সব ধরনের মিডিয়া, ফোনে-চায়ের দোকানে, ঘরে-বাইরে সর্বত্র একটি কথাই উচ্চারিত-আলোচিত হচ্ছে। পহেলা বৈশাখে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের টিএসসি সংলগ্ন গেটের কাছে কতিপয় পশু, বেজন্মাদের পাশবিকতার ঘটনা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, মহিলা বিষয়ক মন্ত্রী, সংসদের ৩০ সেট অলঙ্কারখ্যাত ৩০ জন নারী সংসদ সদস্যরা কেউ কিছুই বলেননি। অগ্নিকন্যাখ্যাত মতিয়া চৌধুরী, সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিবাদী কন্ঠস্বর তারানা হালিম এমপি, তুখোড় বিতার্কিক সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপুমনি, বিএনপির সেই ফ্যান্টাস্টিক ফাইভখ্যাত পাপিয়া, নীলুদের দলও কিছুই বলছেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রক্টরের কোনো দ্বায়িত্ববোধ আছে কি না? তাও বোঝা যাচ্ছে না। লাল-নীল-সাদা দলে বিভক্ত শিক্ষকবৃন্দ, ক্যাম্পাসে বহাল ছাত্র-ছাত্রলীগ, বেহাল ছাত্র-ছাত্রীদল কারোই যেন কোনো দায়-দায়িত্ব নাই। বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়ন ও দারিদ্র বিমোচনের ইজারাদার এনজিওরা কুম্ভকর্নকেও হার মানাচ্ছে। এমনকি এই মুহুর্তে, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মেয়র এবং অন্যান্য প্রার্থীরাও কিছু বলছেন না। তারা নাকি নিরাপদ, সুন্দর, সবুজ, আধুনিক ঢাকা উপহার দিবেন। একজন তো ঝাড়ু হাতে ভারতীয় মডেলে নেমেছেন। তিনি যদি ঐ ঝাড়ু হাতে একটিবারের জন্যও টিএসসিতে যেতেন, তাহলে রাস্তা ঝাড়ু দেয়ার নির্বাচনী অভিনয়ের চেয়ে বেশি লাভবান হতে পারতেন।
অনেক অনেক দায়িত্বশীল, ক্ষমতাবান নারী-পুরুষ এবং ভোট প্রত্যাশীদের কথা উল্লেখ করলাম। কারণ তারা কিছু না কিছু করতে পারতেন, কিন্তু কিছুই করেনি। শাহবাগে, টিএসসিতে পুলিশ আছে কেন? তাদের কাজটা কি? এটা এখন মিলিয়ন ডলার প্রশ্নের চেয়েও বড় প্রশ্ন। জানমালের নিরাপত্তার প্রশ্ন। সম্ভ্রম রক্ষার প্রশ্ন। সরকার, বিরোধীদল মিলে দিনে দিনে কোন ধরনের আগামী বাংলাদেশ বানাচ্ছেন, এটা আমাদের কাছে পরিস্কার।
প্রধানমন্ত্রী প্রায়শই কান্নামিশ্রিত কন্ঠে তার স্বজন হারানোর কথা উল্লেখ করে দাবি করেন, তিনি মানুষের দুঃখ-কষ্ট বোঝেন। এই তো সেদিন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া পুত্রশোকে অঝোরে কাঁদলেন। কিন্তু তাদেরকে তো দেশের সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্টে কাঁদতে দেখি না। দেশের মানুষ বুঝতে পারছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাবান এবং ক্ষমতাহীনরা শুধুমাত্র ক্ষমতাপুষ্পের সৌরভ চায়, আর কিছু নয়। এতো বড় একটি ঘটনা ঘটলো অথচ ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতাহীনরা একই রকমভাবে নির্লিপ্ত, উদাসীন আচরণ করছে। কী অসাধারণ ঐক্য! রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লাস্কির মতে, উদাসিনতা এবং নির্লিপ্ততা কুনাগরিকের বৈশিষ্ট্র। রাষ্ট্র ক্ষমতা কুনাগরিকদের হাতে চলে গেলে নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তা থাকে না। দেশের মানুষ তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
গত দুইদিনে একটি বিষয় চোখে পড়েছে। হাইকোর্টের দু’জন বিচারপতি স্ব:প্রণোদিত হয়ে একটি রুল জারি করেছেন। উক্ত রুলে বলা হয়েছে, চার সপ্তাহের মধ্যে স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার, পুলিশের রমনা জোনের উপ-কমিশনার ও শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে রুলের জবাব দিতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- এটা কি ‘উচ্চপদস্থ তদন্ত কমিটি’র নতুন রূপ কি না? এসবের ফলাফল শেষ পর্যন্ত কী হয়, তা বাংলাদেশের মানুষ জানে।
ভীষণ পীড়াদায়ক ব্যাপার হচ্ছে- ইতোমধ্যেই বেশ কিছু অমানুষ বলাবলি শুরু করছে যে, মেয়েদের পোশাক নাকি উত্তেজক ছিল। উগ্র ছিল, তাই তারা আক্রমণের শিকার হয়েছে। বেদনার সঙ্গে বলতে হচ্ছে, আপনারা কি জানেন? দক্ষিণ ভারতের মেয়েরা সালওয়ার -কামিজ পড়ে কিন্তু কোনো ধরনের ওড়না পড়ে না। তারা কিন্তু কোনো বেজন্মাদের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে না। ইউরোপ, আমেরিকা, পূর্ব এবং উত্তর এশিয়ার সব দেশেই মেয়েদের পোশাক-আশাক ছেলেদের চেয়ে ছোট-খাটো, কই সেখানে তো কোনো সমস্যা হচ্ছে না। শত শত বছর ধরে এটা চলে আসছে। বাংলাদেশের গ্রামের সাধারণ নারীরা এখনও ব্লাউজ পরে না, সবার সামনে বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন, এটা তো কারো কাছে অশ্লীল মনে হয় না। তারা পুরুষের সঙ্গে একই পুকুরে গোসল করে, পুকুর পাড়ে কাপড় পরিবর্তন করে। কই কোথাও তো কেউ তাদের পোশাক নিয়ে, চলাফেরা নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। তাহলে ঢাকা শহরের মতো জায়গায় মেয়েদের উপর এতো পাশবিকতা হলো কেন? ইতোপূর্বে, এসব ঘটনা বিচ্ছিন্নভাবে বখাটেদের দ্বারা সংঘটিত হতো। কিন্তু এইবার হয়েছে, পরিকল্পিতভাবে। ২৫/৩০ জনের একটি দল এসে আক্রমণ করেছে। এটা কিসের আলামত? বাংলাদেশে যা কিছুই হোক, খুন, ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি সব কিছুতেই ধর্ম দিয়ে অপরাধীদের রক্ষা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। শুধুমাত্র সৌদি আরব ছাড়া বাংলাদেশিরা পৃথিবীর সব দেশেই নববর্ষ উদযাপন করতে পারে। সৌদি সরকার নাকি এতে অনুমতি দেয় না। তারা বলেন, এটা ইসলাম সম্মত নয়। ইরানে কিন্তু নববর্ষ উৎসব ‘নওরোজ’ পালিত হয়। নওরোজ তাদের কাছে ঈদের চেয়েও বড় উৎসব। সুতরাং আমাদের বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, বাংলাদেশে কারা নববর্ষ উদযাপনে বোমা হামলা করেছিল, কারা মেয়েদের শ্লীলতাহানি করেছে? কারা ফেসবুকে মেয়েদেরকেই দায়ী করে স্ট্যাটাস দিচ্ছে?
আমার স্পষ্ট মনে আছে, একসময় দুর্গা পূজায় হিন্দু মেয়েরা বেশ সুন্দর নতুন পোশাকে সাজ-গোজ করে এক পূজা-মন্ডপ থেকে আরেক পুজা মন্ডপে ঘুরে বেড়াতো। হঠাৎ করে একসময় রাতের বেলা কারেন্ট চলে যেত। তখনই পূজা মন্ডপের আশপাশ থেকে কান্নার রোল শোনা যেত। ফলাফল, প্রতিবছর দুর্গা পূজার পর কয়েক মাসের মধ্যেই বেশ কিছু হিন্দু পরিবার ভারতে চলে যেত। এখনো যাচ্ছে, প্রতিনিয়ত। নির্যাতন করার জন্য বাংলাদেশে যত সংখ্যক বেজন্মা আছে, এখন এতো সংখ্যক হিন্দু নেই কিংবা অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতি-গোষ্ঠী অবশিষ্ট নেই। তাই এখন এক মুসলিম পরিবারের সন্তানরাই আরেক মুসলিম পরিবারের মেয়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ ধর্মাম্বলী মানুষের উপর কী ভয়াবহ আক্রমণ চালানো হয়েছিল? খুন, ধর্ষণ, অগ্নি সংযোগ করা হয়েছিল। তখনও বাংলাদেশের একদল লোক বলেছিল, মায়ানমারের মুসলিমদের উপর নির্যাতন করা হচ্ছে, তাই রামুতে এটা করা হয়েছে। এটা কেমন যুক্তি? আমরা কি কেউ জানি না? চোখের বদলে চোখ নিলে, একদিন পুরো পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যাবে।
এখন কথা হচ্ছে, এভাবে আর কতদিন? আমাদের দেশে পুরুষরা যা খুশি তাই করতে পারবে। কিন্তু একজন মেয়ে নববর্ষের মতো উৎসবে যেতে পারবে না? বইমেলায় যেতে পারবে না? স্কুল-কলেজে নিরাপদে পড়তে পারবে না? আমরা তো হরহামেশাই দেখি, পুরুষরা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রসাব করে। কোনো মেয়ে কি কখনো তাদের পুরুষাঙ্গ ধরে টান মেরেছে? তাহলে মেয়েদের পোশাকের কথা আসে কি করে? পর্দা, সূর্যাস্ত আইন আসলে কিসের আলামত? আমাদের কত আদরের সব কন্যা সন্তান! ওদের কি সবসময় এমন ভয়ের মধ্যে বেঁচে থাকতে হবে? না, কখনই না? মেয়েদেরকে প্রতিবাদ করতে হবে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে, ছেলে হোক আর মেয়ে হোক, প্রতিবাদী হতে হবে। অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কুলাঙ্গারে, বেজন্মায়, অমানুষে ভরে গেছে দেশ। মেয়েদেরকে সাবধান হতে হবে, আরো দায়িত্বশীল হতে হবে। রুখে দাঁড়াতে হবেই। কোনোভাবেই থেমে যাওয়া চলবে না। তোমাদের নিরাপত্তা তোমরাই নিশ্চিত করতে পারবে। কোনো সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশে কী এরকম শত শত নারী পাওয়া যাবে না? যারা প্রতি ৭ জনে মিলে একেকটি দল তৈরি করবে? তাদের নাম হবে প্রীতিলতা কিংবা ফুলনদেবী স্কোয়াড। ৭ জনের মধ্যে একজন নেতা থাকবে। তাদের প্রত্যেকের ব্যাগের মধ্যে থাকবে ভাঁজ করা যায় এমন ধরনের লাঠি। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেসব পুরুষ প্রসাব করে, হঠাৎ করে তাদের পশ্চাৎদেশে লাথি মারবে কিংবা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবে। এরকম এক বা একাধিক টিম বৈশাখীমেলা, নিউমার্কেট, গাউসিয়া, বইমেলায়, বাণিজ্যমেলায় ঘোরাফেরা করবে। যারা মেয়েদেরকে উত্যক্ত করবে, তাদের উপর চড়াও হবে। প্রকাশ্যে পিটাবে, চড়-থাপ্পড় দিবে। অপমান করবে। আমাদের সেরকম কিছু মেয়ে দরকার। যারা সাহসী, যারা প্রীতিলতার মতো কিংবা ফুলনদেবীর মতো ঝলসে উঠতে পারে।
পুনশ্চঃ শ্রদ্ধেয় লেখক জাফর ইকবাল স্যার এর কাছ থেকে এ বিষয়ে একটি লেখা প্রত্যাশা করছি।
লেখকঃ কথাসাহিত্যিক, একাডেমিক, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর।
nayonshakhawat@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ১২০১ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৭, ২০১৫
কেএইচ/