কাইয়ুম চৌধুরী বাংলাদেশের চিত্রশিল্পের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে জায়গা করে নিয়েছেন। এটার বড় কারণ হলো, একটি দেশের শিল্পকে প্রধানত সেই দেশের ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত করে নিতে হয়।
কাইয়ুম চৌধুরী পঞ্চাশের দশকেই এখানে পরিচিত হয়ে যান। এবং তার লোককলা বা দেশজ হওয়ার বাসনা তার মধ্যে তীব্র হয় শিল্পী জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ার জন্য। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে শিল্পাদর্শের সঙ্গে যে কজন শিল্পী-কবি সম্পর্কিত তাদের অন্যতম কাইয়ুম চৌধুরী। তিনি আমৃত্যু শিল্পাচার্যকে গুরু মেনেছেন। এবং শিল্পাচার্যই ছিলো সত্যিকার অর্থে তার আচার্য বা তার প্রেরণার উৎস।
উনিশশ পঞ্চাশের দশকে আমাদের দেশে শিল্প চর্চায় দুটি ধারা লক্ষ করা যায়। সাতচল্লিশের দেশভাগ উত্তরকালে নতুন দেশে চিত্রকলা চর্চায় দু ধরনের প্রবণতা দেখা যায়। কারণ দেশভাগের পর নতুন রাষ্ট্রে সুযোগ হয়েছিলো বিদেশে বৃত্তি নিয়ে পড়া লেখার। তখন থেকে পশ্চিমুখী হওয়ার একটা প্রবণতা দেখা দেয়। অপরদিকে জয়নুল আবেদিন পঞ্চাশের দশকে বিদেশ থেকে দু দুবার ঘুরে এসে জানিয়ে ছিলেন যে, সব দেশের শিল্পই তার তার দেশের মতোই। আমরা পশ্চিমের অনুকরণ করবো না। এ জন্য জয়নুল আবেদিন বাংলার লোক শিল্পের মধ্যে দিয়ে শিল্পের আধুনিকতা অন্বেষণ করেছেন। এবং সেই জয়নুলের এই অন্বেষণের পথেই সহযাত্রী হয়েছিলেন শিল্পি কাইয়ুম চৌধুরী। যার জন্য কাইয়ুম চৌধুরীর ছবি যখন একান্তভাবে শৈলযুক্ত হয় বা স্টাইলাইজড হয় তাতে সুনির্দিষ্ট কোনো পাখি দেখি না, গাছপালা বা পাখির মোটিফ দেখি, লতাপাতা দেখি। এটাই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেটা কাইয়ুম চৌধুরীরে মধ্যে ঘটেছে। কাইয়ুম চৌধুরীর ছবি বিষয়ে আমি নিজে বিশ্বাস করি, বাংলাদেশে সম্পর্কিত হয়ে পূর্ব দেশের ছবি যে দ্বিমাত্রিক তার একটা বিশেষ মাত্রা লক্ষ করা যায় তার কাজে। সেই মাত্রাটি হচ্ছে দ্বিমাত্রিক প্লট দ্বিমাত্রিক রেখেই তার উপর নানা তৈলের কালার ছড়িয়ে দেয়া। বিশেষ করে কাজল কালো রঙ, সেটা হচ্ছে তার একটা প্রধান রঙ, যেটা তিনি পৌনপুনিকভাবে ব্যবহার করেছেন।
আরেকটা বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আমরা যখনই বাংলাদেশকে দেখি তখন একটা উঁচু অবস্থান থেকে দেখি। এবং বাংলাদেশের যেকোনো রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে গেলেই যে ঘাস ও ডোবা জঙ্গলের বাংলাদেশ সেই বাংলাদেশটাকেই দেখি। বাংলাদেশের চেহারাটা উপর থেকে দেখলে কিছুটা পাখির চোখে দেখার মতো। কিংবা আমরা টপ এঙ্গেলে দেখার কথা যদি বলি তাহলে আমরা দেখি কোথাও সবুজ কোথাও জল এরকম একটা ব্যাপার আছে। কাইয়ুম চৌধুরীর প্রায় সব ক্যানভাসই এই বাংলার ল্যান্ডস্কেপটাকেই ধরে রেখেছে। এই ল্যান্ডস্কেপের মধ্যে পশ্চিমের ল্যান্ডস্কেপের যে ভিত্তি অর্থাৎ পরিপ্রেক্ষিত থাকবে, যোথ দেখার ব্যাপার থাকবে কিংবা আলো ছায়ার ব্যাপার থাকবে সেটা নাই। বাংলাদেশের ছবি বাংলাদেশের মতো করেই—যেহেতু এখানের প্রকৃতি রঙিন সে অর্থে একধরনের ইম্প্রেশনিস্ট বৈশিষ্ট পেয়েছে। বাংলাদেশের বঙ্গজ একজন ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পি হিসেবে যদি কাইয়ুম চৌধুরীকে আখ্যা দেয়া যায় এই আখ্যাটা খুব ভুল হবে না।
কাইয়ুম চৌধুরীর বিষয়গুলা খুবই পরিচিত। নদি, নৌকা, মাছ, পাখি এগুলো ঘুরে ঘুরে এসেছে। কিন্তু আরো একটা বিষয় লক্ষণীয়- কাইয়ুম চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ছবি এঁকেছেন। কাইয়ুম চৌধুরী যখন এখানে নব্বইয়ের দশকের শেষে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হতে যাচ্ছিল তখন সেই বিষয়গুলো নিয়ে তিনি ছবি এঁকেছেন। কাইয়ুম চৌধুরীর ছবিতে আমরা প্রচুর সবুজ দেখি। আসলে তিনি যে বাংলাদেশটা দেখেছেন সেটা তার স্মৃতির বাংলাদেশ। সেই স্মৃতি থেকে কোনো মানুষই বেরিয়ে আসতে পারে না। যদিও বাংলাদেশে এখন সবুজ অনেক কমে গেছে। যদিও সবুজের শীর্ষে আমরা সেই পরিমাণ রঙ দেখি না। সেই পরিমাণ পুষ্প ধরে না, ফোটে না। তা সত্ত্বেও আমাদের চেতনার গভীরে বাংলাদেশ সব সময়ই রঙিন। আমরা লক্ষ করি, বাংলাদেশটার দিকে তাকালে দেখবো তার জনবসতির চেয়ে প্রকৃতি অনেক বড়। সেই অবলোকনটা কাইয়ুম চৌধুরীর মধ্য দিয়ে শিল্পিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
কাইয়ুম চৌধুরী অনেকগুলো বিষয় মুদ্রিত করেছেন। যেগুলোতে আমরা বুঝতে পারবো, এটা বাংলাদেশের নৌকা, এটা বাংলাদেশের জেলে। এটা বাংলাদেশের খেজুর গাছ—খেজুর গাছ থেকে রস খেতে উঠছে। এরকম অসংখ্য মুদ্রা আছে। যেসব মুদ্রা দিয়ে বাংলাদেশকে চেনা যায়। যেটাকে বলা হয় মনোগ্রাম। এরকম যার মনোগ্রাম দিয়ে বাংলাদেশকে চেনা যায়, বোঝা যায় সেই কাইয়ুম চৌধুরীর মতো আরেকজন হলেন কামরুল হাসান। যেখানে একটা বিশেষ জায়গায় কাইয়ুম চৌধুরী ও কামরুল হাসানের মিলন হয়ে গেছে। এই মিলের ইতিহাসটা খুব জরুরি এজন্য যে, এই দুজন শিল্পী বঙ্গজ শিল্পের ব্যবচ্ছেদ করে এর অন্তর রহস্য বুঝতে চেয়েছিলেন।
কিছুদিন কাইয়ুম চৌধুরী ও কামরুল হাসান একসঙ্গে কাজও করেছিলেন। তিনি ঢাকা চারুকলায় চাকরি করার আগে ডিজাইন সেন্টারে ছিলেন। সেখানে ডিজাইন সেন্টারের প্রধান ছিলেন কামরুল হাসান। তার সহযোগী ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। পরবর্তী সময়ে অবশ্য কামরুল হাসানের সঙ্গে তিনি কাজ করেননি। কাইয়ুম চৌধুরীর সঙ্গে এ বিষয়ে আমার বহুবার কথাও হয়েছে। তিনি আমাকে বলেছেন, জয়নুল আবেদিনের পর তার আরেকজন প্রেরণার উৎস আছে। তিনি হলেন কামরুল হাসান। এ বিষয়টা বিবেচনার সময় আমাদের অবশ্য এ বিষয়টা মনে রাখতে হবে, শিল্পাচ র্যের প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। এখানে ১৯৪৮ সালে জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৪৯ সালের ব্যাচ। এ ব্যাচের মধ্যে বড় ধরনের জাগরণ এসেছিলো। এ ব্যাচের উল্লেখযোগ্য শিল্পী ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী, রশিদ চৌধুরী, আব্দুর রাজ্জাক, মুর্তজা বশির। এই শিল্পকুলই কিন্তু বাংলাদেশের শিল্প চর্চার বাঁকটা ঘুরিয়ে দিয়েছেন। তাদেরই অন্যতম হলেন কাইয়ুম চৌধুরী।
আমাদের এই দেশের মানুষ প্রতিনিয়ত যে শিল্পের মুখোমুখী হয়, সেটা হচ্ছে শিশু বয়স থেকে বিভিন্ন বই, গল্প, উপন্যাস, কথা সাহিত্য বা সংবাদপত্র ও সাময়িকী। এসব সংবাদপত্র ও সাময়িকীর মধ্য দিয়েই আমরা আমাদের চারুশিল্প দেখার চোখ তৈরি করেছি। বা আমাদের চোখ অভিজ্ঞ হয় চারুশিল্প দেখার মধ্য দিয়ে। এতে যেভাবে আমরা অক্ষর জ্ঞান লাভ করে গল্প উপন্যাসের বই পড়ি ঠিক সেভাবে আমাদের ছবি দেখা হয় না। তা সত্ত্বেও এসব বইয়ে যেসব ছবি থাকে সেসব ছবি দেখে দেখে আমাদের চোখ চিত্রশিল্প পাঠ করতে শেখে। সে জায়গাটুকুতে কাইয়ুম চৌধুরীর প্রচুর কাজ রয়ে গেছে। মানে বইয়ের ভেতরের চিত্র, অলঙ্করণ, অঙ্গসজ্জা, বইয়ের কাভার এগুলো।
অবশেষে কাইয়ুম চৌধুরী সম্পর্কে তার প্রতিভার মূল্যায়নের জন্য যে কথাটা বলা উচিত, আমরা যারা পত্রপত্রিকা ও প্রকাশনার সঙ্গে জড়িত আমরা সবাই জানি, এটা হলো ডিজিটাল যুগ। আমরা চমৎকার ফ্রন্টে—কম্পউটারে আছে, ইন্টারনেটে আছে—সেখান থেকে নিয়ে আমরা চমৎকার নানাকিছু বের করতে পারি। কিন্তু যখনই মানুষ প্রচ্ছদের কথা ভেবেছে, লেটারের কথা ভেবেছে, অলঙ্করণের কথা ভেবেছে, বইয়ের অঙ্গসজ্জার কথা ভেবেছে, ভিতরের কোনো বিশেষ পরিমার্জনার কথা ভেবেছে তখন কিন্তু সবাই বলেছেন, কাইয়ুম চৌধুরীকে দিয়ে বইয়ের নামটা লিখিয়ে নেন, কিংবা তাকে দিয়ে বইয়ের প্রচ্ছদটা আঁকিয়ে নেন। কাইয়ুম চৌধুরী থেকে একটা ইলাস্ট্রেশন নিয়ে আসেন তাইলে সুন্দর হবে। কাইয়ুম চৌধুরী এই কাজ প্রচুর করেছেন। এ ক্ষেত্রে কাইয়ুম চৌধুরী এতো বেশি কাজ করেছেন যে, শুধু এসব বইয়ের কাভারের কাজ নিয়ে একাধিক ডক্টরেট থিসিস হতে পারে বলে আমার বিশ্বাস। তিনি খুব বিখ্যাত বিখ্যাত বইয়ের কাভার করেছেন। আমাদের প্রথম প্রজন্মের অনেকের বইয়ের কাভারের কাজ করেছেন কাইয়ুম চৌধুরী। বেশির ভাগ কবি সাহিত্যিকদের বই তিনি এঁকেছেন। শামসুর রাহমান বলি, শওকত ওসমান বলি এরা সবাই কাইয়ুম চৌধুরী দিয়ে তাদের বইয়ের কাভার করেছেন।
অবশ্য কাইয়ুম চৌধুরী এককভাবে কাজটা করেছেন বলা যাবে না। কিন্তু কাইয়ুম চৌধুরী এককভাবে যতো কাজ করেছেন অন্যরা সবাই মিলে তার সমান এতো কাজ করেননি। এসব কাজের মধ্য দিয়ে জনরুচি তৈরির ক্ষেত্রে শিল্পরুচি তৈরির ক্ষেত্রে কাইয়ুম চৌধুরীর তুলনাই হয় না। ব্যক্তিগতভাবে কাইয়ুম চৌধুরীর সঙ্গে আমার অনেকরকম যোগাযোগ হয়েছে। তাকে শৈশব থেকে দেখেছি। যেটা বলার বিষয়, সেটা হলো তিনি আসলে একজন নিরহংকারি মানুষ ছিলেন। কখনোই তিনি কোনো বিষয় নিয়ে উচ্চবাচ্চ করতেন না। বাংলাদেশে শিল্পিদের মধ্যে যারা সংগীতপ্রীতি কিংবদন্তিতুল্য তাদের মধ্যে প্রথমত হলেন শিল্পি শফিউদ্দিন আহমেদ—আমাদের সেই প্রবীণ শিল্পি তিনি প্রয়াত হয়েছেন। তারপরই হলেন কাইয়ুম চৌধুরী। যারা এক সময় এলপি সংগ্রহের জন্য ছুটতেন। এ বিষয়ে তিনি প্রায়ই আলাপটা করতেন। গুলিস্তানে সে সময় একটা দোকানে ছিলো তিনি সেখানে প্রায়ই যেতেন। তাদের মধ্যে এ নিয়ে একটা প্রতিযোগিতা ছিলো। তিনি প্রচুর ছবি সংগ্রহ করতেন। প্রচুর চলচ্চিত্র দেখেছেন। এবং তার কোন চলচ্চিত্রের কোন মিউজিক তিনি সেটা বলে দিতে পারতেন। আমি নিজে চলচ্চিত্রে আগ্রহী তাই এ নিয়ে তার সঙ্গে আমার আলাপ হতো। তিনি তার এসব সংগৃহিত লং প্লেগুলো খুবই যত্ন করে রাখতেন। আমরা তার বাসায় গিয়েছি। দেখেছি তার বাসায় লং প্লের বিরাট কালেকশন।
তার সংগীতপ্রীতি অনেক বেশি ছিলো। শৈশবে থেকেই তার সংগীতপ্রীতি ছিলো। সংগীতপ্রীতি তার পারিবারিক ঐতিহ্য।
এই সংগীতপ্রীতির কারণেই তিনি বেঙ্গলের অনুষ্ঠানে যেতেন। এবারো সেই সংগীত অনুষ্ঠান বেঙ্গলে গেলেন। সেখানেই তিনি প্রয়াত হলেন। সেখানেই তার জীবনের অবসান হলো। আসলে এরকম সুরেলা মৃত্যু বোধ হয় শুধু কাইয়ুম চৌধুরীর জন্যই সম্ভাবনাময় ছিলো। এবং সেটাই হয়েছে। আমার মনে হয়, কালকে কাইয়ুম চৌধুরীর জন্যই মৃত্যুমঞ্চটা একটা সুরধ্বনিময় এবং সুরমখরিত একটা মঞ্চ ছিলো। তাতে হয়তো প্রকৃতির একটা নির্দেশ ছিলো।
লেখক: শিল্প সমালোচক
অনুলিখক: শাহাদাৎ তৈয়ব
বাংলাদেশ সময়: ১৮১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০১, ২০১৪