ঈদ চলে গেলেও রেশ রয়ে গেছে। কাজ শেষে নৈশভোজের দাওয়াতে এসেছি, টেবিলে হরেকরকম খাবারের আয়োজন।
এবারের মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে বেশ একটা লেজে-গোবরে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকায় এবং নিউইয়র্কে সরকার সমর্থক অনেকের সাথে কথা বলে দেখলাম, তারা বিশ্বাসই করেন না যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছিল। আবার পরীক্ষাকেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করেছেন এমন কয়েকজন ডাক্তারের সাথে কথা বলে জানলাম, বাইরে যাই ঘটুক, হলে পরীক্ষা খুব সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাদের ভাষ্য, 'পরীক্ষাটা ভালভাবে নেবার জন্য এতকিছু করলাম, তারপরও পরীক্ষা নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কে মনটাই খারাপ হয়ে গেছে'। তবে সাধারণ নানুষ বিশ্বাস করে যে, এবার মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে।
অত:পর ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছেই। ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের জন্য আদালতে রিট করা হয়েছিল, সেটি খারিজ হয়ে গেছে। তাড়াহুড়া করে ভর্তি পরীক্ষার ফল ঘোষণার পর এখন আবার পূর্বঘোষিত সময়ের আগেই বিভিন্ন সরকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি শুরু হয়ে গেছে। যদিও ভর্তি প্রতিরোধের আন্দোলনের ডাকে ফেসবুক কাঁপছে। কিন্তু ঈদের সময় বলে সিলেট, বরিশাল মেডিক্যাল কলেজের মত কয়েকটি হাতে গোনা কলেজ ছাড়া বিভিন্ন কলেজে ভর্তি প্রতিরোধের মত তীব্র কোন আন্দোলন অন্তত প্রথম দিনে গড়ে উঠতে পারেনি। পুলিশ এবং প্রশাসনও শক্ত অবস্থান নিয়েছে। এই ফাঁকে বেশকিছু ছাত্র-ছাত্রী বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়ে গেছে। ঠিক এই মুহূর্তে পরীক্ষা বাতিলের আন্দোলনের পরিণতি নিয়ে তাই আগাম মন্তব্য করা যাচ্ছে না। দেখা যাক কোথাকার জল কোথায় গড়ায়!
ব্যাপক সমালোচনার প্রেক্ষিতে মেডিক্যাল ভর্তির বিষয়টির দিকে নজর রাখছিলাম। সাধারণ মানুষের একটা অংশের ধারণা, মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার দায়িত্ব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের, যা আদৌ সত্যি নয়। এ কারণেই তারা অন্যায্যভাবে শিক্ষা মন্ত্রীর সমালোচনা করছেন। আর যারা ব্যাপারটা জানেন, তাদের অভিযোগ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে, কখনোবা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে। এই অভিযোগগুলোও খুব সুনির্দিষ্ট নয়। তবে যারা স্বাস্থ্যমন্ত্রী সম্পর্কে ধারণা রাখেন তারা নিশ্চিত যে, আর যাই ঘটুক না কেন, ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের মত নিন্দনীয় ব্যাপারে তিনি জিরো টলারেন্সেই থাকবেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেরর মহাপরিচালকের অবস্থানও অনুরূপ হবার কথা। তারপরও তারা সমালোচনার কাঠগড়ায়। অথচ মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা প্রধানত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মেডিক্যাল এডুকেশন বিভাগ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়। পরীক্ষা নিয়ে এতকিছু ঘটে গেলো, সরকার বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি, অথচ মেডিক্যাল এডুকেশনের পরিচালকের কোন বক্তব্য বা জবাবদিহিতা চোখে পড়ল না।
সামান্য অনুসন্ধানে জানতে পারলাম, প্রতি বছরই নাকি সীমিত আকারে মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হত। বিগত স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক রুহুল হকের কঠোর অবস্থানের কারণে শেষদিকে এসে প্রশ্ন ফাঁসের সাথে জড়িত চক্রটি কৌশল পরিবর্তন করে তাদের মনোনীত ভর্তিচ্ছু ছাত্র-ছাত্রীদের ঢাকার বাইরের কেন্দ্র থেকে পরীক্ষা দেওয়াতো। সমগ্র প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মেডিক্যাল এডুকেশনকেন্দ্রিক একটি চক্র আর কতিপয় কোচিং সেন্টার। এবার পরীক্ষার আগেই প্রশ্নপত্র ফেসবুকে এবং হোয়াটস্ আপে চলে আসায় ব্যাপারটা লেজে গোবরে হয়ে গেছে। সমগ্র বিষয়টা নিয়ে আমরা মেডিক্যাল শিক্ষা বিভাগের পরিচালকের কাছ থেকে একটা ব্যাখ্যা চাই।
বাতাসে কান পাতলে মেডিক্যাল এডুকেশন বিভাগের এই পরিচালককে নিয়ে নানান কথা শোনা যায়! নব্বই দশকের শুরুতে রাজশাহীতে বদলি হয়ে নিজের পরিচয় দিতেন ফেনী ড্যাবের সভাপতি হিসেবে, চলাফেরা করতেন বিএনপিপন্থি ডক্টর্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) সাথে। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় এলে এই পরিচালক সাহেব ভোল পাল্টিয়ে উত্তরবঙ্গের একটি মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ বনে যান। সেখানে দায়িত্ব পালনকালিন তার বিরুদ্ধে কয়েক কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হয়, যা দুদক পর্যন্ত গড়িয়েছিল। অথচ তারপরও তাকে নিয়ে আসা হয় ঢাকায়, দেওয়া হয় মেডিক্যাল এডুকেশন বিভাগের পরিচালকের পদসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। জনশ্রুতি আছে, সরকার বদলের সাথে সাথে তার ভোল বদলে জুড়ি নাই! মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের নাটের গুরু এই পরিচালক স্বয়ং, এরকম একটা ফিসফাস স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেই বিদ্যমান। আজকালের মধ্যেই তার অবসরপূর্বকালিন ছুটিতে যাবার কথা। যাবার আগে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে একটা বড় দান মেরে গেলেন কি না তা নিয়েও কানাঘুষা চলছে। এদিকে চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর জন্যও তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বলা যাচ্ছে না, সে চেষ্টায় হয়তো সফলও হয়ে যেতে পারেন!
সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের মত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেও বেশকিছু হাইব্রিড কর্মকর্তার সরব উপস্থিতি প্রকটভাবে চোখে পড়ছে। ড্যাবের পরিচিত এইসব নেতার কেউ কেউ এখন আওয়ামী লীগারদের চেয়েও বড় আওয়ামী লীগার। দিনের শেষে এদের নানান অপকর্মের এবং অদক্ষতার দায় সরকারের কাঁধে এসেই পড়ছে। এদের দুর্ণতি বা ব্যর্থতার কারণেই মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। অথচ এদের নিয়ন্ত্রণ করার কেউ নেই।
বাংলাদেশে সবকিছু এখন প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। শুভ ও অশুভর মাঝখানে তিনিই আমাদের সর্বোচ্চ আশার প্রতীক। প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানোর জন্যও কি আমরা প্রধানমন্ত্রীর মুখাপেক্ষী হব? আর সব যদি প্রধানমন্ত্রীকে একাই সামলাতে হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের ভূমিকা কতখানি? মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে যে বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা সবার জন্যই খুব অস্বস্তিকর। এবার যারা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হবে তারা ভাল-মন্দ যাই হোক, দীর্ঘকাল এই কালিমা তাদের বয়ে বেড়াতে হবে। সময় এবং প্রশাসনের বর্তমান যে মনোভাব এবং আন্দোলনের অংশগ্রহণকারীদের যে সংখ্যা, তাতে মনে হয় না এবছর মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি প্রতিহত করা যাবে। এবার যাই হোক, ভবিষ্যতে যেন আর প্রশ্নপত্র ফাঁস না হয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। আমার ধারণা, এটি এমন কোন কঠিন কাজ নয়। কতিপয় মানুষের সততা, সদিচ্ছা আর দৃঢ়তাই যথেষ্ট।
ড: আবুল হাসনাৎ মিল্টন: কবি ও চিকিৎসক, বর্তমানে অস্ট্রেলিয়াস্থ নিউক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত, miltonhasnat@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১১২৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৫
জেডএম