ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

বজলুর রহমান অসীম প্রাণমন লয়ে ।। মুহম্মদ সবুর

স্মরণ/মুক্তমত | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৮ ঘণ্টা, আগস্ট ৩, ২০১৪
বজলুর রহমান অসীম প্রাণমন লয়ে ।। মুহম্মদ সবুর জন্ম ৩ আগস্ট ১৯৪১, মৃত্যু ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৮

বড়ো বেশি বেদনার মতো বাজে বুকে। জাগে ব্যথিত ক্রন্দন।

অসহায়ত্ব এসে ধরা দেয়। শূন্যতা জাগায় চারিদিকে। এক ধরনের হাহাকার গ্রাস করে। বনে যদি ফুটলো কুসুম, নেই কেন সেই পাখি, সবই আছে, শুধু নেই তিনি। তার রোপিত চারাগাছ আজ মহীরুহ হয়ে সটান আছে; অথচ তিনি নেই। রোদন ভরা বসন্তের দিন পেছনে ফেলে রেখে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে চলে গেলেন তিনি নিধুয়া পাথার ছাড়িয়ে। রেখে গেছেন সুমহান কীর্তি। তিনি আমাদের বজলু ভাই, নির্ভীক সাংবাদিক বজলুর রহমান। না বলে বিদায় নিয়ে কোথায় চলে গেলেন-পশ্চাতে রেখে স্বজন অনুরাগীদের!

তার কাছে এলে পাওয়া যেত বৃক্ষের ছায়া, পুষ্পের ছোঁয়া, অপত্য স্নেহ মাখা হাসির ঝিলিকে প্রাণ হত চঞ্চল, কথার যাদুমালা নিবিষ্ট শ্রোতায় পরিণত করত, জীবনের নানা বিষয়ে পাওয়া যেত সুপরামর্শ, বন্ধুর মত বাড়িয়ে হাত পাড়ি দেয়া যেত সাঁকো কিংবা অভিভাবকত্বের অসীম স্নেহাবিষ্ট মুখ মিলত- সবই বুঝি আজ দেয়াল চিত্রে স্থির হয়ে গেছে। বাস্তবতায় আর কখনো ধরা পড়বে না। অথচ ছিলেন তিনি আমাদেরই লোক। ছিলেন তিনি আত্মার আত্মীয়, মনের আরাম, প্রাণের আনন্দ। আলোকের ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দিতে চাইতেন সব অন্ধকার, কুসংস্কার, নেতি আর অজ্ঞতা। সেই মানবের স্বপ্ন সাধনা ছিল সমাজ সংস্কার। পরিণত বয়সে এমন অভিভাবক, অগ্রজ বন্ধু বিয়োগের ব্যথা প্রশমিত হবার নয় কোনোভাবেই।

সুদর্শন, সুশোভন বজলুর রহমানকে যতবারই দেখেছি, ততবারই নতুন করে প্রাণ পেয়েছি। স্বপ্ন দেখার সিঁড়ি শুধু খোঁজা নয়, তা সত্যি করার নিরলস প্রয়াসও রেখেছেন সান্নিধ্যজনের জন্যও। সান্নিধ্য শুধু সুখ নয়, জ্ঞানের পরিধিও বাড়াত। সব বিষয়ে ধারণা রাখা বুঝি একা সাংবাদিকের কাজ, তাই জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত এমনটা নয়। আসলে ভেতরের তাগিদই তাঁকে নানা বৈচিত্র্যের ভেতর সমন্বয় সাধন করিয়েছে। শিশুদের জন্য সংগঠনও গড়েছেন যৌবনের উষ্ণীষ উড়িয়ে। রাজনীতিতেও ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। মুক্তিযুদ্ধেও অসীম সাহসিকতা দেখিয়েছেন। বের করেছেন পত্রিকা। সংগঠন করেছেন শান্তির জন্য। আড্ডা বা আলোচনায় নানা বিষয়েরা এসে জড়ো হত। নির্বাক শ্রোতাদের মনোযোগ তাঁকে ঘিরে। বিশ্বপাঠশালার ছাত্রের মত কত অজানাকে যে তুলে ধরতেন, কত অচেনাকে চিনিয়েছেন। অভিজ্ঞতালদ্ধ জীবনের বাঁকে বাঁকে তাঁর নানা ঘটনার সারি। বৈঠকি মেজাজেও সেসব জানা যেত ছিটেফোঁটা হলেও। শিক্ষকসুলভতায় নয় বন্ধুবৎসলতায় রেখেছেন নৈকট্যে; উদ্দীপ্ত করেছেন সৃষ্টিশীলতায় নিমগ্ন হতে।

বয়স কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি বলেই সান্নিধ্যে, নৈকট্যে যাবার ক্ষেত্রে সংকোচ বা জড়তা এসে ধরা দিত না। বন্ধুর মত, স্বজনের মত দ্রবীভূত করে দিতেন তরুণ, অতি তরুণকেও। তারুণ্যের আবেগকে কখনো দমাতে চান নি। বরঙ তাদের সান্নিধ্য পেতে কখনো বেগপেতে হত না। ব্যক্তি জীবনের সমস্যা অকপটে বলা যেত, মিলে যেত সমাধানও। সকল বর্ণ, ধর্ম, মত, পেশার মানুষের সঙ্গেই মিশেছেন অবলীলায়। মুক্তবুদ্ধির মানুষ বলেই মানুষ পেত মর্যাদা তাঁর কাছে। মনুষ্যত্বকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন। বলতেনও, সম্পূর্ণ মানুষ হতে পারার মধ্যে রয়েছে জীবনের সার্থকতা। কর্মের মধ্যে যে মানুষের মুক্তি নিহিত আছে, সেই উপলদ্ধিটুকুও তাঁরই সহজাত।
   
আনন্দালোক, মঙ্গলালোক ছেড়ে অসীমে চলে যাওয়া বজলুর রহমান মানব মঙ্গল আর হিতসাধনার ব্রত রেখে গেছেন। তাকে পরিপুষ্ট আর লালন করার দায়িত্ব বর্তায় গুণগ্রাহীদেরও। নির্ভীক সাংবাদিক বজলুর রহমান, আমাদের প্রাণাধিক বজলু ভাই, অমরত্বের সাধনা করেন নি। কিন্তু তাঁর জীবন কর্ম তাকে অমরত্বের পথেই নিয়ে গেছে। সময়ের সাহসী এই সন্তানের সান্নিধ্য প্রাপ্তি সাধারণ এই আমার জীবনে এক পরম পাওয়া। বিদগ্ধতায়  নিজেকে আড়াল না করার এই অগ্রজ বন্ধু বজলু ভাই এর স্মৃতি সততই সুখের। কিন্তু তাঁর অনুপস্থিতি বড় বেশি বেদনার, বিষাদের। এমনই মানুষ তিনি, সান্নিধ্য যাঁর কখনো পরিণত হয় নি বিষাদময়, অভিমন্যু, ভারবাহী। বরং ব্যস্ত মানবের সান্নিধ্যের সময়টুকু কেড়ে নেয়াও কম দুষ্কর ছিল না। তাঁর সান্নিধ্য, নৈকট্য এক গৌরবময় অধ্যায়, জীবনের পরমতম প্রাপ্তি। অভিভূত করে রেখেছিলেন যত দিন ছিলাম কাছে দূরে।
   
ইতিহাসের এই পরম পুরুষ সমকালে যেভাবেই মূল্যায়িত হোক না কেন, ভাবীকাল তাঁকে আরো মহিমান্বিত করবেই। বাস্তবতায় এক আদর্শবান, নির্লোভ, নির্মোহ, নিরহংকার মানব ছিলেন বজলুর রহমান। একুশের প্রথম কবিতার কবি প্রয়াত মাহবুব উল আলম চৌধুরী বজলুর রহমানের জীবন ও কর্মের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছিলেন, 'বজলুর রহমান নিজে একজন দক্ষ সংগঠক হওয়ার কারণে খেলাঘরকে প্রগতিশীল ধারায় নির্মাণ করেছেন। এই খেলাঘর বহুদিন যাবত নানা কর্মকাণ্ড, অনুষ্ঠান, আন্দোলন, মিছিলের মাধ্যমে হাজার হাজার দেশ প্রেমিক নাগরিকের জন্ম দিয়েছে। বজলুর রহমান অত্যন্ত প্রগতিশীল দৃষ্টির অধিকারী। জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এখনো স্বদেশ এবং দুনিয়াকে দেখেন। '

আমাদের বজলু ভাই, সংবাদপত্রে যিনি নিজেও কাজ করেছেন শুধু তাই নয় কাজ করেছেন অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব- আহমদুল কবির, খাইরুল কবির, জহুর হোসেন চৌধুরী, রণেশ দাশ গুপ্ত, শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সার, শহীদ সাবের, সত্যেন সেন, তোয়াব খানসহ আরো অনেকের সঙ্গে। রাজনীতিতেও পেয়েছিলেন ত্যাগী মানুষদের সংস্পর্শ। সেই বজলুর রহমান বলা নেই-কওয়া নেই চলে গেলেন দূর আকাশ পাড়ি দিয়ে। ভাবতেই বুকে পাথর নামে। সবকিছু ঝাপসা লাগে। এক নিমেষেই কত কাছের মানুষ কত দূরের হয়ে যায়।

বাঙ্গালীর জীবন যাপনের যে আবহ, বজলুর রহমান তাতেও ছিলেন একনিষ্ঠ। অতি নাগরিকতা তাঁকে টানে  বলেই চিরায়ত বাংলার রূপটুকু ধরে রাখতে চেয়েছেন সব সময়। গ্রামীণ জীবন সমাজ ও মানুষের প্রতি মমত্ববোধের তীব্রতা ধরা পড়ত তাঁর সম্পাদিত পত্রিকায়। সব মতামতকেই গুরুত্ব দিতেন। নিজস্ব মতামত কখনো চাপিয়ে দিতেন না। তবে তাঁর যুক্তি এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়াত যে, তাঁর মতামতটিই হত সঠিক। আধুনিক রুচিবান বিশুদ্ধ মানবের প্রতিকৃতি মিলত বুঝি তাঁরই মাঝে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের অর্থনীতির চৌকশ ও মেধাবী ছাত্রটি সাহসে ভর করে সাংবাদিকতার জগতে প্রবেশ করেছিলেন। প্রায় অর্ধশত বছরে নিজেই পরিণত হয়েছেন প্রতিষ্ঠানে। নিষ্ঠা তাঁকে  চূড়ান্তে পৌঁছিয়েছে। পড়াশোনার ব্যপ্তি ও জ্ঞানের পরিধি ছিল এমনই, যেকোনো বিষয় এসে যেত আলোচনায়। আর সেসব বিষয়ে জানার আগ্রহ অনায়াসে প্রশমিত করেছেন। নানা বিষয়ে আগ্রহ, দূরদর্শিতা এসবই অনুপ্রাণিত করত সান্নিধ্য জনকে। মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তা, মানবকল্যাণ ধারণ করে সম্পন্ন মানবে পরিণত বজলুর রহমান যে আলোক বর্তিকা জ্বালিয়ে গেছেন অবর্তমানে তাকে প্রোজ্জ্বলিত রাখার দুরূহ দায়িত্ব অবলীলায় বর্তে গেছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ।

কি চেয়েছিলেন বজলুর রহমান, কি স্বপ্ন তার ফুল হয়ে ফুটত- সবই উঠে আসত লেখায়। ক্ষুরধার লেখাগুলো চিন্তার খোরাক শুধু নয়, দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের চেয়ারকেও নাড়িয়ে দিত। সাংবাদিকতায় নিয়ম নীতি যতটা সম্ভব রক্ষা করে কাজ করেছেন সামরিক বেসামরিক আমলে। তার অনেক লেখার প্রথম শ্রোতা  হবার সৌভাগ্য এক সময় হয়েছে। লেখার কোনো কোনো অংশ নিয়ে প্রশ্ন করে মতামতও জানতে চাইতেন। ভ্রমণ কালে সফরসঙ্গী হিসেবে দেখেছি মোহমুদ্ধতায় তাঁকে প্রকৃতির কাছাকাছি যেতে। সেই বজলুর রহমান ইহজাগতিকতা ছেড়ে পারলৌকিক ভুবনে ঠাঁই নিয়েছেন, কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই। এ কেমন যাওয়া, নিজের ভূবনকে অবহেলায় রেখে। এই প্রস্থান, বড় হৃদয়ে মথিত করুণ ক্রন্দনের, বড় বেশি শোকের, মূর্ছনার। অকূতোভয় বজলুর রহমান অপত্য স্নেহ আর ভালোবাসায় সিক্ত করে গেছেন স্বজন, অনুরাগী, গুণ মুগ্ধদের।

ফুলের প্রতি ছিল তাঁর তীব্র টান। দেশ বিদেশে ভ্রমণের সঙ্গী হিসেবে দেখেছি যেখানেই যেতেন সেখানকার গাছ পালা, ফুল-ফসল সম্পর্কে খোঁজ নিতে। 'পুষ্প বনে পুষ্প নাহি, আছে অন্তরে। '

কানাডার অটোয়ায় টিউলিপ উৎসবে বজলু ভাইয়ের সঙ্গী ছিলাম। কর্মসূত্রে আমি তখন সেখানে। এক সেমিনারে অংশ নিতে এসেছিলেন। তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী থাকতে পেরে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি। আধুনিকতায় এবং বাঙালিয়ানায় সমৃদ্ধ মানুষটি আমাদের অন্তরাত্মায় গভীরভাবে ঠাঁই করে নিয়েছেন। তিন দশকের বেশি সম্পর্কের উজ্জলতা চিরদিন থাকবে অম্লান। সীমার মাঝে অসীম হয়ে বজলুর রহমান বেঁচে থাকবেন তার শ্রম ও কর্মের ফসলে। আগামী দিনগুলোতে তাঁকে আরো বেশি মনে পড়বে। আরো বেশি অনুভূত হবে তাঁর শূন্যতা। তাঁর এই চলে যাওয়া, আমাদের বেদনার্ত করেছে। নিত্য দিনের জীবনে বজলুর রহমান থাকবেন আমাদের পাথেয় হয়েই।

মুহম্মদ সবুর: কবি, কথাসাহিত্যিক

বাংলাদেশ সময়: ১২৪৮ঘণ্টা, আগস্ট ০৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।