে থেকে বলে রাখছি যে এখানে দেব-দেবী ভাল অর্থে এবং অসুর-অসুরী মন্দ অর্থে ব্যবহুত হয়েছে।

অসুর-অসুরীর সংসার :
অ+সুর = অসুর। ‘অ’ উপসর্গ যোগে গঠিত ‘অসুর’ শব্দের অর্থ হল সুর নাই যার। সুর মানে সুন্দর, সুশৃংখল, সুবিন্যস্ত, সাজানো গোছানো, আকর্ষণীয় ইত্যাদি গুণাবলিকে ইঙ্গিত করে। মানুষের জীবনে যে সুরের কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে মানুষমাত্রেরই জীবনে শৃংখলা, নৈতিকতা, আদর্শ, ত্যাগ, সত্যবাদিতা, সত্যনিষ্ঠা উদার দৃষ্টিভঙ্গী থাকতে হবে। আমাদের সমাজ এবং দেশে আমরা প্রতিনিয়ত সংসার বাঁধন বাঁধতে দেখি। আবার বাঁধন ছিঁড়তে ও দেখি। বাংলাদেশের বিবাহ আইন অনুসারে ন্যূনতম ১৮ বছর বয়সী একজন মেয়ে এবং ২১ বছর বয়সী একজন পুরুষ সংসারী হতে পারে। তখন কঠিন এবং জটিল বিষয় হল সংসারী জুটির মধ্যে দুজনই সমমনা কিনা। দুইজনের পছন্দ-অপছন্দ, রুচি-অরুচি একই কিনা। কথায় আছে
‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে/যদি ভাল পতি এক থাকে তার সনে। ’

অর্থাৎ সংসারী অনেকে হয়। কিন্তু সুখী হয় কয়জনে ? এটাই সবচেয়ে জটিল বিষয়। যারা সুখী হয় না, তারা কেন সুখী হয় না ? স্বামী স্ত্রী দুজনেই নীতিভ্রষ্ট অর্থাৎ চরিত্রহীন। স্বামী নিজের স্ত্রীতে সন্তুষ্ট নয় পক্ষান্তরে স্ত্রী স্বীয় স্বামী নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। দুজনেই পরস্ত্রী বা পরস্বামীতে আসক্ত। এই ধরনের সংসারে শান্তির বসবাস সম্ভব নয়। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ঝগড়াটে। সামান্য অজুহাতে চড়াও হয়, ক্ষেপে যায়। কারো প্রতি কারো সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ নেই, একজন আরেকজনের সুখে সুখী, দুঃখে দুঃখী হওয়ার মত গুণ নেই। পরস্পরের মধ্যে প্রেম ভালোবাসা নেই। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘বিবাহিত জীবনে স্বামী স্ত্রীর প্রেম ভালোবাসা অবিবাহিত জীবনের ভালোবাসার চেয়ে ও অনেক দামী এবং খাঁটি।

এর কারণও অনেক। বর্তমানের অবিবাহিত জীবনের ভালবাসার কুপরিণতি সম্পর্কে কম বেশি সবাই জানেন। সেই তথাকথিত ভালবাসার পাত্ররা যতক্ষণ পর্যন্ত বা যতদিন পর্যন্ত ভালবাসার পাত্রীর চরিত্র হরণ করতে পারে না ততক্ষণ বা ততদিন পর্যন্ত ভালবাসা দেখায় গলায় গলায়। তাদের ভালবাসার পাত্রীরা ও এত ভালবাসতে জানে যে বিবাহের পূর্বে নিজের চরিত্র বা সম্ভ্রম পর্যন্ত বিলিয়ে দেবে। আর যখন প্রতারিত হবে তখন অভিভাবক, থানা, পুলিশ, কোর্ট, মিডিয়া সবাইকে জানাবে তাদের নগ্ন ভালবাসার কাহিনী। অথচ বিবাহিত জীবনে গৌণ হয়ে যায় ভালবাসার সম্পর্ক। স্বামী স্ত্রীর প্রতি স্ত্রী স্বামীর প্রতি রমিত হতে পারে না। অন্তর্জ্বালায় পুড়তে পুড়তে মনটা যখন কয়লায় পরিণত হয় তখন কথায় কথায় অহেতুক বাড়াবাড়ি, তর্কবিতর্ক, এমনকি তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ পর্যন্ত গড়ায়। একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে হামলা, মামলা, নালিশ, বিচার, সালিশ, মুচলেকা আরো কত কি। পারিবারিক জীবনে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সর্বদা ঝগড়াঝাটি, গালমন্দ, মারধর এই ধরনের সংসার হল অসুর-অসুরীর সংসার। এই ধরনের সংসারে কোনো দিন সুখ হয় না। শান্তি থাকে না। স্বামী স্ত্রী দুজনই খারাপ প্রকৃতির। তখন এদের সংসার হয় অসুর-অসুরীর সংসার।

দেব-দেবীর সংসার :
হিন্দু ও বৌদ্ধদর্শনে দেবদেবীর অস্তিত্ব নিয়ে অনেক ইতিকথা, বর্ণনা এবং কাহিনী দেখা যায়। হিন্দুধর্মে দেবদেবী পরম শ্রদ্ধায় পূজিত হয়। বৌদ্ধধর্মে ও দেখা যায় বুদ্ধের শাসন ধর্মপ্রচার ও প্রসারে দেবতার প্রভাব ও অবদান। যেমন কুমার সিদ্ধার্থ থেকে বুদ্ধত্ব প্রাপ্তি পর্যন্ত দেবতারা তাঁকে সর্বদা সহযোগিতা করেছেন। হিন্দু ও বৌদ্ধদের ধর্ম-দর্শনে দেবলোকের বর্ণনা আছে। তবে এ প্রবন্ধে দেব-দেবী বলতে চরিত্রবান ভাল নর-নারীকে বোঝানো হয়েছে। ধর্মে মানুষকে দেবদেবীর উর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়েছে। কারণ মানুষ স্বীয় সুকর্ম, প্রচেষ্টা, ত্যাগ এবং সাধনা বলে দেবতাকে অতিক্রম করতে পারে। যেমন দেবতা বুদ্ধ হতে পারে না; বুদ্ধ হয় কেবল মানবপুত্র। মানুষ ইহজীবনের মহৎ কর্মগুণে পরকালে স্বর্গলোকে উৎপন্ন হয়। বৌদ্ধ ধর্মে ছয়টি স্বর্গলোক বা দেবলোক এবং বিশটি ব্রহ্মলোকের বর্ণনা দেখা যায়। ইহজীবনে একজন ব্যক্তি যখন চরিত্র সম্বলিত, নীতিময়, আদর্শময় সৎ জীবন যাপন করেন তখন অনেকের দৃষ্টিতে তিনি দেবতার মত লোক। সবাই তাকে শ্রদ্ধা ও সম্মানের দৃষ্টিতে দেখেন। বৌদ্ধ এবং হিন্দুধর্ম মতে মানুষ যখন ভাল কাজ করেন দেবতারা তাকে সাহায্য করেন। ভাল আদর্শবান দেব চরিত্রের কোনো ব্যক্তি যখন বিপদে পড়েন দেবতা তখন তার সহায় হন, তাকে রক্ষা করেন। সংসারে অর্থাৎ পারিবারিক জীবনে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই যখন চরিত্র সম্পন্ন, সৎ ও আদর্শময় জীবন যাপন করেন তখন স্বামী হয় দেবতুল্য এবং স্ত্রী হয় দেবীতুল্য।

তাদের জীবনে আসে সুখ আর সুখ। তাদের পরিবারে আসবে দেবপুত্র দেবকন্যার মত সদাচারী পুত্র-কন্যা। তাদের বুক গর্বে ভরিয়ে দেবে। জগৎজোড়া খ্যাতি বয়ে আনবে। সেই সকল সন্তান কখনো পিতামাতার মানহানি করে না; অপিচ মান বাড়ায়। সেই দেবদেবী পিতামাতা কেবল মোহাবিষ্ট হয়ে সন্তান জন্ম দেন না, তাদের সন্তান সন্ততি জন্মদানের পেছনে কিছু কামনা, প্রার্থনা, আদর্শ উদ্দেশ্য থাকবে। যেমন জ্ঞানী পিতামাতা কিছু বিষয় মাথায় রেখে সন্তানের জন্ম দেন। তাদের কামনা এবং বিশ্বাস হল, তাদের সন্তান তাদের বংশধর রক্ষা করবে, বংশে প্রদীপ জ্বালাবে অর্থাৎ বংশকে গর্বিত করবে, বৃদ্ধ বয়সে তাদের ভরণপোষণ সেবা সৎকার করবে, তাদের সহায় সম্পত্তি রক্ষা করবে, তাদের মৃত্যুর পর তাদের সদগতি কামনায় শ্রাদ্ধক্রিয়া পালন করবে। এসব বিষয়াদি যখন মাথায় রেখে পিতামাতা সন্তানের জন্ম দেন তখন তারা সন্তানের জন্মের পর থেকে সন্তানকে যোগ্য করে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। তাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ জীবন সর্ম্পকে ভাবেন। ফলে পিতামাতা পুত্র-কন্যা সবাই সৎ ও আদর্শময় জীবন যাপন করেন। এই ধরনের পিতামাতার সংসার হল দেবদেবীর সংসার।

দেব-অসুরীর সংসার:
সমাজ ও দেশে এমন কিছু পরিবার দেখা যায় যাদের সংসারে স্বামী সৎ চরিত্রের এবং আদর্শবান। ধর্মে-কর্মে নীতি-আদর্শে দেবতার মত জীবন যাপন করেন। স্ত্রী, পুত্র, কন্যা পরিবার পরিজনের ভরণপোষণ করেন। দায়িত্বশীল জীবন যাপন করেন। পিতামাতর সেবা করেন, জ্ঞাতিবর্গের দেখাশুনা করেন, পরোপকারী জীবন যাপন করেন। কিন্তু স্ত্রীর এসব কিছু পছন্দ নয়। সবসময় কোনো না কোনো ত্রুটি বের করে পরিবারে কলহ করে, অশান্তি সৃষ্টি করে, স্বামীর অমর্যাদা করে, স্বামীকে শারীরিক, মানসিক এবং বাচনিকভাবে অহেতুক নির্যাতন করে, স্বামীর পরিশ্রমলব্দ সম্পত্তি ভোগ করবে, আহার ভক্ষণ করবে, সাজগোছ নেবে আরাম আয়েশ করবে, নিজের আশা আকাঙ্খা পূর্ণ করবে, নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করবে স্বামীকে খাটো করে, চাল চলন, বেশভুষা ধারণ, জীবন যাত্রায় স্বামীর কোনো শাসন মেনে চলবে না, পরকীয়ায় আসক্ত, পরপুরুষে রমিত সেই প্রকৃতির স্ত্রীকে নিয়ে একজন পুরুষ কখনো সুখী হতে পারে না। তাদের সংসারে ষোল আনা শান্তি থাকে না। ছেলেমেয়ে কিছুটা মায়ের চরিত্রের কিছুটা পিতার চরিত্রের হয়। পরিবারে একই ছাদের নিচে থাকে কিন্তু চলে যার যার নিয়মে। নিজেদের মধ্যে দলাদলি, পুত্রশক্তি দিয়ে পিতাকে শাসন, শোষণ ও নির্যাতন করবে, স্বামীর কাছ থেকে সেবা সুযোগ নিয়ে দুঃখের বেলায় স্বামীর পাশে থাকবে না, স্বামীকে অবজ্ঞা, অবহেলা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবে এই ধরনের স্ত্রী হচ্ছে অসুরী স্বভাবের। এই ধরণের স্ত্রী নিয়ে যে সকল দেবতুল্য পুরুষ সংসার করেন সংসারে আছেন তাদের সংসার হল দেব-অসুরীর সংসার।


অসুর-দেবীর সংসার :
স্বামী ভক্ত এক স্ত্রী। খুব ভালবাসেন স্বামীকে। স্বামীকে দেবতা মানেন। স্বামীর সুখে সুখী, স্বামীর দুঃখে দুঃখী হন। পুষ্টিকর খাবার, পছন্দের অলংকার, প্রসাধন সামগ্রী না পেলেও স্বামীর প্রতি অভিযোগ নেই, না পাওয়ার কষ্ট নেই। খেয়ে না খেয়ে স্বামীর ঘরে পড়ে থাকেন। বুকের কষ্ট বুকে চেপে রেখে স্বামীকে সবার কাছে বড় করে রাখতে চান। পতিব্রতা স্ত্রী। কিন্তু স্বামী তার বিপরীত প্রকৃতির। কারণে-অকারণে, কিবা রাত্রি কিবা দিন কেবল স্ত্রীর উপর নির্যাতন, অবিচার করে। কথায় কথায় মারধর গালিগালাজ করে। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বে ও স্ত্রীকে খাবার, ভরণপোষন, অলংকার, প্রসাধন দেয় না, সম্মান দিয়ে কথা বলে না, মাতাল উদ্মাদগ্রস্ত জীবন যাপন করে, পারিবারিক দায়দায়িত্ব বোঝে না, পুত্র-কন্যার প্রতি সদয় নয়, যতœশীল নয়, স্ত্রীর ভালবাসার মর্যাদা দিতে জানে না, নিজের স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও পর স্ত্রী বা রমণীর প্রতি আসক্ত, নারীলোভী চরিত্রের পুরুষ সে স্বামী বটে, তবে অসুর স্বামী হয়। এই ধরনের স্বামী নিয়ে যেসকল দেবীতুল্য নারী সংসার ধর্ম পালন করছেন, তাদের সংসার হল অসুর-দেবীর সংসার। বর্তমান দেশ তথা বিশ্বের প্রেক্ষাপটে উপরোক্ত তিন শ্রেণির সংসারের সংখ্যাই বেশি। সবচেয়ে দুর্লভ এবং কম সংখ্যক সংসার হচ্ছে দেব-দেবীর সংসার। তাই ঘর বাঁধতে গেলে একজন পুরুষ বা নারী সে স্বামী বা স্ত্রী হিসেবে কতটুকু ভাল হবে যোগ্য হবে তা বিভিন্ন ভাবে খতিয়ে দেখা হয়। এরপরে ও কিন্তু মানুষ ঐ ধরনের জীবনসঙ্গীই বেশি পায়। জীবন তো এমনিতেই দুঃখময়; তার উপরে এই ধরণের স্বামী-স্ত্রীর জীবন আরো দুঃখময়, জ্বালাময় এবং বিষাদময় হয়ে ওঠে। কত উৎসবমূখর পরিবেশে ঢাকঢোল পিটিয়ে বিবাহের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়। পরক্ষণে সেই বিবাহের পাত্র-পাত্রী একই ছাদের নিচে বিনা উৎকন্ঠায় থাকতে পারে না, তাদের বিয়ে হয় কিন্তু ঘর সংসার হয় না, সন্তান সন্ততি হয় কিন্ত পরিবার হয় না।

একে অপরের প্রতি কত অবজ্ঞা, অবহেলা, অসম্মান, অপমান, অমর্যাদা। একে অপরের বিরুদ্ধে কত অভিযোগ, নালিশ, এমনকি একজন আরেকজনকে খুন পর্যন্ত করছে। এক স্বামী তার স্ত্রীকে হত্যা করার পর নিজ হাতে চার টুকরা করেছে। দুই টুকরা ফ্রিজে রেখে বাকি দুই টুকরো দাফন করার জন্য প্যাকিং করে নিয়ে যাওয়ার পথে ধরা পড়েছে। আরেক স্বামী যৌতুকের জন্য জোর করে নিজের স্ত্রীর কিডনি বিক্রি করে দিয়েছে। আরেক স্বামী টাকা কামাই করে অর্থশালী হওয়ার জন্য নিজের স্ত্রীকে পতিতা বানিয়েছে। আরেক স্বামী পরকীয়ায় পড়ে নিজের স্ত্রীর গলা কেটে পানির ট্যাংকে ঢুকিয়ে রেখেছে। আরেক স্বামী নিজের স্ত্রীকে গায়ে কেরোসিন ঢেলে দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে। আরেক স্বামী স্ত্রীকে এসিড মেরে পুরো শরীর ঝলসে দিয়েছে। আবার এক স্ত্রী প্রথমে তার স্বামীকে কৌশলে হত্যা করেছে। তারপর নিজ হাতে কুচি কুচি করে একশত টুকরা করেছে। সবশেষে গরম পানিতে সিদ্ধ করে ফেলেছে। আরেক স্ত্রী স্বামীকে ঘুমন্ত অবস্থায় এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করেছে। আরেক স্ত্রী তার স্বামীকে খাবারে বিষ খাইয়ে মেরেছে।

 আরেক স্ত্রী পরকীয়ায় পড়ে নিজ স্বামীকে খুন করিয়ে পরে পরকীয়া প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যায়। এই রকম আরো অসংখ্য ঘটনার নজির আছে। এ সময়ের অধিকাংশ স্বামী-স্ত্রী গর্ব করে বলতে পারে না যে তারা পারিবারিকভাবে শতভাগ সুখী। এরপরে ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যুগে যুগে ঘর সংসারেই পড়ে থাকবেন। জৈবিক চাহিদা পূরণে, বিয়ে, আমোদ প্রমোদ, কামনা বাসনা এগুলোকেই বড় করে দেখবেন। সংসার লোভ, দ্বেষ, মোহ, কামনা-বাসনাপূর্ণ স্থান হলে ও পর এখান থেকেই মানুষকে তার পর জীবনের ঠিকানা কিংবা গন্তব্য নির্ধারণ করে নিতে হয়। এটা শ্রেষ্ঠ সাধনভ’মি। ঘর-সংসার করে ও স্বর্গবাসী হওয়া যায়। সংসার মোহের আগার সত্য কিন্ত পাপের আগার নয়। স্বর্গ-মর্ত্যে যত জীবন আছে, সবার চেয়ে উন্নত জীবন হল মনুষ্যজীবন। এই জীবন হিংসা, হানাহানি, রক্তারক্তি, পাপাচার, অনাচার করার জন্য নয়, এই জীবন দেবতা, ফেরেস্তা সবাইকে ছাড়িয়ে যাবার জীবন। এই জীবন হাসতে হাসতে স্বর্গারোহণ করার জীবন।  

প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু,
কেন্দ্রীয় সীমা বিহার
রামু, কক্সবাজার।
progyananda@gmail.com

বাংলাদেশ সময়: ১৩২৫ ঘণ্টা, আগস্ট ০১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।