ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

পাগলা সাহেব হিকি ও বেঙ্গল গেজেট

ফরিদ আহমেদ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২, ২০১৪
পাগলা সাহেব হিকি ও বেঙ্গল গেজেট

কলকাতায় ছিলেন এক পাগলা সাহেব। নাম ছিলো তাঁর জেমস অগাস্টাস হিকি।

একজন আইরিশম্যান তিনি।

এই পাগলা সাহেব, ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় কাজ করে গিয়েছিলেন। ভারত উপমহাদেশের সর্বপ্রথম ইংরেজি পত্রিকাটা বের হয়ে আসে তাঁর হাত দিয়ে। শুধু ইংরেজি বলে নয়, এটিই ছিলো ভারতে প্রকাশিত প্রথম পত্রিকা।

সালটা সতেরোশ’ সত্তর। শীতকাল। জানুয়ারি মাসের ঊনত্রিশ তারিখ। বের হয়ে এলো এক পত্রিকা। নাম বেঙ্গল গেজেট। কলকাতার ইতিহাসের প্রথম পত্রিকা। ভারতের ইতিহাসেরও। লন্ডন টাইমসও তখন বের হয় নি। বের হয়েছিলো এর আরো আট বছর পরে।

প্রতি সপ্তাহে বের হতো বেঙ্গল গেজেট। দুটি করে পাতা থাকতো। বারো বাই আট ইঞ্চি - এই ছিলো কাগজের আকার। দুই পৃষ্ঠাতেই ছাপা থাকতো তিন কলাম। তবে, খবর যতটা থাকতো, তার সমপরিমাণ থাকতো বিজ্ঞাপন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ভারতে থাকা ব্রিটিশ সৈন্যদের মধ্যে পত্রিকাটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শুধু ব্রিটিশদের মধ্যেই যে এটি জনপ্রিয় হয় তা নয়, ভারতীয়দেরকে বিশেষ করে কলকাতার বাঙালিদের বাংলা ভাষায় পত্রিকা প্রকাশের জন্য দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে। পত্রিকাটি দুই বছর চালু ছিলো।

হিকি সাহেব ছাড়া এই পত্রিকায় আর কোনো সাংবাদিক ছিলেন না। তিনিই এর সম্পাদক, তিনিই সাংবাদিক, তিনিই প্রকাশক। তিনি নিজে যে রকম খবর জোগাড় করতে পারতেন, সে রকমই ছাপতেন। তবে, রসালো কেচ্ছার প্রতি তার বেশ নজর ছিলো।

পাগলা হিকি লোকজনের নানা রকমের রসাল নামকরণ করে রসের হাট বসাতেন বেঙ্গল গেজেটে। কাউকে পরোয়া করতেন না তিনি। লাট সাহেবের প্রসঙ্গ থাকলেও বাদ যেতো না তা ছাপা হতে বেঙ্গল গেজেটে। লাট সাহেবের বউয়ের প্রতি কেনো যেন আক্রোশটা একটু বেশি ছিলো তাঁর। লেডি হেস্টিংসকে নিয়ে নানা ধরনের রসালো কাহিনী ফাঁদতেন তিনি।

পাগলা হিকির এই রকম পাগলামিতে অতিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন সাহেবরা। তাদের সব কেচ্ছা-কেলেংকারি ফাঁস করে দিচ্ছিলেন হিকি। তাদের নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করছিলেন প্রতিনিয়ত। ভয়ংকরভাবে আক্রমণ করছিলেন একেকজনকে। ধনী-দরিদ্র, উচ্চ-নিচ, কোনো কিছুর ভেদাভেদ ছিলো না হিকি সাহেবের কাছে। সুযোগ পেলেই তাদের দেহে বিষ ঢেলে দিতেন তিনি। হিকির এই কাজে লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস মহাখাপ্পা হয়ে উঠেছিলেন। হিকি যে শুধু তাকেই আক্রমণ করতেন তা নয়, তাঁর বউকেও ছেড়ে কথা বলতেন না।

তো ওয়ারেন হেস্টিংস তাকে জেলে পুরে দিলেন। হিকি সাহেব তাঁর পোর্টেবল ছাপাখান‍া নিয়ে ঢুকে গেলেন জেলের ভেতরে।

জেলখানা তাঁর জন্য নতুন কোনো জায়গা নয়। দেশে থাকার সময়ে হিকি কাজ করতেন মুদ্রাকরের। ভারতে এসেছিলেন ভাগ্যান্বেষণে। ব্যবসা করে ভাগ্য ফেরাবেন, এটাই ছিলো ইচ্ছা। ব্যবসা আরম্ভ করলেনও, কিন্তু ব্যবসা জমলো না। টাকা আয় করতে গিয়ে উলটো অনেক ধার দেনায় পড়ে গেলেন। সে ধার আর শোধ দিতে পারেন নি। ফলে দুই বছরের মতো জেল খেটেছিলেন।

সেই একই জায়গায় আবার ফিরে এসেছেন তিনি। কাজেই, খুব একটা বিকার নেই তাঁর। বরং এইবার পোর্টেবল ছাপাখানা আছে তাঁর সাথে। জেলে বসেই পত্রিকা চালু রাখলেন তিনি। বের হতে লাগলো বিষধর সব রিপোর্ট।

হেস্টিংস দেখলেন, এতো মহা বিপদ। পাগলা তো জেলে বসেও সেই একই কাজ করে যাচ্ছেন। ফলে, শেষ পর্যন্ত বাধ্য হলেন হিকির কাছ থেকে তাঁর পোর্টেবল ছাপাখানাটাকেও কেড়ে নিতে।

হিকি সাহেবেরও সাংবাদিকতার ইতি ঘটলো এখানে।

ফরিদ আহমেদ: ভূতপূর্ব শিক্ষক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বর্তমানে টরন্টো প্রবাসী

বাংলাদেশ সময়: ১৩৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।