অবশেষে কলম আমাকে ধরতেই হল। ফেসবুকে প্রকাশিত নীচের ছবিগুলো দেখে মন্তব্য করেছিলাম, ‘ছবি ১ (উপরের বাম দিক) দেখে বলা যায়, এটা একটা আত্মহত্যার ছবি।
আমার মন্তব্য দেখে ছবির আপলোডকারী জনৈক এমআর করিম রেজা লিখলেন- একজন ডাক্তার হিসেবে প্রথমেই আপনার গলা আর হাত শনাক্ত করতে পারা উচিত ছিল।
নিজের ক্রোধ সংবরণ করে জানতে চাইলাম, আপনি কি করে জানলেন যে, আমি কবজি ভুলভাবে শনাক্ত করেছি? অনুগ্রহ করে এ ধরনের মন্তব্য করার আগে দুইবার ভাববেন।
-আপনিও দ্বিধাযুক্ত মন্তব্যের আগে দুইবার ভাববেন। আপনি অন্য ছবি নিয়ে কেন কিছু বললেন না? যাই হোক, আমি ফরেনসিক মেডিসিন স্পেশালিস্ট নই।
-আপনি ফরেনসিক স্পেশালিস্ট না বলেই দ্বিধান্বিত, তবে আমি তো আর আপনার মত নই!
-ওগুলো বোধহয় মৃত্যু পূর্ব স্ট্রাগলিং এর দাগ।
প্রিয় পাঠক, এমআর করিম রেজার এ ধরনের মন্তব্য শুনতে আমি অভ্যস্ত নই। ফেসবুকের বদৌলতে তার খোঁজখবর নিয়ে জানলাম, তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করা একজন ডাক্তার, আমার চেয়ে ৩/৪ বৎসরের ছোট। তার এক ক্লাসমেট তাকে একজন স্বীকৃত বেয়াদব বলায় আমি মর্মাহত হলেও ব্যাপারটিতে সেখানেই ক্ষান্ত দিয়েছি। তারপরও উপরে উল্লেখিত ঘটনায় ডা. শামারুখের অপমৃত্যু নিয়ে কিছু লেখার এক ধরনের জেদ পেয়ে বসল। আজকাল ক্লান্তি আমাকেও পেয়ে বসেছে। অফিসের প্রশাসনিক কাজ, ছাত্রছাত্রী পড়ানো, মেডিকোলিগাল কাজ আর গবেষণা শেষে বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়াতেই বেশি স্বস্তি পাই।
তারপরও সাম্প্রতিককালে আলোড়ন জাগানিয়া মৃত্যুতে কলম ধরছি এই কারণে যে, আমার এই লেখা পড়ে কোন মানুষের মন থেকে যদি অহেতুক শংকা দূর করা যায়! দেশের মেডিকোলিগাল ব্যবস্থার কোন উন্নতি হয়!! আমি নিশ্চিতভাবেই জানি, স্পর্শকাতর মৃত্যুতে জনমত দুইভাগে বিভাজিত থাকে। দাঁড়িপাল্লায় একদিকে ওজনে ভারী থাকে পাবলিক, আর অন্যদিকে থাকে অরক্ষিত ফরেনসিক এর ডাক্তার আর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের সুফল ভোগকারী পক্ষ।
ফেসবুকের কল্যাণে ছবিতে নিহত ডাক্তার শামারুখের শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখে আজকাল অনেকেই বলতে দ্বিধা করছেন না যে, তাঁর শ্বশুর খান টিপু সুলতানের প্রভাবে বা দাপটে ময়নাতদন্তের রিপোর্টও বদলে যাবার পথে। আর এই খান টিপু সুলতান এর সংশ্লিষ্টতা সরকারি দলের সঙ্গে থাকায় তার বিরোধী পক্ষের তৎপরতাও চোখে পড়ার মত। জেনেছি, ইতিমধ্যেই ময়নাতদন্তকারী ডাক্তার তার প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। মৃতার আত্মীয়ের নারাজি দাখিলে পুনঃময়নাতদন্তের আবেদন আদালতে গৃহীত হয়েছে।
একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমি কোন পক্ষেই নমনীয় নই। বিদেশে থাকায় সেটির সম্ভাবনাও নেই। তাই এ ব্যাপারে মনে যা আসে তাই লিখব, পাঠক যা বোঝার, বুঝে নিন।
এ কথা সত্য, ছবি দেখে মন্তব্য করা উচিত নয়, যদি না তার মৌলিকত্ব নিশ্চিত হওয়া যায়। আজকাল ডিজিটাল ফটোগ্রাফিতে যেভাবে কাঁচি/ছুরি চালানো যায় তাতে ছবি দেখে মন্তব্য করা দুঃসাহসিক এক কাজও বটে। তারপরও ধরে নিলাম ছবিগুলো অবিকৃত।
উপরের বাম দিকের ছবিতে হাতের কব্জিতে যে সমান্তরাল কাটাদাগ/আঁচড় দেখা যায় সেটাকে নিশ্চিতভাবেই হেসিটেশন মারক বলা যায়। আর এই হেসিটেশন মারক সাধারণত আত্মহত্যায় দেখা যায়। বিধায় এ মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলা কোন বেঠিক কাজ হয়েছে বলে আমি মনে করি না।
তবে এখানে কথা থেকে যায়, কেউ যদি কাউকে হত্যা করে হাতে ওরকম আঁচড় কেটে দেয় তখন কি হবে? এ ক্ষেত্রে ফরেনসিক এর ডাক্তার হিসেবে আমি বলব, একটি মাত্র চিহ্নের উপর নির্ভর করে কখনও এ জাতীয় সিদ্ধান্তে আসা যায় না। যিনি ময়নাতদন্ত করেছেন, তাকেই বলতে হবে কিসের উপর ভিত্তি করে তিনি মৃত্যুর ধরনকে আত্মহত্যা বলছেন।
আমি যতটুকু জেনেছি, আত্মহত্যাকারিনীর পা ঝুলন্ত অবস্থায় মাটির সাথে লেগে ছিল। এটি যদি সত্য হয়ে থাকে তবে সেটিও আত্মহত্যাকেই নির্দেশ করে। ব্যাখ্যাটি এমন যে, আত্মহত্যাকারী আত্মহত্যা করবে বলেই মৃত্যুর আগে নিজের পা সোজা করে না। তারপর জ্ঞান হারালে, বাঁচার ইচ্ছা জাগলে সে আর নিজেকে রক্ষা করতে পারে না। একটি চিরকুট হয়ত সকল সমস্যার সমাধান দিতে পারত, অথচ এক্ষেত্রে তা পাওয়া যায় নি। আর হিস্টোপ্যাথলজি পরীক্ষায় যদি দেখা যায় যখমগুলো মৃত্যুপূর্ব, তাহলে সেটাও আত্মহত্যার পক্ষেই যাবে।
অন্য ছবি দেখে মন্তব্য করার আগে আত্মহত্যার স্থান, আত্মহত্যায় ব্যবহৃত দড়ি পরীক্ষা করতে হবে। তবে ফাঁসির দাগের অবস্থান আত্মহত্যাকে সমর্থন করে। গলার গোলাকৃতি যখমদ্বয় দড়ির গিরার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা তা নিশ্চিত হতে হবে।
আমি উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি, বাংলাদেশে মেডিকোলিগাল সার্ভিসের সুবিধা ভোগকারী জনগণের বিশাল একাংশের স্পর্শকাতর কোন মৃত্যুর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে সন্তুষ্ট হওয়ার নজির নেই বললেই চলে। কারণ হিসেবে বলা যায়, ময়নাতদন্ত নিয়ে জনমনে আস্থাহীনতা, অপব্যাখ্যা আর একপেশে খবর পরিবেশনা। দেশের মেডিকোলিগাল সার্ভিস এর ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত দুর্বল, মনোপলি কর্মকাণ্ড রোধের কেউ নেই, ফলে জনমনে ধারণা, রাজনৈতিক প্রভাব আর প্রতিপত্তি দিয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ওলটপালট করা সম্ভব। ক্ষেত্রবিশেষে, মেডিকোলিগাল সার্ভিস প্রদানকারীদের যোগ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ।
আধুনিক ব্যবস্থায় ময়নাতদন্তে সুইসাইড/হোমিসাইড/দুর্ঘটনা বলার দায়িত্ব ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা না নিয়ে বরং তদন্ত সংস্থাকে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে সহযোগিতা করে থাকেন। আলোচ্য স্পর্শকাতর মৃত্যুটির অধিকতর তদন্ত/বিশ্লেষণ প্রয়োজন ছিল। হতে পারে এটি আত্মহত্যা। কিন্তু ঘটনার পেছনের ঘটনা জানতে হবে। শাস্তি হতে হবে যারা তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত/প্রভাবিত করেছিল তাদের।
এ লেখা যখন শুরু করেছিলাম তখন আদালতের নির্দেশে ডা. শামারুখ এর লাশ দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্তের জন্য কবর থেকে উত্তোলনের আদেশ খবরের কাগজে এসেছে। আজ দেখলাম এই সব দিনরাত্রি’র টুনি চরিত্রের শিশু শিল্পী নায়ার সুলতানা লোপার লাশ উত্তোলনের আদেশ দেওয়া হয়েছে।
আমি জানি, পুনঃময়নাতদন্তে কোন সমস্যা নেই, তারপরও একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমি কি জানতে পারি, এসব লাশ উত্তোলনের হেতু কি? বিদেশে চব্বিশ বছরের কর্মজীবনে একটি মাত্র এক্সহিউমেশন বলে দেয়, এসব দেশের মেডিকোলিগাল সার্ভিসের মান।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে দেশের সর্বোত্তম ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ নিয়োজিত থাকার কথা। এখন কি সেখানে দলবাজি আর উচ্চতর কানেকশনে ডা. যদু আর ডা. মধুরা নিয়োজিত? তাই যদি হয়ে থাকে বিজ্ঞ আদালতের কাছে নিবেদন, দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্তের জন্য কবর থেকে উত্তোলনের চেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে যোগ্যতার ভিত্তিতে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ নিয়োগ অথবা যারা আছেন তাদের দক্ষতা বাড়ানোর আদেশ জরুরি। তা না হলে, যশোর অথবা স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে করা দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের ফল শূন্যই থেকে যাবে। কেননা শূন্যকে শূন্য দিয়ে গুণ করলে ফল শূন্যই থাকে।
পরিশেষে বলব, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরেনসিক বিভাগ খোলা হোক। উচ্চ শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে মানসম্মত ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ তৈরির পাশাপাশি স্পর্শকাতর ময়নাতদন্ত বা পুনঃময়নাতদন্ত সেখানে করা হলে জনমনে আস্থা ফিরে আসবে। আর যোগ্য ফরেনসিক প্যাথলজিস্ট দিয়ে করা ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন সঠিক বিচারের পথকে সুগম করবে বলে আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি।
লেখক: ভুতপূর্ব বিভাগীয় প্রধান, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বর্তমানে মালয়েশিয়ায় ইউনিভার্সিটি টেকনোলজি মারায় অধ্যাপক ও সিনিয়র ফরেনসিক পরামর্শক হিসেবে কর্মরত, nasimul@salam.uitm.edu.my
বাংলাদেশ সময়: ১২২৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৪, ২০১৪