ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

জাতীয় শোক দিবসে—

ভাবনা: আনুগত্যে শোকে ও কেকে ।। আহমেদ শরীফ শুভ

... | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩২ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১৪
ভাবনা: আনুগত্যে শোকে ও কেকে ।। আহমেদ শরীফ শুভ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

বাবার সাথে আমার সম্পর্কের রূপক দিয়ে আমি বঙ্গবন্ধুর সাথে আমাদের জাতি সত্তার সম্পর্কের ব্যাপ্তিকে সংজ্ঞায়িত করি।

যিনি আমার বাবা তাঁর সমস্ত সত্তা জুড়ে থাকে আমার মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা।

তিনি আমাকে ভালোবাসেন। আমিও তাঁকে। এই ভালোবাসার মধ্যে কোনো খাঁদ নেই। কোনো প্রাপ্তির প্রত্যাশা নেই। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তিনি আমার শৈশবে বা কৈশোরে আমার জন্য যে সব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার সবগুলোই সঠিক ছিল, অথবা তখন কিংবা এখন সব ব্যাপারেই আমি তাঁর সাথে একমত পোষণ করি। কখনো কখনো বাবার সিদ্ধান্ত কিংবা কোনো পদক্ষেপ মনঃপুত না হলে বিদ্রোহও করেছি, এখনো প্রয়োজনে মতান্তর প্রকাশ করি। কিন্তু দিন শেষে তিনি আমার বাবাই থাকেন। আমি জানি তিনি যাই করেন, যে সিদ্ধান্তই নেন তা আমার তথা আমাদের বৃহত্তর পরিবারের মঙ্গলের কথা ভেবেই নেন। কখনো কখনো তাঁর সিদ্ধান্ত, পদক্ষেপ কিংবা কৌশল ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু এটা প্রমাণিত হয়নি যে এই সিদ্ধান্তগুলো অমঙ্গল কামনা করে নেয়া হয়েছে কিংবা তিনি আমার বাবা নন। তাঁর যতো প্রমাদ তাতে সততার কোনো অভাব নেই। হয়তোবা অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা অথবা বিরাজমান পরিস্থিতির কারণে তিনি অনিচ্ছাকৃত ভুল করেছেন। সেই ভুল নিয়ে আমি বা আমার ভাইবোনেরা তাঁর সামনেই সমালোচনা করেছি। তিনি কখনো মেনে নিয়েছেন, কখনো নেননি। আবার কখনো পরবর্তী বিশ্লেষণে এমনও দেখা গিয়েছে যে সে সময়ে নেয়া বাবার সিদ্ধান্ত, কৌশল কিংবা পদক্ষেপটি সঠিকই ছিল, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটিই বরং অপরিণত ছিল। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে আমি বা আমরা বাবাকে ভুল পথে ঠেলে দিয়েছি। বাবাকে ভালোবাসার এবং তার ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার যেমন আমার আছে, ঠিক তেমনি তার সমালোচনা করার অধিকারও আমি সংরক্ষণ করি। কিন্তু তাঁর পিতৃত্বকে অস্বীকার করার অধিকার আমার নেই। কারণ, তাতে আমার জন্মই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। আমি বা আমার বাবা যাই করিনা কেন, পরষ্পরের প্রতি ভালোবাসা এবং মঙ্গল আকাঙ্ক্ষা থেকেই তা করি। এর মধ্যে যদি কোনো ভ্রান্তি থাকে তা নিছকই অনিচ্ছা, অনভিজ্ঞতা কিংবা অসতর্কতা প্রসূত। সন্তানের প্রতি পিতার ভালোবাসা তাতে সামান্যও ফিকে হয় না। পিতার প্রতি সন্তানের আনুগত্যও তাতে লংঘিত হয় না।

বঙ্গবন্ধুর সাথে আমাদের জাতিসত্তার সম্পর্কের ব্যাপ্তিটিও তেমন। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে শেষ দিনটি পর্যন্ত তিনি যা কিছুই করেছেন তা বাঙালি জাতির মুক্তি ও সামগ্রীক কল্যাণের জন্যই করেছেন। এই দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের কোনো কোনো সিদ্ধান্ত, পদক্ষেপ ও কৌশল সময়ের বিবেচনায় আমাদের অনেকের মনঃপুত হয়নি, আমরা কেউ কেউ সেসবের বিরোধিতাও করেছি। তার মানে তার পিতৃত্বের ছায়াকে অবজ্ঞা করা নয়, তার মঙ্গলাকাঙ্ক্ষাকে অস্বীকার করা নয়। তাঁর হত্যাকাণ্ডের নৃশংস বার্ষিকীতে দাঁড়িয়ে আমরা যারা বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি, তাদের কেউ কেউ যে কখনোই তাঁর কোনো অবস্থানের সাথে দ্বিমত পোষণ করতে পারবো না এমনটিও নয়। আমাদের জাতিসত্তার জনক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমাদের আভূমি নত শ্রদ্ধাঞ্জলি যেমন স্বতঃস্ফূর্ত তেমন তাঁর কোনো অবস্থানের সাথে দ্বিমত পোষণের অধিকারও তেমন সংরক্ষিত। সেই অধিকারটুকু না থাকলে আমরা পরিবারের সদস্য থাকি না, স্বার্থান্বেষী চাটুকারে পরিণত হই। তবে আমাদের সম্পর্কের অবস্থানটি হতে হবে মৌলিক, পারস্পরিক স্বীকৃতির। সামান্য কিছু গৌণ দ্বিমতের অজুহাতে আমরা যদি পিতৃত্বকে অস্বীকার করি তবে আমাদের জাতিসত্তার জন্মটিই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়।

দুই.
সম্প্রতি আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ১৫ই আগস্টে কেক কেটে জন্মদিন পালন না করতে বিনএনপি নেত্রী বেগম জিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এই আহ্বান জানানোর ভঙ্গিটি কৃপা প্রার্থীর মতো মনে হয়েছে। বেগম জিয়া জেনেশুনেই ঘটা করে এই দিনে কেক কেটে জন্মদিন পালন করেন। যাদের সাথে তার অহিনকুল সম্পর্ক সেই আওয়ামী লীগ নেতাদের ডাকে সাড়া দিয়ে এবারে তিনি সেই আনুষ্ঠানিকতার ব্যত্যয় ঘটাবেন এমনটি ভাবার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। এই আহ্বানটি শেষাবধি একটি অনাবশ্যক অরণ্যে রোদনে পরিণত হবে। বেগম জিয়া এই আহ্বানে সাড়া দেবেন না জেনেও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ কেন তার প্রতি এই আহ্বান জানাচ্ছেন তা একমাত্র তারাই বলতে পারবেন। যদি তাকে বিব্রত করাই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তবে বছরের পর বছর ঘটা করে জন্মদিন (যে তারিখের যথার্থতা আবার প্রশ্নবিদ্ধও বটে) পালনের পরও তিনি যদি বিব্রত না হয়ে থাকেন, তা হলে তিনি নতুন করে বিব্রত হতে যাবেন কেন? আর যদি তিনি এই আহ্বানে সাড়া দেয়ার মতো প্রায় অসম্ভব কাজটি করেই বসেন তবে কি তা বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকীকে নতুনভাবে মহিমান্বিত করবে? তার চেয়ে তার এই জন্মদিন পালনের উদ্যোগটিকে উপেক্ষা বা অবজ্ঞা করাই শ্রেয় নয় কি? একমাত্র দলান্ধ সমর্থক ছাড়া আর কেউই জাতির জনকের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বার্ষিকীতে বেগম জিয়ার ঘটা করে জন্মদিন পালন করাকে সমর্থন করেন না। যদি এই দিনে সত্যি সত্যি তার জন্মদিন হয়েও থাকে তবে তা পালন করার ভিন্ন এবং অপেক্ষাকৃত সংযত আরো অনেক উপায় আছে। বেগম জিয়ার উপদেষ্টা বৃন্দের নিশ্চয়ই সেসব উপায় অজানা নয়। তাই উপেক্ষাই এখানে সমুচিত প্রতিক্রিয়া, অবান্তর কৃপা প্রার্থনা নয়।

তিন.
১৫ই আগস্টে সারা দেশে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে শত সহস্র আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। বঙ্গবন্ধুর স্তুতিতে সভা প্রাঙ্গণ ভরে উঠবে। কোন বঙ্গবন্ধু? যে বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্রের, যে বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্রের, যে বঙ্গবন্ধু ধর্ম নিরপেক্ষতার, যে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতীয়তাবাদের, সর্বোপরি যে বঙ্গবন্ধু আমাদের উপহার দিয়েছিলেন ৭২ এর সংবিধানের মতো একটি প্রগতিশীল দেশ পরিচালনা ব্যবস্থা, তাঁর। অথচ ৭৫ এর পর তাঁর দলের ক্ষমতার তৃতীয় মেয়াদেও আমরা ৭২ এর সংবিধানে ফিরে যেতে পারলাম না। তিনি যে আওয়ামী লীগকে গণমানুষের সংগঠনে পরিণত করেছিলেন তা এখনো খেটে খাওয়া মানুষ আর মধ্যবিত্তের নিয়ন্ত্রণে গণমানুষের প্রাণের সংগঠন আছে কিনা তা জিজ্ঞেস করার সময়ও এসেছে আজ। ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে তাঁর আদর্শ ও চেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন করলে তিনি আর বঙ্গবন্ধু থাকেন না, টুঙ্গীপাড়ার শেখ মুজিব হয়ে যান। এদেশের গ্রাম গ্রামান্তরে আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা অযুত লক্ষ মুজিব সেনা তা হতে দেবেন না— এমনটাই আজকের প্রত্যাশা। তৃণমূলের আওয়ামী লীগ তৃণমূলে ফিরে এলেই দেশের মঙ্গল। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকী তাতেই মহিমান্বিত হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩২ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।