সময়টা ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসের। মধ্য দুপুরে ঢাকা ক্লাবে একাকী বসে আছি।
মন খারাপই ছিল। বঞ্চনার তীব্র দহন ভিতরে। কিছুই বললাম না। সামনে বসা মানুষটি গল্প শুরু করলেন। উত্তম-সুচিত্রা জুটি মাঝে ছবি বিশ্বাস। সলিল চৌধুরী থেকে মান্না দে, কোনো কিছু বাদ নেই। এক পর্যায়ে নিজেও দুই লাইন গাইলেন।
মন ভালো থাকলে বন্ধুদের আড্ডায় গুনগুন করতেন জগ্লুল ভাই। অসম্ভব দরাজ গলা।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছি। হঠাৎ করে বললেন, মন খারাপ করবে না কোনো কিছুতে। এই জীবনে অনেক কিছু ঘটে। আবার সব ঠিক হয়ে যায়। তারপর একজন নারী সাংবাদিকের নাম নিয়ে বললেন, তার কারণে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা সমসাময়িক। দিল্লিতে থাকার সময় নিয়মিত যেতাম শেখ হাসিনার বাড়িতে।
জগ্লুল ভাইর গল্পে ভুলে গেলাম আমার মন খারাপের কথা। মধ্য দুপুরেই জমে উঠল আড্ডা। বললেন, চলচ্চিত্র ও হারানো দিনের সংগীত নিয়ে আমার মতো জানা আর একজন সাংবাদিকই আছে। আগ্রহ নিয়ে বললাম, কে? জবাবে বললেন, গোলাম সারওয়ার। সংগীত ও চলচ্চিত্রে তারও অসাধারণ পাণ্ডিত্য। সংগীত আর চলচ্চিত্র নিয়ে জগ্লুল ভাইর এমন পাণ্ডিত্য আমার জানা ছিল না। তাকে জানতাম সাদা মনের মানুষ হিসেবে। দেশের খ্যাতিমান সাংবাদিক, কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক হিসেবে। বিশেষ করে ভারতের রাজনীতির ওপর ছিল তার বিশাল দখল।
এক অভিজাত পরিবার থেকে এসেছিলেন সাংবাদিকতায়। বাবা নাসিরউদ্দিন চৌধুরী এবং শ্বশুর হাবিবউল্লাহ বাহার চৌধুরী। দুজনই ছিলেন মন্ত্রী। সাংবাদিকতা জীবনের শুরুতে দূর থেকে তাকে দেখতাম। সারাক্ষণ স্যুটেড, বুটেড, ধোপদুরস্ত। গলায় বাঁধতেন টাই। কিন্তু কোনো অহমিকা ছিল না। সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। অভিজাত সব ক্লাবের সদস্য ছিলেন। কিন্তু তার মধ্যে ভাব ছিল না। সবসময় ছিলেন হাসি-খুশি বন্ধুপ্রিয়। কুমিল্লার নাঙ্গলকোট গিয়েছিলেন একবার আমার অনুরোধে। সঙ্গে সিনিয়র সাংবাদিক ফরিদ হোসেন।
নাঙ্গলকোটের ছায়াশীতল পরিবেশ তার ভালো লেগেছিল। প্রায়ই বলতেন, আবার যেতে হবে তোমার নাঙ্গলকোটে। আগের মতো মাছের আয়োজন করবে। বলতাম, চলেন এক বন্ধের দিনে। ভাবতেই পারি না জগ্লুল ভাই আর কোনোদিন আমন্ত্রণ নিতে পারবেন না। যেতে পারবেন না আমার গ্রামে।
এই তো সেদিন কথায় কথায় বললেন, ইকবাল ভাইয়ের (প্রখ্যাত সাংবাদিক ভয়েস অব আমেরিকা খ্যাত ইকবাল বাহার চৌধুরী, ভাবীর ভাই) সঙ্গে পুত্র নানাবাড়ি বেড়িয়ে এসেছে। ছেলে খুব খুশি। খুব আপ্যায়ন করেছে আমার শ্যালক আলাহউদ্দিন চৌধুরী নাসিম। ছেলে এসেই সারাক্ষণ মামার গল্প করেছে। বলছে, নাসিম মামা অনেক করেছে। বললাম, আপনি যাননি। বললেন, না যেতে পারিনি। তবে চলো একসঙ্গে যাব দলবেঁধে। তোমার বন্ধুকে বলে রাখ।
আমি তখনই ফোন দিলাম নাসিম ভাইকে। বললাম, আপনার দুলাভাই যাবে শ্বশুরবাড়ি। সঙ্গে যাবে সাংবাদিক সহকর্মী দল। আগের দিনে জামাইকে নিতে হতো ঘোড়ার গাড়িতে করে। জগ্লুল ভাই যাবেন হেলিকপ্টারে চড়ে। সব আয়োজন আপনার। আমার থেকে ফোন কেড়ে নিলেন, বললেন ওরা দুষ্টামি করছে। তবে একবার আমরা যাব। হেলিকপ্টারের দরকার নেই।
জগ্লুল ভাইর আর কোনোদিন শ্বশুরবাড়ি যাওয়া হবে না। আমরাও যাব না তার সঙ্গে।
এই মানুষটির সঙ্গে কখন কীভাবে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল মনে নেই। প্রিয় অগ্রজ আমাদের কাছে টেনে নিয়েছিলেন ছোট ভাই ও বন্ধুত্বের স্নেহের পরশে। আমার সঙ্গে ব্যক্তিগত গভীর সম্পর্কের পেছনে আরেকজন মানুষ ছিলেন- তিনি নুরুল ইসলাম ভাই। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। জগ্লুল ভাইয়ের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু। আমরা একসঙ্গে মাঝে মাঝে আড্ডা দিতাম নব্বইয়ের দশকে। সেই আড্ডার দ্বিতীয় অধ্যায় ছিল বৈদ্য বাবুর হোয়াইট হাউসের আড্ডা। সেই আড্ডার নিয়মিত সঙ্গী সিনিয়র সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ার, ফরিদ হোসেন, শ্যামল দত্তসহ আরও অনেকে। আসতেন আমাদের ঘনিষ্ঠ অনেক রাজনীতিক। থাকতেন জগ্লুল ভাইয়ের পুরান ঢাকার বন্ধুরাও।
অনেক বছর ধরে আমরা সবাই ব্যস্ত। তাই শান্তিনগর হোয়াইট হাউসের বৈদ্য বাবুর আড্ডা আর নেই। মাঝে জগ্লুল ভাই একদিন বললেন, চলো বৈদ্য বাবুকে নিয়ে আবার বসি। সে বসা আর হয় না। সবাই ব্যস্ত। বৈদ্য বাবুও ফোন করেন। কিন্তু আমরা সময় দিতে পারি না। বসা হয় না জগ্লুল ভাইকে নিয়ে। আর কোনোদিনও হবে না।
জগ্লুল ভাইয়ের সঙ্গে সর্বশেষ দেখা বাংলাদেশ প্রতিদিন অফিসে। তিনি নিয়মিত লিখতেন আমাদের কাগজে। এসেই ঢুকতেন আমার রুমে। চায়ের অর্ডার দিতেন। লেখা ঠিক করতেন। তারপর চলে যেতেন। তার শেষ লেখাটি ছাপা হয়েছে গত শুক্রবার। শেষবারের মতো এলেন। লিখেছিলেন, কথা রাখলেন ওবামা। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান অবস্থা নিয়ে লেখা।
তিনি কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্র ঘুরে এসেছেন। সেখান থেকেও লেখা পাঠিয়েছিলেন। আমার রুমে চা খেলেন। লেখার সমাপনী টানলেন। বললেন, লেখাটি তাড়াতাড়ি দিয়ে দেবে। জগ্লুল ভাইয়ের সবশেষ লেখাটি বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত হয় শুক্রবার। ভাবতেই পারছি না শনিবার রাতে তিনি চলে যাবেন। আর কোনোদিন আসবেন না বাংলাদেশ প্রতিদিন অফিসে। আমরা প্রকাশ করতে পারব না তার কোনো লেখা। এর আগে আমরা হারিয়েছিলাম আমাদের আরেকজন কলামিস্ট সৈয়দ রেজাউল হায়াৎকে। এবার হারালাম জগ্লুল আহ্মেদ চৌধুরীকে। মানুষের জীবনটা বড় ক্ষণস্থায়ী। হুমায়ূন আহমেদ দুঃখ করেছিলেন, একটা কচ্ছপ বাঁচে সাড়ে তিনশ’ বছর, আর মানুষ দুনিয়াতে আসে অল্প সময়ের জন্য। এর মধ্যে বেশির ভাগ সময় কাটে দুঃখ-কষ্ট নিয়ে হৃদয়ের রক্তক্ষরণে।
আমি এটিএন বাংলায় থাকার সময় একবার অনুরোধ করেছিলাম, বহির্বিশ্ব নিয়ে একটা অনুষ্ঠান করতে। আমার অনুরোধে উপস্থাপনার দায়িত্ব নেন। আমি যতদিন এটিএন বাংলায় ছিলাম তিনিও ছিলেন। আমি এটিএন বাংলা ছাড়ার পর তিনিও অনুষ্ঠান ছাড়লেন। বললেন, তুমি নেই। আমিও নেই। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, সেই এটিএন বাংলার ‘অন্যদৃষ্টি’ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে গিয়েই দুর্ঘটনার শিকার হন। এটিএনের বার্তা সম্পাদক থাকাকালে অন্যদৃষ্টির যাত্রাও হয় আমার হাতে। জগ্লুল ভাইর মৃত্যুসংবাদ প্রথম জানালেন কামাল মাহমুদ ভাই। বাংলাদেশ প্রতিদিনের বার্তা সম্পাদক। এরপর কথা হয় ক্রাইম রিপোর্টার সাখাওয়াতের সঙ্গে। তার কাছেই শুনি বিস্তারিত। বাস থেকে নামার সময় এক পা রেখেছিলেন রাজপথে। আরেক পা বাসে থাকতেই ড্রাইভার টান দেয়। পড়ে গেলেন তিনি। আর উঠলেন না।
কাছাকাছি একটি ক্লিনিকে নিয়ে যায় পথচারীরা। ডাক্তাররা রাখলেন না। পাঠিয়ে দিলেন বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে। বুকভরা কষ্ট নিয়ে রাতে চ্যানেল আইতে জগ্লুল ভাইকে নিয়ে আলোচনায় অংশ নিলাম। মধ্যরাতে গেলাম বঙ্গবন্ধু হাসপাতালে। হিমঘরে শুয়ে আছেন আমাদের প্রিয় জগ্লুল ভাই। বাইরে সুনসান নীরবতা নিয়ে একাকী দাঁড়িয়ে বন্ধু শ্যামল দত্ত। তার অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা ছিল জগ্লুল ভাইর। যেতে পারলেন না। কোনোদিন আর যাবেনও না। আমাদের সঙ্গে বসবেন না আড্ডার আসরে। কথা বলবেন না কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন নিয়ে। ঢাকা ক্লাব, প্রেসক্লাব, বৈদ্য বাবুর আড্ডা, পত্রিকা অফিসে কোথাও আর তাকে দেখা যাবে না। কোনো কষ্টের সময় পাশে এসে কাঁধে হাত রাখবেন না। বলবেন না, চিন্তা করো না। জীবন থেমে থাকে না। চলে যায়।
নঈম নিজাম: সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১, ২০১৪