কালের সাক্ষী অমর একুশে ক্রমেই এগিয়ে আসছে। মহান মাতৃভাষা দিবস, মহান একুশে! আত্মত্যাগের মহিমায় ভাস্বর এদিন।
আগুনঝরা দ্রোহ আর বাঙালি সত্তার জাগরণে অমর একুশের চেতনায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে ছিলাম আমরা সেদিন। একাত্তর পরবর্তীতে আবারও ২১ ফেব্রুয়ারির চেতনা আন্দোলনের স্মারক হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু কোনো যুদ্ধেই সত্যিকারভাবে বিজয় অর্জিত হয়েছে বলে মনে হয়নি।
অনন্য গৌরবের এ দিনগুলো নিয়ে স্মৃতি কাতরতা আর কত যুগ! কতকাল!
সেই বেদনাদীর্ণ হৃদয়ে প্রবাসে ও একুশের অম্লান চেতনাকে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগের সঙ্গে আমরা যুক্ত হয়েছি। গত কয়েক বছর সাধ্যানুযায়ী কানাডার এডমনটনে বাংলাদেশ কমিউনিটির কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থেকে উৎসব আয়োজনে সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে সহায়তা ও অনুপ্রাণিত করে আসছি।

প্রবাসে বাংলা ভাষার প্রসার নিয়ে লেখালেখি ও মৌলিক কিছু বিষয়ের ওপর কমিউনিটির নেতাদের সঙ্গে ভাববিনিময় করি। আমাদের পারস্পরিক উপলব্ধিতে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, পেশা ও সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী বাঙালি বা বাংলাদেশিরা কানাডার মূলধারার সমাজের সঙ্গে এখনো খুব একটা একাত্ম হতে পারেনি।
আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্ম তারাও আবার বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি এমনকি দেশের পরিচয় থেকে শেকড় উপড়ে ফেলতে চাইছে। বোদ্ধামহলে এ জন্য দেশে ক্রমাগত সন্ত্রাস ও সহিংসতা বৃদ্ধি, অসংযত রাজনীতি, পরিমিতিবোধহীন চর্চা এবং সর্বোপরি আইনের শাসনের অভাব পরিলক্ষিত হওয়াকে দায়ী করেছেন। এ কারণে এই প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা চরম হতাশায় নিমজ্জিত।
কানাডার গভর্নর জেনারেল ডেভিড জনস্টন ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ প্রেসক্লাব অব আলবার্টাকে (বিপিসিএ) গুরুত্বপূর্ণ এক বার্তা পাঠিয়েছেন। এ বার্তায় তিনি বলেন, [...] কানাডার সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি হলো, তার সমৃদ্ধ বৈচিত্র্য; যেখানে আমরা আমাদের বহুবৈচিত্র্য সংস্কৃতির জন্য একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে সারা বিশ্বের কাছে পরিচিত।
তিনি বলেন, যেখানে একটি সত্যিকারের বহুবৈচিত্র্য সংস্কৃতির সমাজ, একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে সারাবিশ্বের কাছে পরিচিত। আমি যখন দেশ জুড়ে নানা সম্প্রদায়ের বিভিন্ন নাগরিকদের সঙ্গে দেখা করি। তারা নানান ভাষায় কথা বলেন। সে সময় আমি ভীষণ গর্ববোধ করি।
ডেভিড জনস্টন বলেন, আজ এবং প্রতিদিন আসলে সবসময়, কানাডা তাদের স্থানীয় ভাষাকে উদযাপন এবং একে অপরের সঙ্গে তাদের ঐতিহ্য এবং দেশাচার রীতিগুলোর হিস্যা দেন। এর মাধ্যমে আমরা সবাই জানতে পারি যে, আমাদের মধ্যে কতটা সাধারণ মিল রয়েছে! [...]
কানাডার প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার বাংলাদেশ প্রেসক্লাব অব আলবার্টাকে পাঠানো তার আগাম বার্তায় বলেন, [...] যারা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন করছেন, তাদের আমি উষ্ণ শুভেচ্ছা জানাই।
তিনি এ সময় বলেন, কানাডার নিজস্ব ভাষাগত বৈচিত্র্য রয়েছে। এর দুটি দাফতরিক ভাষা ইংরেজি ও ফ্রেঞ্চের সঙ্গে আদিবাসী কানাডীয়ানদের মাতৃভাষা এবং আমাদের দেশের নবাগতদের পৈত্রিক ভাষার সংমিশ্রণ ঘটেছে।

এ সময় বাংলাদেশ প্রেসক্লাবের এ উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার।
এদিকে, কানাডার বিরোধীদলের নেতা থমাস মালকেইর, এমপিও প্রেসক্লাবের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে ‘বহুসংস্কৃতিবাদ’ প্রসারে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের আহ্বান জানান।
কানাডার আলবার্টা প্রদেশের লে. গভর্নর ডোনাল্ড এস ইথেল, স্পিকার জেনে ঝুজুস্কি, প্রিমিয়ার জিম প্রেন্টিস, আলবার্টা প্রদেশের কালচারাল অ্যান্ড ট্যুরিজম মিনিস্টার মাওরেন কুবিনিক ও ম্যানিটোবা প্রদেশের বহুসংস্কৃতিবাদ ও সাক্ষরতাবিষয়ক মন্ত্রী ফ্লোর মারসিলিনো, প্রিমিয়ারের লেজিসলেটিভ সেক্রেটারি সোহেল কাদরী, এমএলএ পৃথক পৃথক বাণীতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং বাংলাদেশের এ ঐতিহ্যের সঙ্গে কানাডার নিজস্ব ভাষাগত বৈচিত্র্যের সাংস্কৃতিক ঐক্যের বিষয়গুলোকেও তুলে ধরেছেন।
তারা তাদের বাণীতে মায়ের ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের বিষয়ে সমাজে সচেতনতা প্রসারে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস-২০১৫ দিবস একটি যথোপযুক্ত দিন।
বাংলাদেশ প্রেসক্লাব (বিপিসিএ) আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ওপর সম্প্রতি একটি তথ্যমূলক ওয়েবসাইট উদ্বোধন করেছে- http://motherlanguageday.ca/, যা প্রবাসে একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের তথ্যসূত্র হিসেবে কাজ করছে।
বাঙালির জাতীয়-সাংস্কৃতিক জীবনে ’৫২ থেকে এ পর্যন্ত দীর্ঘ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস এবং ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে সব কিছুই বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সামনে নিয়ে এসেছে এবং বাংলা সংস্কৃতির ধারাবাহিকতায় একুশে উদযাপন এখন গ্রাম আর শহরে সীমাবদ্ধ থাকেনি; দূরপ্রবাসেও এর ছোঁয়া লেগেছে।
কবি আহসান হাবীবের আবেগপূর্ণ ভাষায়, কোটি প্রাণের আবেগে আজও অমর হয়ে রয়েছে একুশে। আজও মাতৃভাষা এবং জননী জন্মভূমির সঙ্গে তা মিলেমিশে হয়েছে একাকার-
অতঃপর... কথারা যখন/জননীর কণ্ঠ থেকে মালা হ'য়ে ঝরে/ঝরে ফুল/কথার বকুল/আমাকে জড়ায়/তখন কেবল/জানি আমি কথারই জননী এবং জন্মভূমি//
অবিস্মরণীয় এ অমর একুশে বছর ঘুরে ফিরে ফিরে আসে। রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবহ এ দিন। বাংলাদেশ ও সারাবিশ্বে এখন ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে উদযাপিত হয়ে আসছে।
ইউনেস্কো- জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর তাদের ৩০তম সম্মেলনে ২৮টি দেশের সমর্থন নিয়ে দিনটিকে 'আন্তর্জাতিক

কানাডা থেকে আন্তর্জাতিক এ স্বীকৃতি আদায়ে আমাদেরই একজন সহযোদ্ধা মরহুম রফিকুল ইসলাম এবং তার সহকর্মীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। ভাষার জন্য বাঙালির বিরল এ আত্মত্যাগ ও প্রচেষ্টার কারণে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের বাইরে, কালের পরিক্রমায় এখন আন্তর্জাতিক মর্যাদায় মহীয়ান হয়েছে। ২০০০ সাল থেকে বিশ্বের ১৮৮টি দেশে একযোগে এ দিবসটি পালিত হচ্ছে। এ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বাঙালি জাতির জন্য এক অনন্য ও অসাধারণ অর্জন। কিন্তু একে আরো অর্থবহ করে তোলা প্রয়োজন।
ইতিহাস সাক্ষী, ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ থেকে স্বাধীনতা লাভের মাত্র এক বছর পরই বাঙালির আত্মঅধিকার আদায়ের সংগ্রামের নতুন এক যাত্রা শুরু হয়।
১৯৪৮ সাল থেকে মাতৃভাষা হিসেবে বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবি ওঠে। আর এর মধ্য দিয়েই স্বাধিকার সংগ্রামের বীজ বপন হয় কোটি মানুষের হৃদয়ে। ১৯৫২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি সেই আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে রক্তের আখরে।
’৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারি প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনকে ঘিরে সকালে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে পরিষদ ভবনের সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের প্রস্তুতি নিয়ে ছাত্ররা সমবেত হন, মেডিকেল কলেজ হোস্টেল গেটের সামনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা ও বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে। প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন ডাকা হয়েছিল বিকেল সাড়ে ৩টায়। কিন্তু উদ্ভুত পরিস্থিতিতে এর আগে থেকেই ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। এদিকে, আমতলার সভা থেকে ১৪৪ ধারা ভাঙার ঘোষণা আসামাত্র বিশ্ববিদ্যালয় গেট থেকে একের পর এক ১০ জনের মিছিল বের হতে থাকে। শুরু হয় ছাত্র-জনতার সঙ্গে পুলিশের রক্তাক্ত সংঘর্ষ।
একপর্যায়ে পুলিশ হঠাৎ করেই মেডিকেল হোস্টেল গেটের সামনে ও বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে জড়ো হওয়া ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালায়। এতে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন আবুল বরকত, রফিকউদ্দিন আহমদ ও আবদুল জব্বার।
২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত আবদুস সালাম ৭ এপ্রিল মারা যান। সেই থেকে একুশের দিনটি ‘মহান শহীদ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসে। শেষপর্যন্ত ১৯৫৬ সালের শুরুতেই গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানি সামরিক শাসক নতি স্বীকারে বাধ্য হয়।
পাকিস্তান গণপরিষদে ২৯ ফেব্রুয়ারি গৃহীত সংবিধানের মাধ্যমে ‘বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা’ হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
২০১৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে কানাডার এডমনটনে বাংলাদেশ-কানাডা অ্যাসোসিয়েশন অব এডমন্টন, বাংলাদেশ হেরিটেজ অ্যান্ড এথনিক সোসাইটি অব আলবার্টা, আলবার্টা বিশ্ববিদ্য্যালয়ের বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন ও অন্যান্য বাংলাদেশি সংগঠনগুলো নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিন করে।

এছাড়াও আলবার্টা প্রদেশের তৎকালীন প্রিমিয়ার এলিসন রেডফোর্ড কিউসি, স্পিকার জেনে জুঝডেস্কী, কালচারাল মিনিস্টার হেদার ক্লিমচুক, সহযোগীমন্ত্রী নরেশ বারদওয়াজ, সোহেল কাদরী এমএলএ এবং ইউনিভার্সিটি অব ম্যাকুইনের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ডব্লিউ এটকিনশন, সিটি মেয়র জন ইভেশন দিবসটির ওপর গুরুত্বারোপ করে বার্তা পাঠান।
এ বছর (২০১৫) সে প্রচেষ্টাকে আরো শক্তিশালী ও সুদৃঢ় করার অঙ্গীকারে সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করেছে বাংলাদেশ প্রেসক্লাব অব আলবার্টা, যা ইতোমধ্যে বেশ সমাদৃত হয়েছে। বিশ্বের ৬ হাজার ৩১০টি ভাষাভাষীর মানুষ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে নিজ নিজ ভাষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে, উদযাপন হবে এবারও একুশে ফেব্রুয়ারি।
কিন্তু দেশে-বিদেশে সামগ্রিক পরিস্থিতি ও পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষাপটে একে গুরুত্বপূর্ণ একটি কর্মসূচিতে রূপ দিতে সবার সম্মিলিত প্রয়াস দরকার। প্রবাসে শুধু স্মৃতিকাতরতা নয়, বরং দিনটির ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে যে বলিষ্ঠ উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ প্রেসক্লাব অব আলবার্টা, তা সর্বাত্মক সফল করে তুলতে সরকার ও সংবাদমাধ্যমসহ সবারই সহযোগিতা প্রয়োজন।

লেখক: দেলোয়ার জাহিদ, সভাপতি, বাংলাদেশ প্রেসক্লাব অব আলবার্টা, কানাডা, ফোন- ১ (৭৮০) ২০০-৩৫৯২।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০১৫