মাঝেমধ্যে দুই একটা রবীন্দ্র সংগীত শুনলেও উচ্চাঙ্গ সংগীত বলতে আমার কাছে লম্বা দমে সুর তারায় চরিয়ে রাখা ছাড়া কোনো অর্থ বহন করে না। আর শিল্পকর্ম বলতে বুঝি মাঝে মধ্যে চারুকলায় প্রদর্শনী হয়।
তবে এরকম ‘হাতে আঁকা’ অনেক ছবিতেই একটি নাম বারবার চোখে পড়েছে ‘কাইয়ুম চৌধুরী’। আমাদের পাঠ্যবই, বিভিন্ন ধরনের টাকার নোট এমনকি এখন যা নিয়ে পড়াশুনা করি বা টুকটাক কাজও করতে শুরু করেছি সেই জগতেও তার হাতের ছোঁয়া রয়েছে। প্রথম সারির সব কয়টি দৈনিকের লোগো তার ডিজাইন করা। তাকে দেশের সর্বোচ্চ সম্মানজনক পুরষ্কারও দেওয়া হয়েছে।
রোববার (৩০ নভেম্বর) রাতে একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে সেখানেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। তাতে কি! একজন মানুষ মরে যেতেই পারেন। তাই বলে কি আর ‘উৎসব’ থেমে থাকতে পারে! এরকম কত মানুষইতো রোজ মরছে! যে অনুষ্ঠানের প্রতিটি মিনিটের মূল্যই এরকম অনেক জীবনের চেয়ে বেশি সেখানে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়েছে সেইতো ঢের। তাছাড়া যিনি মরেছেন তার জন্যতো বিদেশ-বিভুই থেকে দাওয়াত করে আনা ‘পণ্ডিতদেরতো ’ আর বসিয়ে রাখা যায় না। এত এত মিডিয়া কভারেজ, এত এত লোকজন, এতএত প্রচারণা সব কি একজন মানুষের জন্য বন্ধ হয়ে যেতে পারে!
বড় অদ্ভুত আমাদের দেশ। তার চেয়েও অদ্ভুত এদেশের মানুষ। কেবল একটা ‘বিদেশি’ ট্যাগ লাগানো থাকলেই কাচকে ভাবে হীরা আর ‘দেশি’ সিল থাকলে হীরাও পায় না সিলভারের দাম! আমি নিশ্চিত রোববার যদি কাইয়ুম চৌধুরী না মরে বাশি বাজাতে বাজাতে ‘পন্ডিত হরিপ্রশাদ চৌরাসিয়া’ মারা যেতেন তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই ওই অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হত। মিডিয়াগুলোতে চলতো তোলপার, রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণার প্রস্তাবও করতেন কেউ কেউ।
‘অনুষ্ঠান বন্ধ করে এতগুলো লোককে হতাশ করা কি উচিত হত?’ কতগুলো লোক এসেছিল কালকের উৎসবে? আপনি বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে আমাদের দেশীয় ছোট ব্যান্ডগুলো নিয়ে একটি কনসার্ট আয়োজন করে গেট ওপেন করে দেন, গ্যারান্টি দিচ্ছি কালকের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি লোক হবে। এ শহরের লোজজনের যাওয়ার তেমন কোনো জায়গা নেইতো। তাই সুযোগ পেলেই বানের জলের মত ছোটে।
তবে হ্যাঁ, উচ্চাঙ্গ সংগীত শুনতে যায় উচ্চ বর্গীয় মানুষ। তাদের কাছে কাইয়ুম চৌধুরী নামে কেউ বাঁচা মরার চেয়ে একটি রাত মাস্তি করা অনেক বেশি গুরুত্বপুর্ণ। কারণ কত কষ্ট করে তারা একটি দিন সময় বের করেছেন।
খুবকি বেশি ক্ষতি হয়ে যেত একজন শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে একটি মাত্র রাত অনুষ্ঠান স্থগিত রাখলে? আমার প্রশ্ন আজকে শহীদ মিনারে এসে যারা মিডিয়ার সামনে ‘আমরা জাতির এক শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হারিয়েছি’ টাইপ বক্তব্য দিয়ে নিজেকে শিল্পীর বন্ধু দাবি করে বিশাল কৃতিত্ব নিয়ে গেলেন বা দিনভর গণমাধ্যমে ‘আমরা শোকাহত’ টাইপ বার্তা পাঠালেন খবর হওয়ার জন্য, তারাও কি আয়োজকদের এই পরামর্শটুকু দিয়েছিলেন? কই কালকের অনুষ্ঠান কোন দেশি ‘সুশীল’ বর্জন করেছেন এমন খবরওতো শুনিনি।
আর আমাদের মিডিয়াগুলোও তেমনি। ‘সব সুরই ছিল বেদনার’ টাইপ শিরোনাম করে কালকের অনুষ্ঠানের পক্ষে সাফাই গাইতে তাদের কি আপ্রাণ চেষ্টা!
ক্ষমা করবেন শ্রদ্ধেয় কাইয়ুম চৌধুরী। আমাদের এত দিয়েছেন। কিন্তু বিদায় বেলায় অপানার শ্রদ্ধার জন্য আমরা এতটুকু ছাড় দিতে রাজি নই। এতটা উদার আমরা নই।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৪০, ২০১৪