শব্দ মাত্র দুটি। আর অক্ষর তা-ও সর্বসাকুল্যে দু’টি।
পাঠক, এতক্ষণে নিশ্চয়ই শব্দ দু’টি সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে উঠেছেন। শব্দ দু’টি হল ‘সর্বগ্রাসী ক্ষুধা’। বহুল ব্যবহৃত ও নেহায়েত আটপৌঢ়ে শব্দ দু’টি নিয়ে কেন আমার ব্যাকুলতা! কেন শব্দ দু’টি আমাকে পেয়ে বসেছে, পিছু পিছু হাঁটছে আর কেনই বা আমার তাড়িত হবার অথবা আত্মসমর্পণের অন্তহীন চিন্তা-ভাবনা, ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। প্রকৃতপক্ষে, শব্দ দু’টি অতি সাধারণ। এমন নয় যে, আমার কোনো পরিচয় ছিল না বা নতুন করে পরিচিতি লাভে সংকটের মুখোমুখি হতে হবে। এর কোনটিই নয়। তাহলে কেন শব্দ দু’টি আমাকে বিচলিত করে তুলেছে, ভাবনার জগতে এক বোধের জন্ম দিয়েছে, অল্প বিস্তর তা অনুভবে এনে কিছু কথা বলার জন্যই আমার আজকের লেখার অবতারণা।
গত সপ্তাহে যাচ্ছিলাম কুইন্স থেকে ব্রুকলিনে সহকর্মীর সঙ্গে দেখা করতে। বাড়ির কাছের সাবওয়ে স্টেশন অ্যাস্টোরিয়ার ৩৬ এভিনিউ থেকে ‘এন’ ট্রেনে উঠতেই একটি আসন পেয়ে গেলাম সৌভাগ্যক্রমে। আসনে একটু গুছিয়ে বসতেই পাশে বসা একজন তরুণ জানতে চাইল, আমি কী পরিশ্চমবঙ্গের না বাংলাদেশের। গত একুশ বছরে নিউইয়র্কে বসবাসকালে পথে হাঁটতে-চলতে-ফিরতে, হোক তা সাবওয়ে বা বাস এমনকি হাঁটাপথে সর্বত্রই একই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে, হচ্ছে। আমি একে বলে থাকি ‘পরিচয় সংকট’। ইদানীং পাল্টা প্রশ্ন করি, দেখে কী মনে হয়? শতকরা ৯০/৯৫ ভাগ মানুষই বলে থাকেন পশ্চিমবঙ্গীয়। (পরনে শাড়ি কপালে টিপ একই সঙ্গে দু’টির দৃশ্যমানতা পশ্চিমবঙ্গীয় ললনার প্রতিচ্ছবি বলে ধরে নেয়ার প্রবণতা আজও লক্ষণীয়)
যাহোক নিত্যদিনের একই প্রশ্নে অভ্যস্ত আমার জবাব জেনে তরুণটি বেশ স্বস্তির সাথে কথা বলতে শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্রে এসেছে আট/নয় মাস আগে। আইটিতে চাকরি করছে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে খুব ভাল করে একবার দেখে নেবার চেষ্টা করলাম এই ফাঁকে। অপরিচিতের সঙ্গে কথা বলার বিড়ম্বনা, প্রতারণার ফাঁদে পড়া অথবা ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে সর্বস্ব হারানোর মত ঘটনা নিউইয়র্ক শহরে নেই বললে সত্যের অপলাপ হবে। বয়স তার ত্রিশোর্ধ, তবে চল্লিশের নীচে বলে ধরে নেয়া যায়। মাথায় এক ঝাঁক কোঁকড়া চুল, উজ্জ্বল গাত্রবর্ণ, সহজেই মায়া জড়াতে পারে এমন একটি মুখাবয়ব। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, চোখের ভাষা অর্ন্তভেদী। মুখের ভাষাও প্রমিত।
তরুণটি জানায় মা তার আকস্মিক স্ট্রোকে পঙ্গু হয়ে শয্যাশায়ী। শিক্ষকতা করতেন। কথাগুলো বলে খানিকক্ষণ নিশ্চুপ সে। হাতে ধরা তা দু’টি বই, একটি ঝুম্পা লাহিড়ির, অন্যটি প্রমথনাথ বিশীর। জানাল বই পড়তে সে ভালবাসে। তবে সময়-স্বল্পতায় খুব বেশি পড়া সম্ভব হয় না এখন। তথাপি চেষ্টা চলছে। লেখালেখিতে তার আনন্দ। দৃষ্টি সুদূরে মেলে তরুণটি জানায়, এই আনন্দে অবগাহন করতে হলে সাহিত্যের সৃষ্টিশীলতার আবেগ-অনুভূতি ও শিল্পরসকে স্পর্শ ও উপলব্ধিতে নিয়ে এই জগতে বিচরণের পথ খুঁজতে হবে। অন্যথায় তা কল্পনাবিলাসে পর্যবসিত হতে বাধ্য। সে বলে, শুধু পড়ার জন্য পড়া নয়, সাময়িক আনন্দলাভের জন্যে নয়, বরং ‘সর্বগ্রাসী ক্ষুধা’ নিয়ে বই পড়া দরকার সাহিত্য চর্চার প্রয়োজনে।
অপরিচিত এই তরুণের সাহিত্যভাবনার কথাগুলো শুনতে শুনতে কখন যে মনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি, মন ছুটে চলে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে, হয়ে যাই অন্যমনস্ক। সাহিত্যচর্চার পরিধির বিশালত্ব সেই মুহূর্তে আমাকে ভাবিয়ে তোলে। তরুণের মুখের ‘সর্বগ্রাসী ক্ষুধা’ শব্দটি আমার ভেতর মনে আলোড়ন তোলে। মনে হয় সাহিত্যচর্চায় নিমগ্ন হতে হলে অন্তর-মনে শিল্পের প্রতি, সাহিত্যের প্রতি আনুগত্য ও অনুরাগের একটি জায়গা থাকা দরকার। সৃজনশীলতার সর্বপ্লাবী বিস্তারের মধ্যে একজন কবি, লেখক, গল্পকার ও ঔপন্যাসিকের মহৎ সৃষ্টিকর্মের সফলতা নির্ভর করে।
হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেলাম তরুণের কথায়, সে বলে যে সাহিত্য সম্পর্কে গভীর অনুসন্ধিৎসা না থাকলে সাহিত্য রচনায় প্রাণের সন্ধান মেলে না। নতুন কিছু সৃষ্টি হয় না। শিল্পকলার উদ্ভবের কথাও চমৎকারভাবে উচ্চারিত হয় তরুণের কণ্ঠে। স্বগোতোক্তির মত সে বলে চলে ভাষাকে আশ্রয় করেই শিল্পকলার শাখা বিস্তৃত হয় সাহিত্যের মধ্য দিয়ে। লেখকের সামাজিক দায়বদ্ধতার কথাও মূর্ত হয়ে উঠে তরুণের কথায়। দ্বিতীয় বার তার মুখের দিকে তাকিয়ে এক নির্বাক স্নেহে যেন তাকে জড়িয়ে নিলাম। স্টেশনের আগমনী বার্তা ঘোষিত হওয়ায় হঠাৎ সে উঠে দাঁড়ায় এবং মুখখানা ঈষৎ অবনত করে বলে, মার কথা মনে পড়ে যাওয়ায় এত কথা বলে ফেলেছি। আমি দুঃখিত। তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কিন্তু কানে বেজে চলেছে ‘সর্বগ্রাসী ক্ষুধা’ শব্দটি। লেখার শুরুতে আমি উল্লেখ করেছি যে, শব্দটি আমাকে গত ক’দিন ধরে তাড়া করে ফিরছে। সাহিত্যচর্চার প্রয়োজনে হোক, সাহিত্যপ্রেমী হওয়ার জন্যে হোক অথবা সাধারণ জ্ঞানার্জনের জন্যেই হোক ‘সর্বগ্রাসী ক্ষুধা’ নিয়ে বই পড়ার প্রয়োজনীয়তাকে কেউ অস্বীকার করতে পারে না, পারবে না। বই পড়ার বিকল্প নিয়েও কেউ বিতর্কে লিপ্ত হবে না-- এই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
কিন্তু ‘সর্বগ্রাসী ক্ষুধা’ যদি সমাজের অন্যসব উপাদানে সংযুক্ত হতে চায় এবং প্রবেশ করে সমাজের অলিগলিতে। প্রবেশ করে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। পচন ধরায় সকল অঙ্গ প্রত্যঙ্গে তখনই বিপদ দেখা দেয়। দেশ ও জাতির রক্ষাকবচ হিসেবে পরিচিত দেশের সংস্থা, প্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে আজ উপরতলা থেকে নীচ পর্যন্ত ‘সর্বগ্রাসী ক্ষুধা’ জেঁকে বসেছে । সর্বগ্রাসী ক্ষুধার তীব্রতা এতই বেড়েছে যে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যেও তা সংক্রমিত হয়েছে। যার ভয়াবহতার পরিণাম জাতি প্রত্যক্ষ করছে প্রতিনিয়ত। সর্বগ্রাসী ক্ষুধার্তদের ক্ষুধা নিবারণ করতে গিয়ে দেশ, জাতি ও সরকার আজ দেউলে হয়ে যাচ্ছে। ভেঙ্গে পড়েছে সকল অবকাঠামো। চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে দেশের নীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। ধূলায় গড়াগড়ি খাচ্ছে বাঙালির জাতীয়তা ও জাতিসত্তার সকল অহংকার। সর্বগ্রাসী ক্ষুধার দৌরাত্ম্য এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে মানুষ আর মানুষ থাকছে না। বাইরের অবয়ব ভিন্ন ভেতরের মনুষ্যত্বের চিহ্নমাত্র আর অবশিষ্ট নেই।
‘সর্বগ্রাসী ক্ষুধা’র হাতে মনুষ্যত্ব আজ জিম্মি। মনুষ্যত্বকে বাঁচাতে, মানবতাকে বাঁচাতে ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাঁচাতে ‘সর্বগ্রাসী ক্ষুধাকে’ নিবারণ করার প্রয়োজন। ‘সর্বগ্রাসী ক্ষুধা’র পাগলা ঘোড়ার রাশ শক্তভাবে টেনে ধরা দরকার রাষ্ট্রিক, সামাজিক ও সামষ্টিক উদ্যোগ, অঙ্গীকার ও শপথের। ‘সর্বগ্রাসী ক্ষুধা’ নিয়ে বই পড়াই কেবল পারে এ থেকে মুক্তি দিতে। এর চেয়ে বড় বিকল্প আর কী হতে পারে? জানি না; তাই তো শব্দ দুটি আমাকে তাড়া করে ফিরছে, সেই সঙ্গে ক্ষণিকের দেখা তরুণটি।
বাংলাদেশ সময়: ০৬২৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৪