ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

ওরাও বাংলাদেশ

সৌরভ কুমার মণ্ডল, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ৪, ২০১৫
ওরাও বাংলাদেশ

অটিজম শব্দের সঙ্গে আমরা যতটা না পরিচিত, তার চেয়ে বেশি পরিচিত অটিস্টিক শিশুদের সঙ্গে। কারণ, এমন কোন গ্রাম বা মহল্লা খুঁজে পাওয়া দায় যেখানে কোন অটিস্টিক শিশুর দেখা মেলে না।

সুস্থ-স্বাভাবিক শিশুর চেয়ে অটিস্টিক শিশুদের আচরণ কিছুটা অন্যরকম হওয়ায় মানুষের চোখে পড়ে বেশি।

২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্য, লিঙ্গ বৈষম্য দূর করে ১৭টি ক্ষেত্রে বিশ্বকে এগিয়ে নিতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) গ্রহণ করেছেন বিশ্বনেতারা। এই লক্ষ্যমাত্রায় সহমত দিয়েছে বাংলাদেশও। অথচ, এসডিজিতে বাংলাদেশেরই তুলে ধরা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়- অটিজমের ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে খোদ বাংলাদেশই।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক চিকিৎসা বিষয়ক সংস্থা সেন্টার ফর ডিজিজেস কন্ট্রোল’র (সিডিসি) এর ২০১২ সালের তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতি ৮৮ জন শিশুর মধ্যে ১ জন অটিস্টিক। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটি হিসেব অনুযায়ী, এদেশে ১২ লাখ ৯০ হাজার শিশু অটিজম আক্রান্ত। এ সংখ্যা অনেক দেশের জনসংখ্যার কাছাকাছি। অথচ অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে বাংলাদেশে নির্ভরযোগ্য কোন পরিসংখ্যান নেই৷ নেই পর্যাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান৷ আর রাজধানী ঢাকায় এ নিয়ে অনেক কথাবার্তা হলেও সারা দেশের চিত্র আলাদা৷ অনেক মা-বাবা শুরুতে বুঝতেই পারেন না যে তাদের শিশুটি অটিস্টিক৷

অটিজম-কী ও কেন?
চিকিৎসাশাস্ত্রে অটিজমকে আচরণগত সমস্যা হিসেবে দেখা। অনেক শিশু অটিস্টিক হয়ে জন্মগ্রহণ করে। আবার অনেকে পরে নানা কারণে অটিজমে আক্রান্ত হয়।   অটিস্টিক শিশুরা দেখতে অন্য সব স্বাভাবিক শিশু কিশোরের সাধারণতঃ তিন বছর হওয়ার আগেই অটিজমজনিত আচরণ বোঝা যায়। প্রাথমিক অবস্থায় ছোট শিশুর ক্ষেত্রে- ১ বছরের মধ্যে মুখে অনেক আওয়াজ না করা, কিংবা আঙ্গুল দিয়ে বা অঙ্গভঙ্গি করে কোনো কিছু না দেখানো, কথা ও সামাজিক আচরণ যদি হঠাৎ খাপছাড়া হয়ে যাওয়া, চোখে চোখ না রাখা; আর একটু বয়সীদের ক্ষেত্রে: নাম ধরে ডাকলে সাড়া না দেয়া, আদর পছন্দ না করা, হঠাৎ রাগ, সামাজিক সম্পর্ক তৈরিতে দুর্বলতা, আনন্দ ভাগাভাগি না করা, একই কথার বার বার বলা বা তাকে বলা কোনো কথার পুনরাবৃত্তি করা, আচরণের পুনরাবৃত্তি, আওয়াজে বিরক্তি, খুব বেশি রুটিন মেনে চলা ও পরিবর্তন সহ্য করতে না পারা – ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য অটিজমের পরিচায়ক।

বাংলাদেশ: নতুন আশার আলো

বাংলাদেশে ২০০০ সালে অটিস্টিক  শিশুদের উন্নয়নে ঢাকায় প্রথম কাজ শুরু করে ‘সোসাইটি ফর দ্য ওয়েলফেয়ার অব অটিস্টিক চিলড্রেন (সোয়াক)। বেসরকারি পর্যায়ে ঢাকায় বেশ কিছু স্কুল আছে। তবে আসন খুবই কম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) ক্যাম্পাসে চলছে সিনাকের কার্যক্রম। সেখানে এই শিশুদের বিশেষ কৌশলে বিভিন্ন দৈনন্দিন কাজকর্মে অভ্যস্ত করে তোলেন অটিজম প্রশিক্ষকরা। মিরপুরে রয়েছে  ’অটিজম রিসোর্স সেন্টার। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে সরকারি মেডিকেল কলেজ পর্যায়ে ১০টির মতো শিশু বিকাশ কেন্দ্র রয়েছে। এ ছাড়া সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিটি জেলায় প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র থেকে অটিজম সেবা নেয়ার সুযোগ রয়েছে।

২০১১ সালের ২৫ জুলাই সায়মা ওয়াজেদের (পুতুল) পরামর্শক্রমে এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে Autism spectrum disorders and developmental disabilities in Bangladesh and South Asia এর আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ১১টি দেশের অংশগ্রহণে 'ঢাকা ঘোষণা' গৃহীত হয়; যা অটিজম শিশুদের উন্নয়নে এক মাইলফলক হিসেবে ধরা হয়। তার প্রচেষ্টায় ২০১১ সালের ২৫ জুলাই গঠিত হয় SOUTH ASIAN AUTISM NETWORK । ২০১৩ সালে ভারতের রাজধানীতে এর প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে কয়েকটি দেশের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশে প্রথম সদর দফতর প্রতিষ্ঠিত করে।

শুধু চিকিৎসা নয়- চাই সচেতনতা, চাই সহমর্মিতা
প্রত্যেক অটিস্টিক শিশুর জন্য চিকিৎসা পদ্ধতি কিছুটা আলাদা। বাংলাদেশে এখনও অটিজম সম্পর্কে সচেতনতার অভাব রয়েছে। এমনকি এ জন্য যে হাসপাতালগুলোতে পৃথক সেল বা চিকিৎসক থাকার কথা তাও নেই। তাই বিশ্বব্যাপী অটিজমের বার্তাকে পৌঁছে দিতে পারলেও খোদ বাংলাদেশই এ ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে। যখনই দেখা যায়, একজন অটিস্টিক শিশু ঠিকমতো বাড়ছে না বা কথা বলছে না কিংবা অস্বাভাবিক আচরণ করছে- তখন এদেশে তার প্রতি নেমে আসে পারিবারিক ও সামাজিক নিপীড়ন। অনেক শিশুকে শেকল দিয়ে খুঁটিতে বেঁধে রাখার ঘটনাও ঘটে। অটিজম আক্রান্ত অনেক শিশু শুধু গ্রামে নয়, শহরেও অসহনীয় জীবনযাপন করছে। এসব শিশু বড় হচ্ছে অবহেলায়, অনাদরে, বঞ্চনায়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, তাড়াতাড়ি চিহ্নিত করা গেলে অনেকটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে শিশুরা। এ জন্য প্রথমেই দরকার অটিজম আক্রান্ত শিশু কি না তা দ্রুত নির্ণয়, দ্রুত চিকিৎসা এবং উপযোগী পরিবেশ। সার্বিকভাবে, অটিজমকে জয় করতে হলে সচেতনতাই সবচেয়ে বড় মাধ্যম। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারকেও অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। একই সঙ্গে পিতা-মাতা সচেতন হলে, গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে শিশুর অটিজম বিষয়টি সূচনাতেই নির্ণয় করতে সক্ষম হবেন। অটিস্টিক শিশুদের অবহেলা ও লুকিয়ে রাখা নয় ; বরং তাদের প্রয়োজন নিবিড় যত্ন। তাদের সমাজ ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা যাবে না। তবেই তারা ক্রমশ সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে।

সৌরভ কুমার মণ্ডল: শিক্ষার্থী, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশ সময়: ১০৪৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ৪, ২০১৫
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।