ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

বাংলাদেশে সরকারি অর্থায়ন ও নগর উন্নয়ন ।। ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

... | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৯ ঘণ্টা, আগস্ট ২, ২০১৪
বাংলাদেশে সরকারি অর্থায়ন ও নগর উন্নয়ন ।। ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

নগর, নগরায়ণের চরিত্র, আমাদের নগরমুখিতা, এর বিস্তার, পরিকল্পনা, নগর বিস্তারে বিনিয়োগ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে এই বিশেষ রচনা

কিস্তি ২ পড়তে ক্লিক করুন


কিস্তি ৩


নগরের স্থানীয় সরকার, পৌরসভা এবং সিটি কর্পোরেশনে গোটা দেশের অনুপাতে জনপ্রতিনিধিত্ব মাত্র ২৮ শতাংশ। অথচ স্থানীয় সরকারের মোট ব্যয়ের প্রায় ৫৯ শতাংশই করা হয় এসবের পেছনে।



সব সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার কর নির্ধারণ, কর আদায়, বাজেট ও সরকারি মঞ্জুরি বিষয়ক তথ্য পাওয়া খুবই দুষ্কর। যে কারণে একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরতে শতাংশ ও অনুপাতের মত বিষয়গুলোর পরিসংখ্যানগত সূচক তৈরি করে হিসাব করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। নিচে কিছু চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তা থেকেই বুঝা যেতে পারে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোর কী পরিমাণ সীমিত তথ্য রয়েছে।

এক.
ঘরবাড়ির কর আদায় ও সরকারি মঞ্জুরি পাওয়ার জন্য সিটি করপোরেশনগুলোই প্রধান। পৌরসভার চেয়ে তুলনামূলকভাবে সিটি করপোরেশনগুলোর বাজেটের পরিমাণ অনেক বেশি। (এমনকি দেশের সব পৌরসভার যে পরিমাণ বাজেট হয় তার চেয়েও সিটি করপোরেশনগুলোর মোট বাজেট অনেক বেশি। )
  
দুই. 
পৌরসভাগুলোর মধ্যেও বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে  (ক, খ, গ) ব্যাপক তারতম্য রয়েছে। আকার এবং রাজস্ব আদায়ের সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে ক, খ, এবং গ- এ তিন ক্যাটাগরিতে পৌরসভাগুলোকে ভাগ করা হয়েছে। গ এর চাইতে খ ভালো, আবার খ এর চাইতে গ, ইত্যাদি।
 
তিন.
সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার এমন অনেকেই আছেন যারা বাসাবাড়ির কর নির্ধারণ বা মূল্যয়নও করতে পারে না। এতে করে তাদের দিক থেকে যথাযথ সক্ষমতা ও আন্তরিকতার ঘাটতি রয়েছে বলেই প্রমাণিত হয়। আরো মজার বিষয় হল, পুরাপুরি কর নির্ধারণ ও মূল্যায়ন না করেই তারা কর আদায় করছেন।  

চার.
প্রায় সব সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার বাজেটে দেখা যায়, সরকার থেকে পাওয়া মঞ্জুরি ও কর আদায়ের বিষয়টি বিবেচনা করার পরও কিছু একটা গ্যাপ রয়ে যায়। এই গ্যাপ থেকে বুঝা যায়, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোর এমন সব উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য রয়েছে, যেখানে আসলে আয়ের উৎসগুলো সচল রাখতে তাদের সক্ষমতা যে খুবই সীমিত তা পরিষ্কার বুঝা যায়।

সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার ব্যয় পরিকল্পনা ও রাজস্ব আদায়ে আরো বাস্তব ও বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গির জন্যই এসব কথা বলা হল।        
স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন ধরনের সার্বিক ব্যয়ের একটি খতিয়ানের দিকে নজর ফেরানো যাক। যেটি এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হতে পারে।

একটা মজার বিষয়, ২০০৬-০৭ এবং ২০০৭-০৮ বছরে স্বল্প জনপ্রতিনিধিত্বকারী সিটি কর্পোরেশনগুলোর পেছনে মোট ব্যয়ের পরিমাণ ছিল প্রায় ৪১.৭৭ এবং ২৮.৫৬ শতাংশ। একই সময়ে ২৮ শতাংশ জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী সিটি কর্পোরেশন আর পৌরসভার পেছনে ব্যয়ের হার ৫৮.৬৯ এবং ৪৭.৬৭ শতাংশ। আর এ সময়ে ইউনিয়ন পরিষদের পেছনে ব্যয় হয় মাত্র ১৬.৮৪ আর ২৩.৮০ শতাংশ।

৬. নগর এলাকার বিশেষ তহবিল
নগর এলাকার উন্নয়নে বিশেষ তহবিল গড়ে তুলে নিজস্ব আয় বাড়াতে বাংলাদেশে বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বেশ কিছু উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মিউনিসিপাল সার্ভিস প্রজেক্ট (এমএসপি) এবং বাংলাদেশ মিউনিসিপাল ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (বিএমডিএফ)। চাহিদার ভিত্তিতে নগর অবকাঠামো খাতে এমএসপি সফলভাবে ব্যাপক পরিমাণে আয় করতে সক্ষম হয়। এমএসপির বিনিয়োগ পৌরসভার কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। আবার তহবিল গঠনের জন্য যেসব প্রস্তাব দেয়া হয়, তাও অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে করা হয়নি। তবে পৌরসভাগুলোর ব্যয়ের ধরন যেভাবে এগিয়ে নেয়া হয়, তার মধ্যেই এমএসপি আয় বের করে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়।

অপরদিকে ২০০৪ সালের জুলাই থেকে ২০১১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ১২৯টি পৌরসভাকে ৩৯০৪ মিলিয়ন অর্থ দিয়েছে বিএমডিএফ। এর মধ্যে ৩৩১৮.৪ মিলয়ন টাকা মঞ্জুরি তহবিল এবং ৫৮৫.৬ মিলিয়ন টাকা ঋণ হিসেবে দেয়া হয়। এতে বিএমডিএফ জিওবি কিংবা অন্যান্য দাতা সংস্থাগুলোর সহায়তাও চায়নি।  



৭. নগর এলাকার নিজস্ব আয়ের উৎস সচল করা


সরকার প্রাকৃতিক সম্পদ ও আন্তর্জাতিক সহায়তার পরিবর্তে সরাসরি জনগণের প্রদেয় করের ওপর যেমন নির্ভরশীল তেমনি সরকারকে জনগণের কাছে আরো বেশি জবাবদিহি করতে হবে— ২০০৮ সালে এমনি যুক্তি দেয়া হয়েছিল। ২০০০ সাল থেকে জাতিসংঘ উন্নয়ন প্রকল্প ইউএনসিডিএফের আওতায় এই মডেল কার্যকর হয়ে আসছে বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি সদস্য দেশে।

স্থানীয় কর আরোপের প্রশ্নে তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক দিক থেকে বিতর্কও চলে আসছে। যদিও এখানে কিছু কার্যধারা মুলতবি রাখার প্রক্রিয়াও বিদ্যমান রয়েছে। যেখানে স্থানীয় কর আদায়ের উপযুক্ত উপায় রয়েছে সেখানে যুক্তি দেয়া হয় যে, স্থানীয় সরকারের বাজেটের জন্য স্থানীয় আয়ের উৎসের যৌক্তিক অবদান রাখতে এসব উপায় ভালভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।  

৩০টি পৌরসভা এবং ৬টি সিটি কর্পোরেশনে পরিচালিত জরিপে পৌরসভাগুলোতে রাজস্ব আয়ের পরিমাণ কম হলেও সিটি কর্পোরেশনের বেলায় ২০০৬/০৭ এবং ২০০৭/০৮ বছরে স্থানীয় ব্যয়ের ১৩ এবং ১৭ শতাংশ এসেছে এ খাত থেকে। পৌরসভার সবচেয়ে বড় বন্ধু সরকারি মঞ্জুরি। এ বরাদ্দ মঞ্জুর করা হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক উন্নয়ণ প্রকল্পের আওতায়।

বিগত ৬/৭ বছরে সিটি করপোরেশেন ও পৌরসভাগুলো আকারে আয়তনে বড় হলেও দেখা যায় এখনও একই কাতারে রয়েছে মঞ্জুরির পরিমাণ। পাশাপাশি এসব উন্নয়ন কার্যক্রমে বড় সহায়তা এসেছে সরকার এবং দাতা সংস্থার যৌথ উদ্যোগে গৃহীত কার্যক্রমে। ২০০৭/০৮ বছরে এর পরিমাণ ছিল মোট কার্যক্রমের ৫২ শতাংশ। তবে স্থানীয় কর আদায়ের ক্ষেত্রে পৌরসভার চেয়ে বিস্তর এগিয়ে রয়েছে সিটি কর্পোরেশন।

নগর স্থানীয় সরকার কর্তৃক পরিচালিত স্থানীয় সম্পদের বিস্তার দেখানো হয়েছে।



বাংলাদেশে সিটি কর্পোরেশন আর পৌরসভাগুলোর মধ্যে বিরাজ করছে বিস্তর ব্যবধান। তবে এটা পরিষ্কার, অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের স্থানীয় পর্যায়ে আয়ের পরিমাণ কম। এক হিসেবে ১৯৯৩ সাল এর পরিমাণ আফ্রিকাতে ছিল ১৫, এশিয়াতে ২৪৫ এবং শিল্পোন্নত দেশে ২৭৬৩।

চ্যালেঞ্জ ও শিক্ষা
৮.১. নগর সেবার জন্য উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশে নাটকীয়ভাবে ভৌগলিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো বদলে যাচ্ছ। অতিদ্রুত নগরায়ণের ফলেই এই পরিবর্তন ঘটছে। ফলে দেশে টেকসই নগর উন্নয়নের জন্য দ্রুত নগরায়ণ বড়রকমের চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে। নগর এলাকায় আইনশৃঙ্খলা থেকে শুরু করে পরিবেশ বিপর্যয় পর্যন্ত সবকিছুই অসংখ্য সমস্যায় পর্যদস্ত। অধিকাংশ নগরকেন্দ্র এ সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে থাকলেও ভয়াবহতার মাত্রা নির্ভর করে তার আকার ও আয়তনের ওপর।

জনস্বাস্থ্য, নিরাপত্তা এবং বিশেষ করে দারদ্র্যি ও ব্যবসায়িক উৎপাদন উভয় ক্ষেত্রে সরাসরি ও তাৎক্ষণিক গুরুতর ক্ষতি সাধন করে নগরের পরিবেশগত সমস্যাগুলো। পৌর এলাকায় এ ধরনের পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়টি নীতিনির্ধারকদেরই মাথাব্যথার কারণ। কেননা এ ধরনের সমস্যার কারণ— বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পয়ঃনিষ্কাশনের সংকট, বায়ূ দূষণ, নিরাপদ পানির অভাব, শব্দদূষণ, যানজট এবং অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা। এসব সমস্যাই মানসম্পন্ন জীবনের জন্য মারাত্মক হয়ে উঠছে।

নগরায়নের সুস্পষ্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হয় দেশের বড় বড় শহরে। ঢাকায় প্রতিদিন তৈরি হওয়া কঠিন বর্জ্যের পরিমাণ ৩০০০ থেকে ৩৫০০০ টনের মধ্যে ওঠানামা করছে এখন। এর মাত্র ৫০ ভাগ সংগ্রহ করার সামর্থ্য রাখে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন বা ডিসিসি। বাকিটা কোথায় যায়, তার খবর নাই কোনো। ফলত বিশেষ মৌসুমে রাস্তাঘাঁটে ও আশপাশে জলাবদ্ধতার দরুণ দিনের পর দিন চরম ভোগান্তির মধ্যে কাটাতে হয় মানুষকে। সামান্য পানির তোড়েই খোলা ড্রেন আটকে যায়। যাতে স্বাভাবিক ড্রেন ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এ সময় মৌসুমি বৃষ্টির কারণেও নগরের মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। এ অবস্থায় কঠিন হুমকির মধ্যে পড়ে যায় স্বাস্থ্যের গতিপ্রকৃতি।

এ পরিস্থিতির সঙ্গে রয়েছে পানি সরবরাহের বিস্তর সংকট। শহরের পানি সরবরাহ ব্যবস্থা মোটেও সন্তোষজনক নয়। এক কোটি তিরিশ লাখ মানুষের শহরে প্রতিদিন পানির চাহিদা দুই শ’ কোটি লিটারেরও বেশি। ২০০৪ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ওয়াসা প্রতিদিন সরবরাহ করে মাত্র দেড় শ’ কোটি লিটার। তাতে পূরণ হয় চাহিদার ৭৫ ভাগ। এতে পানির সুবিধা ভোগ করতে পারে অল্প কিছু লোক। জনগণের অবশিষ্ট অংশ প্রায় পুরোটাই বঞ্চিত পানি সুবিধা থেকে। অল্প আয়ের মানুষের বিপদ আরও বেশি। পৌরসভার পাইপে সরবরাহ করা পানি নিয়েও অভিযোগের অন্ত নেই। মোট পৌরসভার কেবল ৩৫ শতাংশের হাতে রয়েছে পানিসেবা প্রদানের সুযোগ। আবার, নগর এলাকায় গড়ে প্রতিটি পৌরসভার পানিসুবিধা ভোগ করে থাকে, ২০০৫ সালের হিসেবে, মাত্র ২৮.৮ শতাংশ মানুষ।
(ইংরেজি থেকে অনূদিত)







লেখক : সাবেক গর্ভনর, বাংলাদেশ ব্যাংক


বাংলাদেশ সময়: ১৩৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।