অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে নিয়ে তখনও হৈ চৈ শুরু হয়নি। হুমায়ূন আহমেদ ঝড়ো জনপ্রিয়, উপন্যাসের মতোই মনের বিন্যাসে তিনি ঘোরেন ফেরেন।
ব্যক্তি জাফর ইকবাল আমেরিকায় থাকতে পারতেন, দেশের মায়ায়-ভালোবাসায় দেশে পড়ে আছেন, সে গল্প পুরোনো। তুমুল জনপ্রিয় গণিত অলিম্পিয়াড জাফর স্যার ও কায়কোবাদ স্যারের প্রত্যক্ষ অবদানে ভরপুর, বাচ্চাদের জন্য স্যারের লেখা যত আছে, লেখার মন আছে তারচে’ হাজারগুণ বেশি- এটা সহজেই অনুমেয়। মোদ্দাকথা, স্যার লেখক হিসেবে নাম কুড়িয়েছেন।
স্যারের লেখার হাত পাঠকের জন্য- সহজ, সরল, প্রাণবন্ত। যা জানেন, তা যতটা লেখেন, তারচে’ যা বোঝেন, সাহসী মনে তারও বেশি লেখেন। শাহবাগ আন্দোলন বিষয়ে সবাই যখন দ্বিধায় ভুগেছেন, পিছপা হয়েছেন- স্যার সামনেই ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকে তার লেখায় বারবার পেয়েছে নতুন প্রজন্ম, দিক ভুল হয়নি।
সিলেটের বিশ্ববিদ্যালয় হযরত শাহজালালের (র.) নামে হয়েছে, এটা ঠিক। পরের যে নামটি ওই বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে রয়েছে, জনগণ মনে রেখেছে, সেটি জাফর ইকবালের। একটা দেশ সামনে চলতে গেলে তো আদর্শ লাগবে! যে ব্যক্তিবর্গ আদর্শের একটা স্থান তৈরি করেছেন, তাদের স্থান দিতে হবে।
গোটা জাতি কাদের সামনে রেখে পথ চলবে! সবাইকে যদি আমরা ক্রমাগত কারণে-অকারণে বিতর্কিত করে তুলি, তাহলে সামনে পথ দেখানোর আস্থাশীল কেউই তো আর থাকবে না! জাতি তো হতাশায় নিমজ্জিত হবে। তখন কী হবে? একজন ড. আনোয়ার হোসেন কোনো আর্থিক কেলেঙ্কারি, নিয়োগ অনিয়ম বা স্বজনপ্রীতি না করার পরও ‘বাইরের শিক্ষক’ বিবেচনায় তাকে ভিসি পদ থেকে সরানোর আন্দোলন যেমন অন্যায়, প্রভাবশালী মন্ত্রীদের বাড়ি হওয়ার পরও ‘সিলেটের বাইরের’ একজন জাফর ইকবালের প্রভাব বলয়ে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় থাকতে পারবে না, এটা ভাবাও অন্যায়।
বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয় নয়, এটাও সকলের মনে রাখতে হবে। ভর্তি পরীক্ষার ফরম কিনতে গিয়ে জেলায় জেলায় ঘুরতে শিক্ষার্থীদের কতো হেনস্তা হতে হতো, এখন সেসব ভাবাও লাগে না। এ পদ্ধতির প্রবর্তক কোন বিশ্ববিদ্যালয়, মনে আছে? যারা বলছেন, জাফর ইকবাল প্রশাসক হিসেবে ভালো করতেন না, তারা বুঝে বলছেন, নাকি না বুঝে বলছেন? জাফর ইকবাল তো সত্যিই ভিসি হতে চাননি। তিনি কিছু নিয়মের প্রতিবাদ করেছেন মাত্র। এ প্রতিবাদ তার একার নয়, সমষ্টির। হতে পারে সেটা আংশিক সমষ্টি। কিন্তু কেন সে প্রতিবাদ, তার ফিরিস্তির শ্বেতপত্রও তো প্রকাশিত হয়েছে।
আমার প্রশ্ন অন্যত্র। স্যার কি জানেন না যে, যে দলই ক্ষমতায় থাকুক, তাদের অনুগতদের থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বানানো হয়! সেটা কেন হয়, স্যার নিশ্চয় সেটাও জানেন। তাহলে দলপ্রীতি বা স্বজনপ্রীতির অজুহাত তুলে একজন ভিসির অপসারণের বদলে তাকে যে প্রক্রিয়ায় ভিসি পদে নিযোগ দেওয়া হয়, সেই প্রক্রিয়া সম্পর্কে স্যার কেন প্রশ্ন তুলছেন না?
গদি টিকিয়ে রাখতে গিয়ে অন্যায় করার ও অন্যায় আবদার সহ্য করার হজমশক্তি কতো তীব্র হলে বাংলাদেশে একজন ভিসি হিসেবে টিকতে পারেন, সেটা তো ওপেন সিক্রেট ব্যাপার। ব্যতিক্রম নেই তা বলবো না, কিন্তু সেটা তো আর উদাহরণ নয়।
এখন যে প্রশ্নে বাংলাদেশ উত্তাল, সেটা হলো- শিক্ষকরা অসম্মানিত ও অপমানিত হওয়ার পরও ড. জাফর ইকবাল স্যার ছাত্রলীগকে প্রশ্নহীন ছাড়পত্র দিয়েছেন, এটা ঠিক হয়নি। সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষকবৃন্দকে লাঞ্ছিতকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন, কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে কয়েকজনকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় কর্র্তৃপক্ষও কয়েকজনকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে, যেখানে ছাত্রলীগের কর্মীরা আছেন। তাহলে ড. জাফর ইকবাল কি ক্ষমতার কাছে হারলেন, নাকি সমঝোতা করলেন? এই প্রশ্নের সম্মুখীন আমরা সবাই।
শিক্ষকদের অপমান অপদস্থ করার জন্য দায়ী সকল সন্ত্রাসের বিরোধিতা করে যারা স্যারের পক্ষ নিয়ে মতামত প্রকাশ করেছিলেন, তাদের অনেকেই এখন বেশ বিরক্ত।
এ বিষয়ে আমার ব্যাখ্যা খুবই সহজ। বাংলাদেশের শীর্ষ প্রশাসন তথা সরকার প্রধান এখন একটু ভিন্ন ধাঁচে দেশ পরিচালনা করছেন। অপরাধ ও অন্যায় যে বা যারা করছেন, নিজ দলের হলেও ছাড় না দেওয়ার মনোভাব ব্যক্ত করেছেন, সে মতে কাজও করছেন বলে দেখা যাচ্ছে। অপরাধ করলে ছাত্রলীগও রেহাই পাচ্ছে না। ড. জাফর ইকবাল নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। ছাত্রলীগ একটি বিশাল রাজনৈতিক সংগঠন। দেশের নানা ক্রান্তিকালে ছাত্রলীগের ভূমিকাও প্রশ্নাতীত। কোনো প্রতিষ্ঠানের অপমান হোক, কেউই সেটা চায় না। ছাত্রলীগের কয়েকজনের বহিষ্কারাদেশ সরকারের ভাবমূর্তি বৃদ্ধির পরোক্ষ সহায়ক, এটা যেমন ঠিক। যে ভিসিকে সরানোর জন্য ড. জাফর ইকবালদের আন্দোলন, সেটা নিয়ে সরকার কোনো কথা বলছে না, এটাও ঠিক।
যারা জাফর ইকবালকে ভুল বুঝেছেন, তাদের উদ্দেশে বলবো, স্যার শুধু সেদিকেই আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, যেদিকে আপনারা তাকাননি। ছাত্ররা কখনোই শিক্ষকের গায়ে হাত তুলতে সাহস পেতো না, যদি না কতিপয় শিক্ষক তাদের প্রত্যক্ষ মদত দিতেন।
ভিসি সরানো আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হলেও সমালোচকদের লেখায় ছাত্রলীগ ছাত্রলীগ করে দেশের মানুষের কাছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে ঘাটানোর অপচেষ্টা ছিলো বেশি। তাহলে তো আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্যই বেহাত হয়ে যায়, আর মাননীয় ভিসি দৃষ্টির আড়ালে এসি রুমে বসে টিভিতে আনন্দে এসব দেখতে দেখতে সুখনিদ্রা যান! সরকারের লোকজন কেউ কেউ সেটা হতে দিতে চান কিনা কে জানে? আন্দোলনকারী শিক্ষকরা নিশ্চয়ই সেটা চাইবেন না। স্যারও নিশ্চয় সেটা চান না। তাই ‘ওরা তো বাচ্চা, মিসগাইডেড হয়েছে‘ বলে ছাত্রলীগকে উদ্দেশ্য করে ড. জাফর ইকবাল যে কৌশলী বক্তব্য দিয়েছেন, সেটিকেও বিতর্কিত করবেন না, প্লিজ!
অভিমান করে যদি একজন জাফর ইকবাল থেমে যান অথবা অযথা সমালোচনা করে যদি আমরা তাকে থামতে বাধ্য করি, মুক্তিযুদ্ধের সোনালী ফসল সোনার বাংলাদেশে কিন্তু জাফর ইকবালদের স্থলে মীর জাফররা ছড়ি ঘুরাবে! সেটা কি দেশের জন্য খুব একটা ভালো হবে ?
লেখক:
সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল- razib.mir@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৩, ২০১৫
এইচএ/