ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

গড়তেই হবে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর

রুশো মাহমুদ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৪৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১৫
গড়তেই হবে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর

সমুদ্র বাণিজ্য ও আঞ্চলিক সম্পৃক্ততা বা কানেক্টিভিটির কথা বেশ জোরেসোরে আলোচিত হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে। একদিকে রয়েছে বিসিআইএম-বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মায়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর।

কুনমিং ইনিশিয়েটিভ নামেও পরিচিত এ উদ্যোগ।

চীনারা বলছেন, ওয়ান বেল্ট, ওয়ান করিডোর। যা আসলে মধ্য এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সংযোগ স্থাপনের পুরনো সিল্ক রুট। নতুন সিল্ক রোড ও মেরিটাইম সিল্ক রুট পুনর্গঠনের জন্য চীন প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলারের বিশাল বিনিয়োগ পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে চায়।

অন্যদিকে রয়েছে বিবিআইএন-বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপাল। এ চার দেশের আঞ্চলিক যোগাযোগ ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক বাড়ানোর আরেকটি উদ্যোগ। দু’টি উদ্যোগেরই কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশ। বিশেষত বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে সংযোগ বা সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের সুযোগ নেওয়া মূল উদ্দেশ্য।

ভৌগলিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থান বাংলাদেশের সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশের আশেপাশের দেশগুলোর অনেক অঞ্চল পুরোপুরি ভূমিবেষ্টিত, সমুদ্রে প্রবেশের কোনো সুযোগ নেই। বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব ভারতীয় সাত রাজ্য-আসাম, মেঘালয়, অরুণাচল, মনিপুর, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা ও মিজোরাম এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্র নেপাল ও ভুটান। চীনের ইউনান ও সিচুয়ান প্রদেশ এবং মায়ানমারের শান ও রাখাইন রাজ্যের সমুদ্র যোগাযোগের প্রবেশদ্বারও হতে পারে চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বঙ্গোপসাগরের এমন জায়গায় অবস্থিত যার সুবিধা এ দেশগুলো সহজেই নিতে পারে।

উদাহরণ দিয়ে বলি। বর্তমানে বিশ্বের সর্ববৃহৎ পণ্য বিক্রেতা দেশ হচ্ছে চীন। চীনের ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিং থেকে তার নিকটতম সমুদ্রবন্দর গুয়াংজুর দূরত্ব প্রায় এক হাজার ৭০০ কিলোমিটার। চট্টগ্রামের সঙ্গে মায়ানমার হয়ে কুনমিং এর দূরত্ব এক হাজার কিলোমিটার। উখিয়ার বালুখালি থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত মাত্র দুই কিলোমিটার সড়ক করা গেলে মায়ানমারের এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে বাংলাদেশ। ৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ে আগামী নভেম্বর মাসে এ রাস্তার কাজ শুরু হওয়ার কথা।

এখন প্রশ্ন, ইউনান প্রদেশের পণ্য ৭০০ কিলোমিটারের পথ খরচ বাঁচিয়ে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে কেন রফতানি হবে না?

ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব মাত্র ২০০ কিলোমিটার। কেন ত্রিপুরা ১৬০০ কিলোমিটার দূরের কলকাতা বন্দর ব্যবহার করবে? চট্টগ্রাম বন্দর ত্রিপুরার সাব্রুম সীমান্ত (রামগড়) থেকে সড়কপথে মাত্র ৭৫ কিলোমিটার ও বিলোনিয়া সীমান্ত (ফেনী) থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরে।

কী করতে হবে তাহলে, বোধসম্পন্ন যে কেউই বিষয়টা বুঝবেন। কোথায় অগ্রাধিকার দিতে হবে তা সরকারকে ঠিক করতে হবে সবার আগে। আমরা পায়রা বন্দরের নামে বাকুম বাকুম করে সময়টা নষ্ট করছি, সঙ্গে অর্থও। প্রস্তাবিত বন্দরের আদৌ কোনো ফিজিবিলিটি রিপোর্ট আছে বলে জানা যায় না। একটি বন্দরের জন্য অবকাঠামো, নানা সুযোগ-সুবিধা ও যে স্টেকহোল্ডার দরকার তা গড়ে উঠতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন।

চট্টগ্রাম বন্দরের ইতিহাস হাজার বছরের। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ১২৮ বছরের পুরনো, ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর চ্যালেঞ্জটা নিতে হবে সবার আগে। উন্নত প্রযুক্তি ও নানা সুবিধা সংযুক্ত করে বন্দর সেবার পরিধি বাড়াতে হবে। ট্রানজিটের জন্য বন্দর উপযোগী করতে হবে দ্রুত। বর্তমানে ৯ মিটারের বেশি ড্রাফটের (গভীরতা) জাহাজ বন্দরে প্রবেশ করতে পারে না। নদীর নাব্যতা ও গভীরতা বাড়ানোর জন্য করা ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের পুরো অর্থটাই ইতোমধ্যে পানিতে গেছে।

আশার কথা হচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষ তার সক্ষমতা বাড়াতে হালিশহর-কাট্টলী উপকূলে বে’ টার্মিনাল করার পরিকল্পনা নিয়েছে। তারা মনে করছে, গড়ে ১৪ মিটার ড্রাফটের প্রায় ৫০টি জাহাজের বার্থিং সুবিধা দিতে পারবে এ টার্মিনাল। ৬.২ কিলোমিটার দৈর্ঘে্যর এ টার্মিনালের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা।

বন্দর সূত্রে জানা গেছে, সক্ষমতা বাড়াতে ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে লালদিয়ার চরে ৫০ একর জায়গায় বাল্ক টার্মিনাল নির্মাণের কাজও শুরু করা হবে দ্রুত।

সমুদ্রবন্দর এমন একটি অর্থনৈতিক অবকাঠামো যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। রফতানিমুখী শিল্প স্থাপন, কর্মসংস্থানের সুযোগ, রাজস্ব আয় বাড়াতে গতিময় ভূমিকা রাখে বন্দর। ভূ-অবস্থানগত সুবিধার কারণে গভীর সমুদ্রবন্দর বাংলাদেশের জন্য জরুরি।

কক্সবাজার জেলার সোনাদিয়া দ্বীপে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে রেখেছে সরকার। ২০০৯ সালে জাপানের জাইকার সহযোগিতায় এ প্রকল্পের অর্থনৈতিক ও কারিগরি সম্ভাব্যতা বা ফিজিবিলিটি সমীক্ষাও করা হয়েছে। তিন ধাপে ৫০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৩৫ বছরে (২০১৫-২০৫০) এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। সরকারের দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়িতব্য বা ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প হিসাবে বিবেচিত আটটি বড় প্রকল্পের চার নম্বরেই আছে গভীর সমুদ্রবন্দর। ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পগুলো হচ্ছে পদ্মাসেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেল, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর, পায়রা বন্দর, মৈত্রী সুপার থার্মাল (রামপাল) বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র ও এলএনজি টার্মিনাল।

সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর ফাস্ট ট্র্যাকের তালিকায় চার নম্বরে থাকলেও আঞ্চলিক শক্তি বা পক্ষগুলোর চাপে প্রকল্পটি স্থবির হয়ে আছে। প্রকল্প নিয়ে তৈরি হয়েছে এক ধরনের বিভ্রান্তিকর ও ধোঁয়াশা পরিস্থিতি।

ফাস্ট ট্র্যাকের ৭ নম্বর প্রকল্প হচ্ছে মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র। কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ি ও ধলঘাট ইউনিয়নে দু’টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৬০০ করে মোট এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগ। ২০২৩ সালে এ প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা। ব্যয় হবে ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা, যার বেশিরভাগ অর্থই দেবে জাপান।

কয়লাভিত্তিক এ বিদ্যুৎকেন্দ্রে মজুতের সুবিধাসহ কয়লা আমদানির জন্য একটি বন্দর বানানোর কথা রয়েছে। যেখানে ১৮ মিটার ড্রাফটের জাহাজ প্রবেশ করতে পারবে। ১৮ মিটার বা ৫৯ ফুট গভীরতা সবচেয়ে বড় জাহাজ ভেড়ার জন্য যথেষ্ট।

মাতারবাড়ি সোনাদিয়া থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে। কয়লা বন্দরে ১৮ মিটারের জাহাজ ঢোকার সুবিধা কিংবা কম দূরত্বের যুক্তি দেখিয়ে নতুন চিন্তা ভাবনার কথা ইনিয়ে বিনিয়ে বলার চেষ্টা করছে একটি প্রভাবশালী মহল।

জাপানের অর্থ সহায়তায় জানুয়ারিতে মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ শুরু হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় জাপান গড়ে তুলতে চায় গভীর সমুদ্রবন্দরের সুবিধা সম্বলিত জ্বালানি (কয়লা) আমদানির বন্দর। অন্যদিকে চীনের অর্থায়নে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের বিষয়টিও সরকার এখনো বাতিল করে দেয়নি।
কৌশলগতভাবে বঙ্গোপসাগর এখন গুরুত্বপূর্ণ। নিজেদের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এখানে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে পিছপা হবে না চীন, জাপান ও ভারতের মতো দেশগুলো। অতি সম্প্রতি নেদারল্যান্ডসও গভীর সমুদ্রবন্দরের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির হিসাব-নিকাশে ভারসাম্য রক্ষা করা সহজ কাজ নয়। তারপরও নিজেদের স্বার্থ সবার আগে। অর্থনৈতিক শক্তিগুলোকে আশ্বস্ত করতে হবে যে আমাদের স্বার্থটা কেবল অর্থনীতি চালিত। আমরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে চাই। সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরের স্বার্থটা শুধু বাংলাদেশের নয়, ভারতের সেভেন সিস্টার্স, মায়ানমার ও চীনের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলসহ পুরো দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ারও। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যিক হাব হওয়ার সম্ভাবনা হাতছাড়া করা ঠিক কাজ হবে না। আমরা দেরি করলে অন্যরা বিকল্প পথে হাঁটবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের ভাবনা জগৎ যুক্তিনির্ভর, সুদূরপ্রসারী ও বাস্তবসম্মত না হলে গোটা জাতি পিছিয়ে পড়বে।

রুশো মাহমুদ: সম্পাদক, সুপ্রভাত বাংলাদেশ

বাংলাদেশ সময়: ২১৪৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১৫
এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।