ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

সাদাসিধে কথা

মৃত ঘোড়া সমাচার

মুহম্মদ জাফর ইকবাল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪২৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৫, ২০১৪
মৃত ঘোড়া সমাচার

১.
আমি যখন খুব ছোটো তখন একদিন আমার বাবা আমার হাত দেখে বললেন, ‘তুই আশি বছর বাঁচবি’। শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো, কী সর্বনাশ! মাত্র আশি বছর? মনে আছে মনের দুঃখে সারারাত আমি ভেউ ভেউ করে কাঁদছিলাম এবং নানাভাবে আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে শান্ত করতে হয়েছিলো।



যাইহোক এখন আমার বয়স বাষট্টি এবং আমি জানি বেঁচে থাকার জন্যে আশি বছর অনেক। আমার কপালে সেটা জুটবে কিনা জানি না (যখনই কোনো জঙ্গি বাহিনীর খুন করার তালিকা উদ্ধার করা হয় সেখানে আমার নামটি থাকে!) যদি সত্যি সত্যি আশি বছর বেঁচে থাকতে পারি তাহলে একটা একটা নতুন বাংলাদেশ থেকে যেতে পারবো সেটা চিন্তা করে আজকাল আমি এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করি।

সেই শৈশব থেকে আমাদের দেশটি কতো বড় হতভাগ্য দেশ শুধু সেই কথাটিই শুনে এসেছি। যে দীর্ঘ সময় দেশের বাইরে ছিলাম তখন একটি বারও দেশ সম্পর্কে ভালো কিছু শুনি নি, সে দেশের যেকোনো সংবাদ মাধ্যমে বাংলাদেশ শব্দটি লেখা হলে সাথে সাথে সবাইকে মনে করিয়ে দেওয়া হতো এটি বন্যা, ঘূর্ণিঝড় দুর্ভিক্ষ, দুর্নীতি দরিদ্রতার দেশ।

আমি যখন দেশে ফিরে এসেছি আমার সবচেয়ে বড় আনন্দ ছিলো এখন কেউ আর আমার দেশের নামটি শুনে আমার দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকাবে না। আমার চোখের সামনে খুব ধীরে ধীরে আমাদের দুঃখী দেশটি একটি হাসি খুশি দেশে পাল্টে যাচ্ছে (যারা সেটি দেখতে পায় না এখন আমি তাদের জন্যে করুণা অনুভব করি)। এক সপ্তাহ আগে একজন আন্তর্জাতিক গবেষকের একটা লেখা পড়ছিলাম যে, বাংলাদেশের সমুদ্রের নিচে সম্ভবত ২০০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট গ্যাস রয়েছে। যদি সেটি ঠিক করে তোলা যায় তাহলে এই দেশটি পৃথিবীর গ্যাস সরবরাহকারী সবচেয়ে বড় একটি দেশ হয়ে যাবে।

আমি যখন এই লেখাটি পড়ছিলাম তখন আমার মনে হয়েছে সত্যি সত্যি এই গ্যাস আছে কি-না কেউ এখনো নিশ্চিত নয়, এই গ্যাস তোলা যাবে কি-না, সেটাও কেউ ভালো করে জানে না। কিন্তু বাংলাদেশের অন্য বিশাল একটি সম্পদ যে রয়েছে, সেই সম্পদ নিয়ে কারো কোনো সন্দেহ নেই এবং সেটি যে আমাদের গ্যাস সম্পদ থেকে অনেক বেশি মূল্যবান সেটি কেমন করে ভুলে যাচ্ছি?

সেই সম্পদটি হচ্ছে আমাদের স্কুলের ছেলেমেয়েরা। এই দেশে তিনকোটি শিশু-কিশোর স্কুলের ছাত্রছাত্রী, পৃথিবীর শতকরা আশিভাগ দেশে তিন কোটি মানুষই নেই! এই বিশাল সংখ্যার স্কুলের ছেলেমেয়েদের যদি আমরা লেখাপড়া শেখাতে পারি তাহলে এই দেশে যে কী অসাধারণ একটা ম্যাজিক ঘটে যাবে সেটা কি কেউ করতে পারবে? নতুন সহস্রাব্দে তেল গ্যাস কল কারখানা কিন্তু সম্পদ না, নতুন সহস্রাব্দে সম্পদ হচ্ছে জ্ঞান। আর সেই জ্ঞানটা তৈরি করতে, জমা করতে, বাড়িয়ে তুলতে দরকার মানুষ— আরো ঠিক করে বললে বলতে হয় ছাত্র-ছাত্রী। কাজেই আমাদের যে কী বিশাল একটা সম্ভাবনা একেবারে দরজায় কড়া নাড়ছে সেটি কি সবাই জানে?

শুধু কি তাই? আমাদের এই ছাত্রছাত্রীদের মাঝে ছেলে আর মেয়ের সংখ্যা সমান সমান। লেখাপড়া জানা এই মেয়েরা যখন ছেলেদের পাশাপাশি সব জায়গায় কাজ করবে, সিদ্ধান্ত নেবে, নের্তৃত্ব দেবে তখন যে বিপ্লবটুকু ঘটবে সেটা কি কেউ অনুভব করতে পারছে? আমরা সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করি, জঙ্গি বাহিনী নিয়ে দুর্ভাবনা করি, একটা শিক্ষিত মা কি কখনো তার সন্তানকে নারী বিদ্বেষী, ধর্মান্ধ দেশদ্রোহী হতে দেবে? দেবে না।

কাজেই দেশের অনেক মানুষ যখন নানা ধরনের দুঃশ্চিন্তায় হতাশাগ্রস্ত হয় আমি তখন ফুরফুরে মেজাজে ঘুরে বেড়াই। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার কোনো দুর্ভাবনা নেই।

২.
লেখাপড়া নিয়ে আমার এক ধরনের আগ্রহ আছে, কৌতূহল আছে। আমাদের দেশে ছেলেমেয়েদের ঠিক করে লেখাপড়া শেখানো চারটিখানি কথা নয় (সব স্কুলে একটা করে চক দিতে হলেই আশি হাজার চক কিনতে হবে!) সরকার এই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্যে এতো কম টাকা দেয় যে, সবকিছু গুছিয়ে করা সম্ভব না। তারপরও কাজটা খুব কঠিন তা আমার একবারও মনে হয় না।

একটা উদাহরণ দিই। আমাদের দেশে লেখাপড়ার মাঝে পরীক্ষার গুরুত্ব খুব বেশি। এই দেশের ছেলেমেয়েরা যেটুকু তার চাইতে তাদের বাবা মায়েরা জিপিএ ফাইভের জন্যে অনেক বেশি পাগল! পৃথিবীতে যতোদিন পরীক্ষা থাকবে ছাত্রছাত্রীরা ততোদিন পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেতে চাইবে। শুধু এই ব্যাপারটা মনে রাখলেই লেখাপড়ার অনেকটুকু এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। যেহেতু সবাই পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেতে চায় তাই পরীক্ষাটি হতে হবে অসম্ভব কৌশলী একটি পরীক্ষা। যেন পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের চেষ্টাতেই ঠিক ঠিক লেখাপড়া করতে পারে।

এখানে এই মুহূর্তে আমরা মার খেয়ে যাচ্ছি। সৃজনশীল পরীক্ষা ছিলো তার প্রথম ধাপ। কিন্তু আমি আবিষ্কার করেছি আমাদের শিক্ষকেরা এখনো ভালো সৃজনশীল প্রশ্ন করতে পারেন না। সেই সুযোগে সৃজনশীল গাইড বই বেরিয়ে গেছে, অনেক শিক্ষক সেটা ব্যবহার করছেন এবং যেখানে যেখানে এটা ব্যবহার হয়েছে সেখানে সৃজনশীল পরীক্ষার সত্যিকারের উদ্দেশ্যটা পুরোপুরি মাঠে মারা গেছে।

আমি ঠিক করেছি আমার সহকর্মীদের নিয়ে একটা উদ্যোগ নেবো এবং সারা পৃথিবীর উৎসাহী বাংলাদেশি তরুণদের সাহায্য নিয়ে এই দেশের ছেলেমেয়েদের জন্য অসংখ্য অসাধারণ সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করার ব্যবস্থা করে দেবো। (যারা সাহায্য করতে চায় তাদের জন্যে বলছি এর কাজ চলছে সময় হলেই crowd sourcing এর জন্য ডাক দেওয়া হবে। )

ভালো প্রশ্ন না হয়ে সাদামাটা প্রশ্ন একটা বড় সমস্যা ছিলো, এখন অন্যান্য সমস্যার তুলনায় এই সমস্যাটাকে অনেক ছোটো সমস্যা মনে হচ্ছে। যেহেতু এই দেশের প্রায় সব মানুষের ছেলে মেয়েরাই আজকাল স্কুলে লেখাপড়া করে তাই সবাই ব্যাপারগুলো মানে। একটা হচ্ছে, পাইকারিভাবে সবাইকে পাস করিয়ে দেওয়া— এতে পাস করার সংখ্যাটা বাড়ে কিন্তু লেখাপড়া তো বাড়ে না। আমরা সবাই প্রায় একইরকম আরেকটা ব্যাপার দেখেছি। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাল্য বিবাহের সংখ্যা কমিয়ে আনবে। এর জন্যে যে বুদ্ধি করেছে এরকম ফিছলে বুদ্ধি আমার জীবনে খুব কম দেখেছি। হঠাৎ করে শুনতে পেলাম মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ থেকে ১৬তে কমিয়ে আনবে।

তাহলে রাতারাতি এই দেশে বাল্যবিবাহের সংখ্যা নেমে আসতো কারণ ১৬ থেকে ১৮ বছরের যে মেয়েদের বিয়ে হতো তারা আর বাল্যবিবাহের হিসেবে আসতো না। আমরা জানি সম্ভাব্য এই বয়সেই এ দেশে সবচেয়ে বেশি বিয়ে দেওয়া হয়, এক কলমের খোঁচায় তাদের বিয়েটাকে বাল্য বিবাহের বাইরে ঠেলে নিতে পারলে পরিসংখ্যান চোখের পলকে সম্মানজনক হয়ে উঠতো। মোটামুটি একই কায়দায় পাসের হার বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে এবং দেখতে দেখতে আমরা দুটি ভয়ংকর ব্যাপার দেখতে পেয়েছি:

(এক) পরীক্ষার খাতায় দুই হাতে নম্বর দেয়া শুরু হয়েছে। (দুই) পরীক্ষার হলে ছেলেমেয়েরা দেখাদেখি শুরু করেছে, শিক্ষকেরা শুধু যে সেটা না দেখার ভান করছেন তা নয়, নিজেরাই প্রশ্নের উত্তর লিখে ছেলে মেয়েদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। আমি জানি আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় এটা অস্বীকার করবে, এটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে দাবি করবে, সরকারের অবদানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার হীন ষড়যন্ত্র বলবেন। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। এই দেশের প্রত্যেকের ঘরে স্কুলে যাওয়া ছেলেমেয়ে আছে, এই দেশের প্রত্যেকে এটা জানে!

সরকার আর স্কুলের শিক্ষক প্রচ্ছন্ন সমর্থনের এই দু’টি ব্যাপারের পাশাপাশি আরও একটি ঘটনা ঘটে চলেছে, সেটি হচ্ছে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস। এই প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করার জন্য মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেয়া বা ফেসবুক বন্ধ করে দেওয়ার পরিকল্পনার কথা শুনে আমরা বুঝতে পারছি আসলে মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় প্রশ্ন ফাঁসের আসল বিষয়টিই এখনো ধরতে পারেন নি।

মোবাইল ফোন বা ফেসবুক ব্যবহার করা হয় ফাঁস হওয়া প্রশ্ন বিতরণ করার জন্যে, যদি প্রশ্নটি ফাঁস না হয় তাহলে এটা কেউ বিতরণ করতে পারে না। প্রশ্ন ফাঁস হয় শিক্ষাব্যবস্থার সাথে জড়িত গুরুত্বপূর্ণ মানুষের কারণে। প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে আমি অনেক চিৎকার করেছি, এভাবে চিৎকার করতে ভালো লাগে না। এবার পিএসসির প্রশ্ন ফাঁসের পর সবাই চিৎকার শুরু করেছে। আশা করছি এবার হয়তো বিষয়টার একটা নিষ্পত্তি হবে। যদি না হয় তাহলে সবাইকে নিয়ে পথে নেমে আসা ছাড়া আমাদের আর কিছু উপায় থাকবে না।

কীভাবে পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি করা হয় আমি তার খোঁজ নিয়েছি, এখানে অনেকগুলো ধাপ এবং প্রত্যেকটা ধাপ থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে পারে। যেমন একটা দল প্রশ্ন করেন, অন্য একটা দল প্রশ্ন সমন্বয় করেন, অন্য আরেকটা দল প্রশ্ন টাইপ করেন, অন্য আরেকটা দল প্রুফ দেখেন, অন্য আরেকটা দল প্রশ্ন ছাপান, অন্য দল প্রশ্ন প্যাকেট করেন, অন্য আরেকটা দল বিতরণ করেন। কাজেই এই পদ্ধতিটা যতোক্ষণ পর্যন্ত পাল্টে না দেয়া হচ্ছে প্রশ্ন ফাঁসের ঝুঁকি থেকেই যায়।

এর বাইরে আরো একটা ব্যাপার আছে, পাবলিক পরীক্ষার এই প্রশ্নগুলোতে পরীক্ষা দেয় লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে। যে প্রশ্নে লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে পরীক্ষা দেয় তার চাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আর কী হতে পারে? কাজেই যারা এই প্রশ্ন করেন, সমন্বয় করেন, তাদের কি ঠিক তার সমান গুরুত্ব দেয়া হবে না? কিন্তু তাদের বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দেয়া হয় না, শুনেছি সাত আটশ থেকে হাজার খানেক টাকা সম্মানী দেয়া হয়। গতবার প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার পর তদন্ত কমিটি আমার সাথে কথা বলতে এসেছিলো। আমি তাদের বলেছিলাম যারা প্রশ্ন করবেন তাদের জন্য হোটেল সোনারগাঁয়ের একটা ফ্লোর ভাড়া করে সেখানে সবাইকে সপ্তাহ খানেক বা সপ্তাহ কয়েক রেখে দিতে হবে। যেন তারা নিশ্চিতভাবে পুরো সময়টা থেকে চমৎকার প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন। তদন্ত কমিটির সদস্যরা সবাই গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ছিলেন, তারা ভেবেছিলেন আমি ঠাট্টা করছি। আমি কিন্তু একেবারেই ঠাট্টা করি নি। আমলারা নিজেদের সুযোগ-সুবিধার জন্যে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করবেন কিন্তু শিক্ষকদের জন্য এক পয়সাও খরচ করতে রাজি নন!

৩.
লেখাপড়ার জন্য পরীক্ষার পরের বিষয়টা হচ্ছে ভালো পাঠ্যবই। আসলে বলা উচিৎ খু-উ-ব ভালো পাঠ্যবই। খুব ভালো পরীক্ষা নিতে যেরকম বাড়তি টাকা লাগে না ঠিক সেরকম খুব ভালো পাঠ্যবই তৈরি করতেও আসলে খুব বেশি বাড়তি টাকা লাগে না। আমরা যখন ছোটো ছিলাম তখন এই দেশের ছেলে মেয়েরা কেউ প্রাইভেট পড়তো না, কোচিং শব্দটার তখনো জন্মও হয়নি। যদিবা কখনো কাউকে প্রাইভেট পড়তে হতো তাহলে সেই কাজটাও করা হতো খুবই ‘প্রাইভেট’ভাবে অর্থাৎ খুবই গোপনে। কারণ এটাকে মোটেও সম্মানজনক ভাষা হতো না। স্কুলে স্যাররা যদি ভালো না হতেন তাহলে নিজেদেরকেই বইটা ভালো করে পড়তে হতো।  


কাজেই বইটা যদি ভালো হয় হাতলে পরিশ্রমী ছেলেমেয়েরা ভালো স্কুল, ভালো শিক্ষকের অভাবটুকু ভালো পাঠ্যবই দিয়ে পূরণ করে নিতে পারে। ভালো বই বলতে কী বোঝানো হয়, সেটা দেখার জন্য আমাদের ছেলে মেয়েদের স্কুলের পাঠ্যবইয়ের সাথে ইংরেজি মিডিয়াম (ও লেভেল এ লেভেল) স্কুলের পাঠ্যবইগুলো একবার তুলনা করতে বলবো। আমাদের দেশের শিক্ষাবিদদের ওরকম বই লেখার ক্ষমতা নেই আমি সেটা বলছি না, অবশ্যই আছে। কিন্তু আসলে সেভাবে উদ্যোগটা নেয়া হয় না।

আজকাল জাতীয় পাঠ্যসূচিতে ইংরেজি মাধ্যমে পড়া যায় সেই বইগুলো দেখলে চোখে পানি এসে যায়, এতো অযত্নে সেই বইগুলো তৈরি করা হয়েছে যে অবাক হয়ে যেতে হয়। এইচএসসির নতুন সিলেবাসে নতুন বই বের হয়েছে। কিন্তু যার সাথে কথা বলি সেই আমাকে জানায়, নতুন সিলোবাসে বইটি এমনভাবে লেখা হয়েছে যে, বিষয়টা বুঝতে হলে আবার বইগুলো পড়তে হয়। তাহলে নতুন বই লিখে লাভ কী হলো?

যারা দুর্বল ছাত্র, আত্মবিশ্বাসহীন ছাত্র, তারা সম্ভবত আরো কিছুদিন প্রাইভেট পড়বে, কোচিং করবে। কিন্তু যদি অসাধারণ কিছু পাঠ্যবই থাকে তাহলে দেশের অনেক পরিশ্রমী ছেলেমেয়ে হয়তো এই পাঠ্যবই পড়েই লেখাপড়া করে ফেলতে পারবে। স্কুলে ভালো শিক্ষক না থাকলেও একটা ভালো পাঠ্যবই দিয়ে পরিশ্রমী ছেলেমেয়েরা অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারবে।

তবে পাঠ্যবই নিয়ে কথা বলতে হলে আমি সব সময়েই এক জায়গায় এসে খুব আনন্দ পাই, সেটি হচ্ছে বছরের শুরুতে সব ছাত্রছাত্রীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া। প্রতি বছর যে পরিমাণ পাঠ্যবই ছাপানো হয়, আমি হিসাব করে দেখেছি সেগুলো একটার পর আরেকটা বসানো হলে ‍পুরো পৃথিবীটা তিন বার পাক খেয়ে আসবে! ছোট ছোট শিশু কিশোরেরা যখন তাদের নতুন বইগুলো বুকে চেপে ধরে হাসি মুখে বাসায় ফিরে যায় তার থেকে সুন্দর দৃশ্য পৃথিবীতে আর কিছু হতে পারে না!

৪.
ভালো লেখাপড়ার জন্য ভালো পরীক্ষা আর ভালো পাঠ্যবইয়ের জন্য কথা বলা হয়েছে কিন্তু এখনো সবচেয়ে জরুরি বিষয়টার কথা বলা হয়নি। সেটি হচ্ছে ভালো শিক্ষক। যখনই আমি একটা ভালো স্কুলের কথা শুনি তখনই আমি জানি নিশ্চয়ই সেখানে ভালো শিক্ষক আছেন। যে ছাত্রছাত্রীরা তাদের জীবনে একজন ভালো শিক্ষক পেয়েছে তার জীবনে একটুখানি হলেও পরিবর্তন হয়েছে।

ভালো একটা পরীক্ষা কিংবা খুব ভালো কিছু পাঠ্যবই ইচ্ছে করলেই পাওয়া সম্ভব। কিন্তু ভালো শিক্ষকের বেলায় সেটি সত্যি নয়। আমরা চাইলেই রাতারাতি দেশের সব স্কুলের জন্য ভালো ভালো শিক্ষক হাজির করতে পারবো না।

আশা করে আছি শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন স্কেল হবে এবং সেই স্কেলটা এতো লোভনীয় হবে যে, দেশের সেরা ছাত্রছাত্রীরা আগ্রহ নিয়ে শিক্ষক হবে। শুধু বেতন স্কেল নয়, আমি আশা করছি পাশাপাশি তাদের সম্মানটুকুও দেওয়া হবে। আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয় যে প্রাইমারি স্কুলের সাধারণ শিক্ষকেরা এই দেশে তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী। একজন শিক্ষককে আমরা তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী বলবো এটা কীভাবে সম্ভব?
 
৫.
জোট সরকার সরে যাবার পর এই দেশের শিক্ষাব্যবস্থাটা বেশ ভালোভাবে শুরু হয়েছিলো। পাঠ্যবইয়ে মুক্তিযুদ্ধের যে বিষয়গুলো সরিয়ে দেয়া হয়েছিলো সেগুলো ঠিকভাবে ফিরিয়ে আনা হয়েছিলো। শিক্ষানীতি করা হয়েছিলো, সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়েছিলো- সব মিলিয়ে দেশে শিক্ষা নিয়ে একটা উৎসাহের ভাব ছিলো। যখনই জরিপ করা হতো দেখা যেতো জনপ্রিয়তার শীর্ষে আমাদের শিক্ষামন্ত্রী। আমি নিজেও পুরো বিষয়টা নিয়ে খুব উৎসাহী ছিলাম।

তারপর ধীরে ধীরে কোথায় জানি এই গোলমালটা শুরু হয়েছে, আমরা দেখেতে পাচ্ছি, চোখের সামনে পুরো লেখাপড়ার বিষয়টিতে একটা গোঁজামিল দেওয়া শুরু হয়েছে। শিক্ষানীতিতে নেই তারপরও এই দেশের ছেলেমেয়েদের উপর জোর করে বাড়তি পাবলিক পরীক্ষা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। (সে জন্যে দিন রাত সবার কাছে গালাগাল শুনি, ছোট ছোট শিশুরা, তাদের বাবা-মায়েরা আমাকে অভিশাপ দেন। ) যদি এটা অনেক সুফল নিয়ে আসতো তাহলে কেউ কিছু বলতো না, সবাই মেনে নিতো।

কিন্তু তা ঘটেনি। বাড়তি পরীক্ষার চাপে ছোটো ছোটো শিশুদের জীবনের সব আনন্দ মাটি হয়ে গেছে। পরীক্ষার হলে দেখাদেখি করে ছেলেমেয়েরা পরীক্ষা দিচ্ছে। কোথাও কোথাও শিক্ষকেরা নিজেরা প্রশ্নের উত্তর ছাত্রছাত্রীদের পৌঁছে দিচ্ছেন। পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার পর শিক্ষক অভিভাবকেরা সমান উৎসাহে সেই প্রশ্ন বের করে তাদের ছাত্রছাত্রী কিংবা সন্তানদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। শিশুরা অবাক হয়ে দেখছে তাদের শিক্ষকেরা কিংবা তাদের বাবা মায়েরা এক ধরনের অসৎ মানুষ। সেই শিক্ষক কিংবা বাবা মায়েরা তাদের সন্তানদের সামনে কেমন করে মুখ দেখান?

আমি যখন পিএইচডি করছিলাম তখন আমাদের মাথায় নানা ধরনের আইডিয়া কাজ করতো, গবেষণা করতে করতে আমরা সবাই নিজেদের সেসব আইডিয়া কাজে লাগানোর চেষ্টা করতাম। কোনো কোনো আইডিয়া কাজ করতো কোনো কোনোটা করতো না। অমার প্রফেসর তখন আমাকে একটা কথা বলেছিলেন, সেটা আমি সারা জীবন মনে রেখেছি। আমাকে বলেছিলেন, তোমার আইডিয়া হচ্ছে একটা ঘোড়ার মতোন— যতক্ষণ লাফ ঝাঁপ দিচ্ছে সেটা নিয়ে নাচানাচি করো। সমস্যা নেই। কিন্তু যদি দেখো ঘোড়া মরে গেছে খবরদার ওটাকে নিয়ে টানাটানি কোরো না, যতো তাড়াতাড়ি পারো ওটাকে কবর দেবে।

আমাদের শিক্ষা পদ্ধতির কিছু কিছু ঘোড়া (পিএসসি পরীক্ষা, জেএসসি পরীক্ষা) মরে গেছে, শুধু তাই নয় মৃতদেহ থেকে রীতিমতো দুর্গন্ধ বের হতে শুরু হয়েছে। এখন যতো দ্রুত সম্ভব এগুলোকে কবর দিতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০০০১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।