আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অন্য দশ দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে আলাদা। সবাই অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেননি সত্য, কিন্তু কেউ বসে থাকেননি।
জ্যোতিঃপাল মহাথের আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন। তাই তিনি ২০১৪ সালে মরণোত্তর একুশে পদক, ২০১১ সালে স্বাধীনতা পদক পেয়েছিলেন। স্বাধীনতার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় তাঁকে এই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
ব্রিটিশ শাসনামলে তদানীন্তন ত্রিপুরা বা বর্তমান কুমিল্লা জেলার লাকসাম থানাধীন কেমতলী গ্রামে ১৯১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন দ্বারিকা মোহন সিংহ নামে এক শিশু। এই অঞ্চলের বৌদ্ধদের পারিবারিক উপাধি হল ‘সিংহ’।
ঐতিহাসিক ব্যাখ্যায় বলা হয়, ২ হাজার ৫৫৮ বছর আগে জন্ম নেওয়া শাক্যবংশীয় রাজপুত্র সিদ্ধার্থের (পরবর্তীতে গৌতম বুদ্ধ) পারিবারিক নাম ‘শাক্যসিংহ’ থেকে এই অঞ্চলের বৌদ্ধরা ‘সিংহ’ উপাধি ধারণ করেন। ১৯৩৩ সালে ১৯ বছর বয়সে তিনি আগারিক জীবন থেকে অনাগারিক জীবনে প্রবেশ করেন। তাঁর নাম রাখা হয় জ্যোতিঃপাল শ্রামণ। পরে তিনি ১৯৩৮ সালে ১৪ জুলাই শুভ উপসম্পদা লাভ করে জ্যোতিঃপাল ভিক্ষু নাম ধারণ করেন। বৌদ্ধ ধর্মের উপর তাঁর উচ্চতর শিক্ষা ছিল।
তিনি ভারতের কলকাতা নালন্দা বিদ্যাভবন থেকে ত্রিপিটক বিশারদ উপাধি এবং ১৯৪৬ সালে কলকাতা সংস্কৃতি ও পালি বোর্ড আয়োজিত অভিধর্ম উপাধি পরীক্ষায় প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক লাভ করেন। তিনি আনুষ্ঠানিক উচ্চতর শিক্ষা লাভ না করলেও উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে প্রবেশিকা শ্রেণী পর্যন্ত পৌছান। দৃঢ়চেতা সার্বজনীন কল্যাণে উৎসর্গীত এই বৌদ্ধ ভিক্ষুর বর্ণাঢ্য জীবন কৃতিত্ব ও অর্জনে ভরপুর। তিনি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশি বৌদ্ধদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় গুরু ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বৃহত্তর সাংঘিক সংগঠন ভিক্ষু মহাসভার দশম সংঘরাজ ছিলেন। বৌদ্ধ ভিক্ষু হওয়ার পাশাপাশি তাঁর আরো অনেক পরিচয় আছে।
তিনি একাধারে একজন সাহিত্যিক, সংগঠক, শিক্ষানুরাগী, সমাজকর্মী, গবেষক, লেখক, কর্মবীর, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ব, সমাজ সংস্কারক এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। কুমিল্লার অনগ্রসর পশ্চাদপদ মানুষের জন্য তিনি আজীবন কাজ করে গেছেন। কুমিল্লার বিভিন্ন গ্রামে ৭টি বৌদ্ধ বিহার স্থাপন করেছেন। ১৯৪২ সালে লাকসামে একটি অনাথালয় স্থাপন করেন। জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে গরীব ছাত্র ও অনাথদের শিক্ষা ও বাসস্থানের জন্য তিনি এই অনাথ আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
১৯৪৬ সাল থেকে লাকসাম উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং পরবর্তীতে তাঁর একান্ত সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত লাকসাম থানাধীন হরিশ্চর ইউনিয়ন উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে বিনা বেতনে প্রায় ৩৩ বছর ধরে শিক্ষকতা করেন। তিনি ১৯৩৯ সালে বরইগাঁও পালি কলেজ, ১৯৪৮ সালে মৌমাছি পালন ও গবেষণা কেন্দ্র, ১৯৪৯ সালে কৃষকদের কল্যাণে কৃষক সমবায় সমিতি, বস্ত্র নির্মাণ, উল তৈরি ও ছাত্রদের সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেন। ১৯৮২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বশান্তি প্যাগোডা ও ছাত্রাবাস, ১৯৯১ সালে নারী শিক্ষার বিস্তারে কুমিল্লায় বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া ১৯৯১ সালে বালক উচ্চ বিদ্যালয়, ১৯৬৮ সালে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে কুমিল্লার শিক্ষা বিস্তারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাই কুমিল্লা অঞ্চলে তিনি বৌদ্ধদের কাছে নন্দিত ধর্মগুরু, মুসলমানদের কাছে মানবদরদী পীরতুল্য ব্যক্তিত্ব এবং হিন্দুদের কাছে পবিত্র গুরু হিসেবে শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন।
কর্মতত্ত্ব, উপ-সংঘরাজ গুনালংকার মহাস্থবিরের আত্মজীবনী, পুগ্গল পঞঞতি, বোধিচর্যাবতার, সাধনার অন্তরায়, প্রজ্ঞাভূমির নির্দেশ, ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের উত্তান-পতন, ব্রহ্মবিহার, চর্যাপদ, বুদ্ধের জীবন ও বাণী, রবীন্দ্র সাহিত্যে বৌদ্ধ সাহিত্য, বৌদ্ধ সংস্কৃতি, সৌম্য সাম্যই শান্তির কারণ, ভক্তি শতকম, বৌদ্ধ ধর্মীয় শিক্ষা, বৌদ্ধ ধর্ম সংস্কৃতির ক্রমবিকাশ ও পঞ্চবুদ্ধ, মালয়েশিয়া ভ্রমন কাহিনী, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম এবং পালি বাংলা অভিধান সম্পাদনা তাঁর গভীর পাণ্ডিত্যের পরিচয় বহন করে। তাঁর গবেষণাধর্মী গ্রন্থের মধ্যে চর্যাপদসহ কয়েকটি বই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচ্যভাষা বিভাগে পাঠ্যপুস্তক রূপে পঠিত হয়ে আসছে।
বহুমুখী প্রতিভাবান কীর্তিমান জ্যোতিঃপাল মহাথের জীবনে অনেক সম্মাননা পেয়েছিলেন। তাঁর কর্ম প্রতিভা এক সময় দেশের মাটিকে ছাড়িয়ে যায়। তিনি হয়ে ওঠেন বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব।
১৯৯৫ সালে বিশ্বের সর্বোচ্চ সংগঠন জাতিসংঘ বিশ্বশান্তি মানবতা ও নিরস্ত্রীকরণের ক্ষেত্রে অমূল্য অবদানের জন্য তাঁকে ‘বিশ্ব নাগরিক’ উপাধি দেন। এই দুর্লভ উপাধি প্রাপ্তিতে তিনি হয়ে গেলেন বিশ্বজনীন ধর্মগুরু। এই উপাধি দ্বারা তিনি নিজে একা গর্বিত হননি, গর্বিত হয়েছেন পুরো বাঙালি জাতি ও দেশবাসী। ১৯৭৫ সালে তিনি এশীয় বৌদ্ধ শান্তি সংস্থার বাংলাদেশ জাতীয় কেন্দ্রের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ১৯৭৬ সালে জাপানে অনুষ্ঠিত হিতোসি বার্ষিকী ও মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলান বাটোরে অনুষ্ঠিত সাধারণ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। এশীয় বৌদ্ধ শান্তি সংস্থা মঙ্গোলিয়া হতে ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে স্বর্ণপদকে ভূষিত করা হয়।
সমাজ, জাতি এবং দেশের প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক পরিসরেও তাঁর দীপ্ত পদচারণা ছিল। ভারত, নেপাল, চীন, জাপান, শ্রীলংকা, মায়ানমার, সিঙ্গাপুর, হংকং, রাশিয়া, মালয়েশিয়া, মঙ্গোলিয়া, কোরিয়া, আমেরিকাসহ বিশ্বের অনেক দেশে পরিভ্রমণ করেন। তিনি বাংলা ভাষা ছাড়াও ইংরেজি, হিন্দি, সংস্কৃত, বার্মিজ, সিংহলি, সিলোনিজ ভাষা জানতেন।
তাঁর গৌরবোজ্জ্বল সাংঘিক জীবনের এক অসাধারণ গুণ হল নিখুঁত দেশপ্রেম। পাক বাহিনীর বর্বরতা সম্পর্কে যাতে বিশ্ববাসী সহসা জানতে না পারে তৎজন্য তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার সকল বিদেশি সাংবাদিককে পাকিস্তান ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। অবশ্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেউ কেউ আত্মগোপনে থেকে গিয়েছিলেন। তাঁরা পাকিস্তানি বর্বরতার সংবাদ সচিত্র তুলে ধরে বিশ্ববিবেককে নাড়া দিয়েছিলেন। তবে বিশ্ব জনমত গঠনে জ্যোতিঃপাল মহাথের’রও অনন্য ভূমিকা ছিল।
এপ্রিল মাসের শেষের দিকে আগরতলার বাংলাদেশ মিশনের পূর্বাঞ্চলীয় বিভাগের বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরী, মাহবুব আলম চাষী, সৈয়দ আলী আহসান, এইচ টি ইমাম, আকবর আলী খান প্রমুখের সাথে তাঁর যোগাযোগ হয়। তাঁদের সাথে আলোচনার পর তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে বিশ্ব বৌদ্ধদের তথা বিশ্ববাসীর মধ্যে জনমত গঠনের সিদ্ধান্ত নেন।
তিনি উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন, পাক সামরিক বাহিনীর গণহত্যা, নির্যাতন বন্ধের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি অপরিহার্য। তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী সহযোগীদের পরামর্শ নিয়ে বাংলাদেশে পাক-বাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতনের বিবরণ সম্বলিত প্রচারপত্র তৈরি করেন।
জাতিসংঘের তদানীন্তন মহাসচিব মি. উ থান্ট এবং শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েকসহ পৃথিবীর সকল দেশের বিশ্ব বৌদ্ধ সৌভ্রাতৃত্ব সংঘের আঞ্চলিক শাখা ও বৌদ্ধ সমিতিগুলোর কাছে বাংলাদেশে পাকিস্তানি গণহত্যা ও নির্যাতন বন্ধে চাপ সৃষ্টির আবেদনপত্র পাঠান। এদিকে মুজিব সরকার এবং ভারত এশীয় বৌদ্ধ দেশগুলোতে প্রতিনিধি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। এ সিদ্ধান্ত পূর্বাঞ্চলিক মিশনের অন্যতম কর্মকর্তা এইচ টি ইমাম সাহেবকে টেলিগ্রামে জানানো হয়।
টেলিগ্রামে জ্যোতিঃপাল মহাথের এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের মানরাজা মংপ্রুসেইন চৌধুরীকে মুজিব নগরে পাঠানোর কথা বলা হয়। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে জ্যোতিঃপাল মহাথের মুজিব নগরে উপনীত হন। সেখানে হাইকমিশনার আলী হোসেন, আবদুল করিম চৌধুরী, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, মাহবুব আলম চাষী প্রমুখ তাঁকে বিদেশ গমনের উদ্দেশ্য এবং করণীয় সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ধারণা দিলেন। জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে তিনি আগরতলা থেকে কলকাতা এবং পরে নয়াদিল্লি গেলেন।
নয়াদিল্লিতে জগৎজ্যোতি বিহারের অধ্যক্ষ ভারতীয় রাজ্যসভার সদস্য ধর্মবীরিয় ভিক্ষুর সহায়তায় ভারতের বৌদ্ধ নেতা এবং সংসদ সদস্যদের সাথে দেখা করেন। ২৯ জুলাই তিনি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ করে বাঙালি জনগণ এবং বৌদ্ধদের উপর চলমান বর্বরতার বর্ণনা দেন। ৭ আগস্ট অ্যাডভোকেট ফকির সাহাবুদ্দিন সাহেবসহ তিনি যাত্রা করেন শ্রীলংকার উদ্দেশে।
উল্লেখ্য, যুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের স্থলপথ ও আকাশপথ এক প্রকার বিচ্ছিন্ন ছিল। শুধু কলম্বো বিমানবন্দর হয়ে বাংলাদেশে উড়োজাহাজ চলাচলের সুবিধা ছিল। তাঁরা শ্রীলংকাকে বুঝাতে সক্ষম হলেন যে, পাকিস্তানি উড়োজাহাজের মাধ্যমে বাংলাদেশে সৈন্য (৫০০ করে) এবং অস্ত্র পাঠানো হচ্ছে। তাঁরা পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য শ্রীলংকার আকাশপথ বন্ধ করে দেওয়ার জন্য পাঁচ মন্ত্রীর স্বাক্ষরিত একটি আবেদনপত্র তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েকের কাছে পেশ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে পরদিন থেকে পাকিস্তানি বিমানের যাতায়াত বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে করে পাকিস্তানের যুদ্ধের মূল চালিকা শক্তি সেনাদের রসদ, গোলাবারুদ ও অস্ত্র সরবরাহ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়।
এরপর তিনি এবং শাহাবউদ্দিন সাহেব ১১ আগস্ট থাইল্যান্ড, ১৬ আগস্ট জাপানে একই কাজ করলেন। পরে ২২ আগস্ট জ্যোতিঃপাল মহাথের হংকং হয়ে নয়াদিল্লি প্রত্যাবর্তন করেন এবং শাহাবউদ্দিন সাহেব হংকং থেকে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর পরিভ্রমণ করে দিল্লি ফিরে আসেন। ১৮ ও ২০ সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত আর্ন্তজাতিক সম্মেলনে আমন্ত্রিত প্রতিনিধি হিসেবে জ্যোতিঃপাল মহাথের অংশগ্রহণ করেন।
এ সম্মেলনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. এ আর মল্লিক ও সৈয়দ আলী আহসান ছিলেন অন্যতম প্রতিনিধি। সম্মেলনে ৩১টি দেশের প্রতিনিধি যোগদান করেছিলেন। প্রথম দিনের সম্মেলনে প্রথম বক্তা ছিলেন ড. এ আর মল্লিক। তিনি তাঁর দীর্ঘ এক ঘণ্টার বক্তব্যে বাংলাদেশে পাক-বাহিনীর নৃশংস গণহত্যা, ধর্ষণ এবং নির্যাতনের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ দেন। তাঁর ভাষণের পর পাকিস্তান সরকারের প্রতি উপস্থিত প্রতিনিধিরা নিন্দা ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠেন। এ সম্মেলনে যোগদানকারী বৌদ্ধ প্রতিনিধিদের জ্যোতিঃপাল মহাথের দিল্লির জগৎজ্যোতি বিহারে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যান এবং সেখানে তিনি এ দেশের মানুষের উপর পাক-বাহিনীর অত্যাচারের বিবরণ বিশদভাবে তুলে ধরেন। জ্যোতিঃপাল মহাথের সম্পর্কে কুমিল্লার প্রাক্তণ সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ আবুল কালাম মজুমদার লিখেছেন, ‘আমি জানি যে, একমাত্র জ্যোতিঃপাল মহাথের ব্যতীত বাংলাদেশের অন্য কোন ধর্ম সম্প্রদায়ের উর্দ্ধতন ধর্ম-যাজক বাংলাদেশ স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদান করে সহযোগিতা করেননি।
কিন্তু তিনি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মাতৃভূমি উদ্ধার কল্পে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
কুমিল্লা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার মোঃ জহিরুল ইসলাম লিখেছেন, বাংলার বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে স্বাধীনতা আন্দোলনে উচ্চ পর্যায়ে আন্তর্জাতিক সংগঠক রূপে সহযোগিতা করেছেন কুমিল্লা নিবাসী মাননীয় জ্যোতিঃপাল মহাথের।
জ্যোতিঃপাল মহাথের আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠনে পরিপূর্ণভাবে সফল হয়েছিলেন। বিশেষ করে বৌদ্ধ রাষ্ট্রগুলোকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন। অবশেষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি নিজ সাধনপীঠ কুমিল্লা প্রত্যাবর্তন করেন এবং ১০ জানুয়ারি তিনি ঢাকায় উপনীত হন। সেখানে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রধান সম্পাদক সাংবাদিক দেবপ্রিয় বড়ুয়ার (ডি. পি. বড়ুয়া) ধানমন্ডির বাড়িতে উঠলেন।
ধানমন্ডির বাসায় অবস্থানকালে বাংলা সাহিত্যের দিকপাল সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি সদ্য কারামুক্ত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। জ্যোতিঃপাল মহাথের তাঁর মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের ভিত্তিতে প্রণীত ‘বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামে” গ্রন্থে (১৯৭৭) লিখেছেন- ‘আমি যখন বঙ্গবন্ধুর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম তখন আমার এক পার্শ্বে বঙ্গবন্ধুর তদানীন্তন প্রেস সেক্রেটারি জনাব আমিনুল হক বাদশা এবং আরেক পার্শ্বে মুজিবনগরের পরিচিত এক বন্ধু। জনাব বাদশা বঙ্গবন্ধুর সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং বাংলাদেশে আন্দোলনে আমার ভূমিকা সর্ম্পকে বলতে আরম্ভ করলেন। বঙ্গবন্ধু আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আমিও তাকে জড়িয়ে ধরলাম এবং বললাম, না, আমি বাংলাদেশের জন্য কিছু করতে পারিনি। তবে দেশ বিদেশে গিয়ে মানুষের কাছে বাংলাদেশের জন্য কেঁদেছি। তিনি আমার কথা শুনে খুব আনন্দ ও বিস্ময় প্রকাশ করলেন। ’
দেশপ্রেমে উদ্দীপ্ত পূণ্যপুরুষ জ্যোতিঃপাল মহাথের’র বর্ণাঢ্য জীবন প্রদীপ নিভে যায় ৯২ বছর বয়সে ২০০২ সালের ১২ এপ্রিল। জীবদ্দশায় তাঁর সান্নিধ্যলাভের সৌভাগ্য আমারও হয়েছিল। জীবনের প্রান্ত সীমানায় উপনীত হওয়ার পরও তাঁর সারগর্ভ, তথ্যবহুল ঐতিহাসিক বক্তব্য এবং বাচনভঙ্গি ছিল অন্তরছোঁয়া। এক জীবনে জাতি, সমাজ, ধর্ম, রাষ্ট্র এবং মানবতার জন্য কাজ করার সৌভাগ্য সবার হয় না। কিন্তু জ্যোতিঃপাল মহাথের ছিলেন সেই সৌভাগ্যশালী মহান ব্যক্তিত্ব। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক জ্যোতিঃপাল মহাথের’র মৃত্যুতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা শোকবার্তা জানিয়েছিলেন। বাংলাদেশের সৃষ্টিতে জ্যোতিঃপাল মহাথের’র অবদান এবং ভূমিকাকে রাষ্ট্র নায়করাও সম্মান দেখিয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০১৫
জেডএম/