৯ ডিসেম্বর। ফরিদপুরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এ দিনটি অবিস্মরণীয়।
দুপুর ১২টার দিকে যশোর-ফরিদপুর সড়কের করিমপুর এলাকায় সেনাবাহিনীর জিপ নিয়ে ঢুকে পড়েন এক পাকিস্তানি ক্যাপটেন। কমান্ডার সালাহউদ্দিন ওই পাকিস্তানি ক্যাপটেনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন।
গর্জে ওঠে তার হাতের এলএমজি। রক্তে ভেসে যায় পাকিস্তানি ক্যাপটেনের জিপ।
এর আধা ঘণ্টা পর যশোর থেকে আসা সেনা সাঁজোয়া বহর তিন দিক থেকে সালাহউদ্দিন বাহিনীর ৩৬ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে ঘিরে ফেলে।
শুরু হয় তুমুল সম্মুখযুদ্ধ। শহীদ হন সালাহউদ্দিন বাহিনীর ৬ যোদ্ধা –নউফেল, ওহাব, মুজিবর, দেলয়ার, আদেল ও সোহরাব। বাকি সহযোদ্ধাদের বাঁচাতে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও সাহসী সালাহউদ্দিন এলএমজি হাতে পাকিস্তানি সেনাবহরের সামনে দাঁড়িয়ে ব্রাশ ফায়ার করতে থাকেন। তাঁর ব্রাশ ফায়ারে অসংখ্য পাক সেনা রক্তাক্ত হয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে।
সালাউদ্দিন এর এই অসীম সাহসিকতায় পাকিস্তানি সেনারা দিদ্বিদিক ছুটতে শুরু করে। একটু পরেই সংগঠিত হয়ে ফের হামলা চালায় সালাহউদ্দিন বাহিনীর উপর। ততক্ষণে সালাউদ্দিনের গুলির মজুদ প্রায় শেষ। পরিস্থিতি বুঝে কৌশল পাল্টান সালাহউদ্দিন। তার নির্দেশে জীবন বাঁচিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যায় সহযোদ্ধারা। জীবন বাজি রেখে বুক চিতিয়ে এলএমজি’র ট্রিগার চাপতে থাকেন সালাহউদ্দিন।
হানাদারদের বহরে হতাহতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তবে সংখ্যায় বেশি হওয়ায় এক পর্যায়ে সালাহউদ্দিনকে ঘিরে ফেলে পাকিস্তানি সেনারা। ছুটে আসতে থাকে অসংখ্য গুলি। হঠাৎ হানাদারদের বুলেট এসে উড়িয়ে নেয় লাইট মেশিনগানের (এলএমজি) ম্যাগজিন। পিঠে এসে বিদ্ধ হয় আর একটি বুলেট। সহযোদ্ধারা কতোটা নিরাপদ দূরত্বে সরতে পেরেছে তা দেখার চেষ্টা করেন ঝাপসা চেখে। যে পথে সহযোদ্ধারা গেছে তা এড়িয়ে অন্য পথে চলতে শুরু করলেন বুলেটবিদ্ধ শরীর টেনে।
সাতশ’ গজ দূরে এসে মনে হয়, আর পারবেন না। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে বুকজোড়া পিপাসা। অনেক কষ্টে এক বাড়ির পাটাতনের নিচে আশ্রয় নেন অকুতোভয় বীর। হানাদাররা এসে ঘিরে ফেলে বাড়ি। সবাইকে গুলি করে মেরে ফেলে তো বটেই, বাড়ির ভেতরে আহত সালাহউদ্দিনকে রেখে আগুন ধরিয়ে দেয় চারিদিকে। জীবন্ত দগ্ধ হন আহত সালাহউদ্দিন।
১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পর ১৭ ডিসেম্বের ফরিদপুর হানাদার মুক্ত হলে সেই বাড়িতে শহীদ সালাহউদ্দিন এর কংকাল শনাক্ত করা হয় এবং সেদিনই তাকে ফরিদপুর এর আলিপুর কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র এক সপ্তাহ আগে ফরিদপুরের কানাইপুর এলাকার করিমপুরে সালাহউদ্দিন বাহিনীর এই মহান আত্মত্যাগ ও সাহসিকতা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গর্ব। আমাদের অহঙ্কার। আর তরুণ প্রজন্মের জন্য এ মহান ঘটনা দেশ প্রেমের অনবদ্য অনুপ্রেরণা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার্থে আমরাও জীবন উৎসর্গ করতে কুণ্ঠা বোধ করব না। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে আমাদের পূর্ব পুরুষরা যে স্বাধীন বাংলাদেশ আমাদের উপহার দিয়েছেন, সেই দেশকে আমরাই গড়ে তুলব আত্মনির্ভরশীল করে।
ডা. কাজী নাজিব হাসান: শহীদ কাজী সালাহউদ্দিন এর ভ্রাতুষ্পুত্র
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৮, ২০১৪