খবরটা বেশ কিছুদিন আগের। যেমন বেদনাদায়ক, তেমনি উদ্বেগের।
এভাবে তাদের প্রেম যখন গভীর থেকে গভীরে পৌঁছায়, ছেলেটি সুযোগ বুঝে প্রেমিকাকে তার ফেসবুকের ইনবক্সে নগ্ন ছবি পাঠানোর প্রস্তাব দেয়। প্রথমে মেয়েটি অসম্মতি জানালেও পরবর্তীতে আর না করতে পারেনা। প্রেমিকের মন রাখতে গিয়ে তাকে রাজি হতে হয়। ছেলের কথামতো পাঠায় নগ্ন ছবি। এর পরই বদলে যায় প্রেমিকের রূপ। ফুটে উঠে আসল চেহারা। ইন্টারনেটে ছবি প্রকাশের হুমকি দিয়ে টাকা দাবি করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনারত সুদর্শন ছেলেটি এভাবে শুধু একজনকেই নয়, স্বভাবসুলভ নির্লজ্জ ধোঁকা দিয়ে হয়রানি করেছে একে একে সাত তরুণীকে।
ভুক্তভোগীদের অন্যতম একজন ইংলিশ মিডিয়ামে এ লেভেল পড়ুয়া এক মেয়ে। ঢাকার নেতৃস্থানীয় একটি দৈনিকে হেডলাইন আকারে বিষয়টি প্রকাশিত হয়।
প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে হতচকিত মেয়েটি নিজের ইজ্জত রক্ষা করতে গিয়ে প্রতি মাসে ৫/৬ হাজার টাকা করে ছেলেটিকে দিয়ে আসছিলো। কিন্তু এতে তার মন ভরেনি। বড় অংকের টাকা না দিলে ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়া এবং তার মা-বাবাকে নগ্ন ছবি পাঠানোর হুমকি দেয়। নিরুপায় মেয়েটি গোপনে মা’র ১২ ভরি স্বর্ণের গহনা তুলে দেয় প্রেমিক নামের পাষণ্ডের কাছে। এ নিয়ে একপর্যায়ে মা-বাবার সঙ্গে ওই তরুণীর সম্পর্কচ্ছেদের উপক্রম হলে পুরো ঘটনা তাদের জানাতে বাধ্য হয় সে। পরবর্তীতে পুলিশের আশ্রয় নিলে ঢাকার ডিবি পুলিশ এ ধূর্ত ও প্রতারক প্রেমিককে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় এবং প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এর সত্যতাও তারা পায়।
নারীদের ব্ল্যাকমেইল করা বা তাদের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলার ঘটনা নতুন নয়। এর আগেও এ ধরনের বহু ঘটনা ঘটেছে। সাধারণ শ্রেণির নারী থেকে শুরু করে তারকা শ্রেণির অনেক নারীও এ ধরনের জঘন্যতম ঘটনার শিকার হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন এমন অনেক তরুণ-তরুণীও প্রেমের নাম করে লিপ্ত হন গোপন অভিসারে, যা কিনা একসময় প্রেমিকার অজান্তেই বাজারে বেরিয়ে আসে সিডি আকারে।
রমরমা ব্যবসার সহজ পথ হিসেবে বেছে নেন প্রতারক প্রেমিক। প্রেমের সৌন্দর্যের গায়ে চিত্রিত কলঙ্কের দাগ ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। কান্নার রোল পড়ে প্রেমিকার হৃদয়ে। হাতুড়ি দিয়ে পেটানোর মতো অসহনীয় পীড়ন সহ্য করতে না পেরে অনেক সময় কেউ কেউ বেছে নেয় আত্মহত্যার পথও।
এ জন্য দায়ী ছেলেটিকে মানুষ ছি ছি করে।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবরটির নিচে পাঠকদের কমেন্ট গুলো পড়লেই বুঝা যায় কিভাবে তার উপর মানুষের ঘৃণা ছিটকে পড়েছে। যে ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়য়ে কম্পিউটার সায়েন্সের মতো একটি উন্নত সাবজেক্টে পড়াশুনা করেও নিজের নৈতিকতাকে উন্নত করতে পারেনি তার উপর মানুষের এরকম বমি বমি ভাব হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে প্রতারিত মেয়েটিকেও আমি একেবারে ধোয়া তুলসি পাতা বলতে পারছিনা। এ মেয়েটিসহ যারা এ পর্যন্ত প্রতারিত হয়েছেন তাদের অধিকাংশই পড়াশুনা শেষ করে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করেছে অথবা উচ্চ শিক্ষায় পড়াশুনা রত। ভালোমন্দ বুঝার মতো বয়স, বুদ্ধি বা বিবেক তাদের রয়েছে। তাহলে নিজের সঙ্গে এমন প্রতারণা কেনো করবে!
উচ্চ শিক্ষা অর্জন করেও যারা কুশিক্ষার বেড়াজাল থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করতে পারেনি তাদের জন্যই কেবল ভুলুণ্ঠিত হচ্ছে শিক্ষার আদর্শ।
যৌন নিপীড়নের মাধ্যমে প্রতারণা করা বা প্রতারিত হওয়ার মতো ওই একটি কুকর্মের মধ্যেই ওদের কর্মকাণ্ড সীমিত নয়। পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায়, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে এমন ছেলেমেয়েরা সন্ত্রাস, ছিনতাই-রাহাজানি, হাইজ্যাক, ব্ল্যাকমেইলিংসহ মাদকাসক্তির মতো জঘন্যতম কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। অনেকেই স্বেচ্ছায় নামছেন দেহ ব্যবসায়।
কিন্তু কেন এই অধঃপতন? কেন অনেক শিক্ষিত ছেলেমেয়ে এতো ঘৃণিত কাজে লিপ্ত?
সত্য, আদর্শ ও ন্যায়নীতির প্রশ্নে যে ছাত্র সমাজ এককালে ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান গাইতেও ভয় পেতনা তাদের এ ভয়ানক করুণ পরিণতি ও অধঃপতনের জন্য আজ কারা দায়ী? শধু কি তারা নিজেরাই? পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, সমাজ, রাষ্ট্র থেকে শুরু করে মা বাবা বা অভিবাবকরাও কি এজন্য দায়ী নয়?
প্রত্যেক মা বাবাই সন্তানের ভাল চান। কিন্তু আমাদের সমাজে ‘ভালোর’ সংজ্ঞাটা ভালো ভাবে জানেন এমন মা বাবা কতজন রয়েছেন সেটাই ভাববার বিষয়। দেখা যায়, প্রতিটি মা বাবাই ছেলেমেয়েদের আধুনিক কায়দায় উচ্চ শিক্ষা দানের প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। সত্যিকারের শিক্ষা অর্জন করে আদর্শ মানুষ হিসেবে সমাজে দাঁড়াচ্ছে কিনা সে দিকটা বিবেচনায় আনার ক্ষেত্রে তারা একেবারেই বেখেয়ালি। বলতে দ্বিধা নেই, উচ্চ শিক্ষা অর্জনের নামে আমাদের ছেলেমেয়েরা আজ যে কুশিক্ষার অন্ধকারে ডুবতে বসেছে তার জন্য এ উদাসীনতা বা বেখেয়ালি মনোভাবও কম দায়ী নয়। তাই ওদের রক্ষা করতে হলে শুধু উচ্চ শিক্ষার পেছনে দৌড়ালেই চলবেনা, সত্যিকারের সুশিক্ষা দানের মাধ্যমে শুদ্ধ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হতে হবে। দেশ ও জাতিকে বাঁচাতে এর বিকল্প নেই।
সাজেদুল চৌধুরী রুবেল: আয়ারল্যান্ড প্রবাসী লেখক, Shajed70@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ১১২৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২, ২০১৪