সোমবার ভোরে ঘুম থেকে উঠে ইন্টারনেটে একটা ছবি ও একটা বিবৃতি দেখে খুব অবাক হই। ফেসবুকের ছবিটিতে একটি মেয়ে পুলিশের গাড়িতে ঢিল ছুঁড়ছে, আর সংবাদ পত্রে ছাত্র ইউনিয়নের মিছিলে পুলিশী হামলার প্রতিবাদে বিবৃতি দিয়েছে জামায়াত।
সেই ছাত্র জীবন থেকে ছাত্র ইউনিয়নকে যেভাবে চিনি তার সাথে এই দৃশ্যটি বেমানান। আবার যারা পল্টনে সিপিবির অফিসে আগুন দিতে বা যশোরে উদীচির সমাবেশে বোমা মারতে দ্বিধা করে না, তারাই আবার ছাত্র ইউনিয়নের মিছিলে পুলিশের আক্রমণের প্রতিবাদে বিবৃতি দেয়। কারো ঘরে আগুন লাগলে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীপুষ্ট জামায়াত-শিবির যে আলু পোড়াতে চাইবে এটাই হয়তো স্বাভাবিক। জানি না, ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির জন্য জামায়াতের এই সহানুভূতি কতটা সহায়ক?
বেলা বাড়ার সাথে ফেসবুক উত্তাল, মেয়েটির আরো কিছু ছবি দেখে এবার আঁতকে উঠার পালা। কোন ছবিতে মেয়েটার দিকে উদ্যত পুলিশের বুট, কোন ছবিতে ঘটনার নৃশংসতায় আতংকিত মেয়েটির মুখ, আবার কোন ছবিতে মেয়েটির চুলের মুঠি ধরা পুলিশের হাত! এরকম ছবি দেখে আমাদের কারো পক্ষে স্বস্তিবোধ করার কথা না। যদিও কেউ কেউ বলবার চেষ্টা করেছেন, যেহেতু মেয়েটি পুলিশের গাড়িতে আক্রমণ করেছে, সেহেতু পুলিশের পক্ষে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব ছিল না।
পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তারা ওইদিন যথেষ্ট সংযমের পরিচয় দিয়েছে। যার ফলে ছাত্র ইউনিয়ন পুলিশের চারটি ব্যারিকেড অতিক্রম করতে পেরেছে। কিন্তু শেষ পর্যায়ে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা মারমুখী হয়ে উঠে।
আরো কিছু ছবিতে দেখলাম, তারা বেশকিছু প্রাইভেট গাড়ি ভাংচুর করেছে, এক ছবিতে দেখলাম ভাঙা গাড়ির মালিক পেছনের আসনে বসে হাত জোড় করে আন্দোলনকারীদের কাছে অনুগ্রহ চাইছেন।
এ ঘটনার বেশকিছু দিক আছে, যার সবগুলোই বিবেচনা করা উচিত, বিচ্ছিন্নভাবে দুয়েকটি ছবিকেন্দ্রিক আলোচনা চললে তা হয়ত জামায়াত-শিবিরের মত সন্ত্রাসী-জঙ্গী গোষ্ঠীগুলোকে উৎসাহিত করবে। তবে সবকিছুর আগে বলে নেওয়া ভাল, পরিস্থিতি যত উত্তালই হোক, পুলিশের উচিত ছিল সংযত আচরণ করা। বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে পুলিশ ভয় দেখিয়ে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দিচ্ছে, এর মধ্যেও নারায়ণগঞ্জের ছাত্র ইউনিয়নের এই নারী নেত্রীর সাথে করা ব্যবহারটুকু কোন অবস্থায়ই গ্রহণযোগ্য নয়।
রাতে দেখলাম, অভিযুক্ত এক পুলিশকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথেই নিয়েছে। আমরাও আশা করব, নারী নির্যাতনকারী পুলিশের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।
এবার ছাত্র ইউনিয়নের এই আন্দোলন প্রসঙ্গে আসি। পহেলা বৈশাখের সন্ধ্যায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের টিএসসি সংলগ্ন গেটে ঘটে যাওয়া নারী নির্যাতনের ঘটনার প্রতিবাদে ছাত্র ইউনিয়নের ভূমিকা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে। প্রতিটি বিবেকবান মানুষই এই ঘটনায় কর্তব্যরত পুলিশের এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের ভূমিকার নিন্দা জানিয়েছে। ফেসবুকসহ নানান সামাজিক ও সংবাদ মাধ্যমে অপরাধীদের ছবি প্রকাশিত হয়েছে, তারপরও তাদের কাউকেই আজ অব্দি গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। ঘটনার শুরু থেকেই সরকারবিরোধী একটি মহল এই যৌনসন্ত্রাস ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা ঘটিয়েছে বলে রটানোর চেষ্টা করেছে, যদিও তা হালে পানি পায়নি। যতই দিন যাচ্ছে ততই মনে হচ্ছে, যারা নববর্ষের চেতনাকে ধারণ করে না, সম্ভবত এটি তাদেরই একটি পরিকল্পিত সংঘবদ্ধ অপপ্রয়াস।
যদি ছাত্রলীগের ছেলেরা এর সাথে জড়িত থাকত, তাহলে এতদিনে নিশ্চিত তাদের জেলের ঘানি টানতে হত। অন্যায় করেছে এবং তা মিডিয়ায় আসার পরেও ছাত্রলীগ পার পেয়ে গেছে, এরকম ঘটনা আজকাল প্রায় বিরলই বলা চলে। বরং যারা পহেলা বৈশাখের সন্ধ্যার ঘৃণ্য ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের প্রায় সবাই আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেছে। নানান মিডিয়ায় ছবি প্রকাশিত হলেও আজ অবধি অপরাধীদের কারো পরিচয় প্রকাশ হয়েছে, এমন কোন সংবাদ চোখে পড়েনি। তারপরও বলতে হয় এবং আমাদের সঙ্গত প্রত্যাশা, যত দ্রুত সম্ভব পুলিশের উচিত অপরাধীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা। যতদিন তারা এটি করতে পারছে না, ততদিন আমাদের উদ্বেগ ও ক্ষোভ থাকবেই।
পহেলা বৈশাখের যৌন নিপীড়নের ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবিতে ছাত্র ইউনিয়ন পুলিশ কমিশনারের কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি দিয়েছিল গত রোববার। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, তাদের এই আন্দোলনটি শেষমেষ আর শান্তিপূর্ণ থাকেনি। সঙ্গত কারণেই তাই প্রশ্ন জাগে, তাদের এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য কী ছিল? কয়েক দফায় পুলিশের বাধা পেয়েও তারা থেমে থাকেনি কিংবা পুলিশ কমিশনারের কাছে কোন স্মারকলিপি পৌঁছে দিতে যায়নি। বরং মিন্টো রোডের মত সংবেদনশীল এলাকায় গিয়ে তারা পরিস্থিতি উত্তপ্ত করবার জন্য যথেষ্ট উস্কানিমূলক আচরণ করেছে। শুরুতে সংযমী থাকলেও এক পর্যায়ে কর্তবরত কতিপয় পুলিশও সেই পাতা ফাঁদে পা দিয়েছে।
পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়ে, সরকারকে বিব্রত করার মত ইস্যু তৈরি করে স্বেচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় ছাত্র ইউনিয়ন আসলে কাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করেছে? ব্যাপারটা কি ছাত্র ইউনিয়নের প্রিয় নেতা-কর্মীরা একবার ভেবে দেখবেন? তাদের পক্ষে জামায়াতের বিবৃতি প্রদানে কি তারা খুবই আহ্লাদিত বোধ করছেন? তাদের আন্দোলনের দাবিটি যৌক্তিক, কিন্তু পথটা কি খুব গ্রহণযোগ্য? এখনতো আন্দোলনের ভাষা বদলাচ্ছে, নতুন নতুন পথ বেরিয়েছে। এর মধ্যে ছাত্র ইউনিয়নের মত শান্তিপ্রিয় সংগঠনে যাকে আমরা ছাত্র জীবনে রসিকতা করে ‘হারমোনিয়াম’ পার্টি বলে ডাকতাম তাদের হঠাৎ এমন উত্তাল হয়ে ওঠার পেছনে অন্য কোন রহস্য নেই তো?
পুলিশের হাতে ছাত্রী নিগৃহীত হওয়ায় অনেককেই বলতে শুনছি, যে দেশে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার নারী, সেই দেশে নারীরা কী করে নির্যাতিত হয়? এই কথা বলবার আগে তারা হয়ত ভেবে দেখেন না, উল্লেখিত পদগুলোতে নারীরা আসীন থাকলেও বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থা এখনো চরমভাবে পুরুষশাসিত। এই বাস্তবতা যতদিন অনুধাবন না করতে পারব, ততদিন নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনও সঠিক দিশা পাবে না। সমস্যা চিহ্ণিতকরণ সমাধানের পথকে অনেক সহজ করে।
সমগ্র পুলিশ নিয়েও আমাদের গুরুত্বের সাথে ভাবতে হবে। আমরা যারা বিদেশে থাকি, তাদের মধ্যে কথায় কথায় বিদেশের সাথে দেশের তুলনা করার একটা প্রবণতা কাজ করে। এক যুগের বেশি সময় অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করার সুবাদে বহুবার পথে-ঘাটে পুলিশের মুখোমুখি হতে হয়েছে, অথচ কোথাও কোন আতঙ্কের ব্যাপার নাই। আট বছর আগে একবার মধ্যরাতে এক পুলিশ অফিসার আমার গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখতে চাইলে বাংলাদেশি ড্রাইভিং লাইসেন্সটা বাড়িয়ে দেই। দেখেতো অফিসারের চক্ষু চড়ক গাছ, আমার আটশ’ ডলার ফাইন দিতে হবে। কারণ এতদিন অস্ট্রেলিয়া থাকার পরেও বাংলাদেশি লাইসেন্সে আমার গাড়ি চালানো অবৈধ। আমি তাকে যতই বুঝাই, আমার ভিসার শর্ত আমাকে এই লাইসেন্সে গাড়ি চালানোর অনুমতি দেয়, ততই সে নাছোড়বান্দা। আমি বললাম, আমি নিশ্চিত হয়েই তোমাকে বলছি, তোমার কোন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা থাকলে তাকে জিজ্ঞেস কর।
পুলিশ অফিসারটি এবার তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ফোন করে আমার সামনে এসে বললো, দুঃখিত, আমি জানতাম না, তুমি এবার যেতে পারো। এরকম একটা ব্যপার হয়ত আট বছর আগে আমি বাংলাদেশে চিন্তাও করতে পারতাম না।
আজ থেকে দশ বছর আগে সড়ক পথে গাড়ি চালিয়ে খুলনা যাবার পথে ফরিদপুরের ভাঙায় ইশারায় গাড়ি থামিয়ে আমাকে ডাকলেন এক পুলিশ। গাড়ি চালাচ্ছিলাম এবং দেখতে গোবেচারা ধরনের বলেই হয়ত তুই তোকারি আচরণ দিয়ে শুরু। সাথেই ছিল আমার ড্রাইভার। সব কাগজপত্র দেখতে চাইলেন, এক এক করে দেখালাম। আসলে সেবার ঢাকা থেকে গাড়ির কাগজপত্র সব ঠিকঠাক করেই খুলনা যাচ্ছিলাম। কিন্তু কোনকিছুতেই তিনি সন্তুষ্ট নন, মনে হল জরিমানা অথবা ঘুষের যে কোন একটার জন্য তিনি উদগ্রীব। ঘুষ পাবার কোন লক্ষণ না দেখে এক পর্যায়ে তিনি এক হাজার টাকা জরিমানার একটা কাগজ ধরিয়ে দিলেন। আমি আসলে তেমন কোন কথাই বলিনি কারণ ততদিনে আর বাংলাদেশে যেচে পড়ে পুলিশের সাথে ঝামেলায় জড়ানোর মত নির্বোধ ছিলাম না। এর চেয়ে এক হাজার টাকা জলে ফেলা অনেক বুদ্ধিমানের কাজ। ফেরার পথে কিছুটা অবাক হয়ে তিনি আমার পেশা জিজ্ঞেস করলেন। অস্ট্রেলিয়ায় একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শুনতেই পুরো পরিস্থিতি বদলে গেল, তখনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে স্যার স্যার করে অস্থির! কেন এতক্ষণ আমি তাকে বললাম না? তার অপরাধবোধ তখন দেখার মত!
বিদেশের সাথে দেশের পুলিশের তুলনাটা বেমানান। তাদের কাজের প্রেক্ষিত ও পরিবেশ সম্পূর্ণ আলাদা। বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীতে যারা কাজ করেন, তারা অন্য দেশ বা ভিন্ন গ্রহ থেকে আসেন না। তারা আমাদেরই ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন। আমার পরিচিত কিছু ছোট ভাইও পুলিশে কাজ করে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাদের বিনয়-মার্জিত আচরণ দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারি না। এই পুলিশই যখন ইউনিফর্ম পড়ে রাজপথে কর্তব্য পালন করে তখন তারা ভিন্ন মানুষ, কখনো কখনো আতঙ্কের প্রতিমূর্তিও। কেন এই বৈপরীত্য? পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার, যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের ঘাটতি, কর্ম পরিবেশের অপ্রতুলতার মত অনেক কারণেই আমাদের পুলিশ বাহিনী আজ জনগণের বন্ধু না হয়ে উল্টো আস্থার সঙ্কটে পতিত। তবে পরিস্থিতি একটু একটু করে হলেও বদলাচ্ছে, যদিও তা এখনো যথেষ্ট নয়। প্রচুর সম্ভাবনাময়, মেধাবী তরুণ আজকাল পুলিশ অফিসার হিসেবে যোগদান করছে, তাদের ভালভাবে কাজ করার পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। পাশাপাশি পুলিশকেও যে কোন পরিস্থিতিতে সংযত আচরণ করতে হবে। তাদের বাড়াবাড়ির জন্য সরকার বিব্রত হোক, এটা কাঙ্খিত নয়।
সবাই মিলে একটি মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তোলাটা আজ খুর জরুরি হয়ে পড়েছে।
ডঃ আবুল হাসনাৎ মিল্টন: কবি ও চিকিৎসক, বর্তমানে অস্ট্রেলিয়াস্থ নিউক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত। ইমেইল: milton.hasnat@newcastle.edu.au
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৮ ঘণ্টা, মে ১২, ২০১৫
জেডএম