‘এই বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের একটি পরিপূর্ণ জীবন উপহার দিয়েছে। এই অপূর্ব অভিজ্ঞতা নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদত্যাগ করতে যাচ্ছি, সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা- এই বিশ্ববিদ্যালয়টি যখন এই দেশ ও পৃথিবীর একটি সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হবে তখন আমরা গর্ব করে বলতে পারবো- একসময় এখানে আমাদের শ্রম দিয়েছিলাম’- এ কথা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জাফর ইকবাল ও তাঁর স্ত্রী অধ্যাপক ইয়াসমিন হকের।
তারা একবার পদত্যাগ করেছিলেন এবং পদত্যাগপত্রে এ কথা লিখেছিলেন। শেষমেশ ছাত্র-ছাত্রীদের প্রবল আন্দোলনের মুখে জাফর ইকবালকে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করে ফিরে আসতে হয়। তিনি যে দিন পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন সেদিনই আমি এই বাংলানিউজে “ফিরে আসুন জাফর স্যার” শিরোনামে একটা কলাম লিখেছিলাম।
আমার ধারণা, সবার আগে কোন জাতীয় পত্রিকায় এ নিয়ে আমিই কলম ধরেছিলাম। তার এই ফিরে আসার প্রক্রিয়ায় নিজেকে কিছুটা সম্পৃক্ত থাকতে পেরে আমি গর্ববোধ করতাম।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম থেকেই নিজেদের কিছুটা স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের কারণে শিক্ষার্থীদের প্রিয় একটি বিদ্যাপীঠ হিসেবেই পরিচিত। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি মাঝে মাঝেই তাঁদের বিভিন্ন উদ্যোগ ও কর্মকাণ্ডের জন্য প্রশংসিত হয়।
দেশের প্রথম বাংলা সার্চ ইঞ্জিন পিপীলিকা, মুঠো ফোনে ভর্তি কার্যক্রম সবকিছুই শুরু হয়েছিল জাফর স্যারের হাত ধরে শাবিপ্রবি থেকে। প্রতিষ্ঠার ত্রিশ বছর না পেরুতেই বিশ্ববিদ্যালয়টি দেশের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। এর পেছনে অন্যান্য অনেকের যেমন অবদান রয়েছে ঠিক তেমনি রয়েছে জাফর স্যারের অক্লান্ত পরিশ্রম।
সেই জাফর ইকাল স্যারকে কিনা শুনতে হলো ‘জনসম্মুখে চাবুকের বাড়ি’ খাওয়ার কথা। তাও আবার সিলেটের স্থানীয় এক এমপির কাছে। তার যদি ক্ষমতা থাকতো তাহলে তিনি ডক্টর মোহম্মদ জাফর ইকবালকে জনসম্মুখে চাবুকে মারতেন।
এই এমপি শুধু এই বলেই ক্ষান্ত হননি। তিনি চরম সাম্প্রদায়িক কিছু শব্দও ব্যাবহার করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘জাফর ইকবাল সে হল ১ লক্ষ পারসেন্ট গৌরগোবিন্দ, সে চায়না সিলেটের মানুষ শাহজালাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হোক। এখানে যে ভিসি ছিল তাকেও দিয়েছে তাড়িয়ে। আর এই সিলেটের মানুষ তাকে ফুলচন্দন নিয়ে সুন্দর সুন্দর ফুল নিয়ে প্রত্যেক দিন মূর্তিপূজা করতে যায়। আমি যদি বড় কিছু হতাম তাকে ধরে চাবুক মারতাম কোর্ট পয়েন্টে এনে!’
ড. জাফর ইকবালকে এসব কথা শুনতে হলো, কারণ তিনি মত দিয়েছিলেন একটি বিশ্ববিদ্যালয় কখনো শুধু একটি অঞ্চলের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য হতে পারে না। সিলেটিদের জন্য শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা কোটার বিরুদ্ধে তিনি লেখালেখি করেছেন। তাই তাকে শুনতে হলো জনসম্মুখে চাবুকের বাড়ি খাবার কথা! তাও আবার সরকার দলীয় একজন এমপির মুখ থেকে! এরা বুঝতে পারলো না, ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করার ক্ষেত্রে কোটা সিস্টেম চালু করলে আখেরে সেই অঞ্চলের ছাত্র-ছাত্রীদেরই ক্ষতি হবে। দিন শেষে তো দেশের সবার সাথে প্রতিযোগিতা করতে হবে।
সিলেটের এই এমপির কথার মাঝেই বিষয়টি সীমাবদ্ধ থাকেনি। শনিবার সিলেট আওয়ামী লীগ জাফর ইকবালের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিয়ে মিছিল করেছে এবং তাঁকে ব্লগার বলে সম্বোধন করেছে। এর মানে তারা এলে কি বুঝাতে চাইলো। তারা কি বুঝাতে চাইলো- কেউ ব্লগার হলে সে খারাপ? ‘গৌরগোবিন্দ’, ‘মূর্তি পুজার’ মতো শব্দ ব্যাবহার করে সিলেটের এমপি যে চরম সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করেছেন, তিনি কি সেটা বুঝতে পেরেছেন! সাথে ‘ব্লগার’ শব্দ ব্যবহার করেও যে একটা শ্রেণীকে চরম অনিশ্চয়তার মাঝে ফেলে দেয়া হলো সেটি কি সরকারি দল আওয়ামী লীগ বুঝতে পারছে?
এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যদি ঘটতে থাকে তাহলে এই দেশে আর আলোকিত মানুষ থাকবে না। সবার পরিচয় হয়ে রাজনীতি আর রাজনৈতিক দল দিয়ে।
এই আমি একদিন জাফর ইকবাল স্যারের ফিরে আসার জন্য কলম ধরেছিলাম। আজ এই আমিই বলছি এই দেশ, এই সমাজ আপনার মতো গুনি মানুষদের কদর বুঝার ক্ষমতা রাখে না। আমি খুবই দুঃখিত ও লজ্জিত যে, পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করে আপনাকে এই অপমান সহ্য করতে হলো। ক্ষমা করুন আমাদের প্রিয় জাফর স্যার।
আমিনুল ইসলাম: শিক্ষক ও গবেষক, tutul_ruk@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪০ ঘণ্টা, মে ১৭, ২০১৫
জেডএম/