ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

বাজিয়ে যাই ভাঙ্গা রেকর্ড | মুহম্মদ জাফর ইকবাল

... | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১১৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৫
বাজিয়ে যাই ভাঙ্গা রেকর্ড | মুহম্মদ জাফর ইকবাল

বেশ কয়েক বছর আগে আমার একজন তরুণের সাথে দেখা হয়েছিল। সে আমার পা ছুঁয়ে সালাম করে বলল, ‘আমি অমুক’।

বলাই বাহুল্য আমি তার নাম থেকে তাকে চিনতে পারলাম না। তখন তরুণটি বলল, ‘আপনি আমার বাবাকে চিনতে পারেন। নকল করার সময় ধরে ফেলেছিলেন বলে একটা ছাত্র চাকু মেরে আমার বাবাকে খুন করে ফেলেছিল। ’

সাথে সাথে আমি তরুণটিকে চিনতে পারলাম। তার শিক্ষক বাবার হত্যাকাণ্ডের খবরটি খবরের কাগজে ছাপা হয়েছিল। নকল ধরার জন্য একজন শিক্ষককে খুন করে ফেলার ঘটনাটি শুধু আমার নয় – সারা দেশের সব মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়েছিল। একজন ছাত্র যখন পরীক্ষায় নকল করা শিখে এবং সেটাকে তার অধিকার মনে করে তখন সেটা খুবই বিপজ্জনক হতে পারে।

এই মুহূর্তে আমার সেই ঘটনাটি মনে পড়ছে এবং আমি এক ধরণের তীব্র হতাশায় দীর্ঘশ্বাস ফেলছি। মাত্র কয়েক বছর আগেও পরীক্ষায় নকল করা বিষয়টি বলতে গেলে ছিল না, এক দুইজন নকলবাজ আর খুনী প্রায় এক পর্যায়ের অপরাধী ছিল। আমার মনে হয় এই সরকারের আমলে শিক্ষার নামে এই দেশের যত বড় সর্বনাশ হয়েছে আর কখনো এতো বড় সর্বনাশ হয়নি। পরীক্ষায় আগেও কখনো কখনো ঢালাওভাবে বড় ধরণের নকল হয়েছে কিন্তু আগে কখনো শিশুদের সেই নকল উৎসবের সামিল করা হয়নি।

মাত্র পি.এস.সি. এবং জে.এস.সি. পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এই দেশের প্রায় ৩০ লক্ষ ছেলেমেয়ে পি.এস.সি. এবং ২০ লক্ষ ছেলেমেয়ে জে.এস.সি পরীক্ষা দিয়েছে। এবং আমরা সবাই জানি এই পরীক্ষাগুলো এখন আর সত্যিকারের পরীক্ষা নয় – এগুলো এখন এক ধরণের প্রহসন, বড়জোর উৎকট রসিকতা।

ছোট ছোট শিশুরা বড়দের মত নকল করা শিখেনি তাই তাদেরকে নকল করতে সাহায্য করার জন্যে শিক্ষকেরা এগিয়ে আসছেন, তাদেরকে উত্তর বলে দিচ্ছেন কাগজে উত্তর লিখে একজন একজন করে সবাইকে ধরিয়ে দিচ্ছেন। অন্যায় এবং অপরাধ করায় একজন শিশুর হাতেখড়ি হয়ে যাচ্ছে এবং সেই হাতেখড়িটি হচ্ছে শিক্ষাকে উপলক্ষ করে।

আমরা জানি এই পরীক্ষাগুলোতে ঢালাওভাবে সবাই পাশ করে যাবে – এবং নানা ধরণের যাচাই জরিপ এবং গবেষণা করে দেখা গেছে এই বয়সী ছেলেমেয়েদের যখন যেটুকু জানা দরকার ছেলেমেয়েরা তার ধারে কাছে নেই। অর্থাৎ পরীক্ষাগুলো আসলে ছেলেমেয়েদের মূল্যায়ন করতে পারে না, তাহলে এতো হইচই করে এতো বড় দজ্ঞ যজ্ঞ করে সবাইকে এতো কষ্ট দিয়ে কেনো খামোখা এই পরীক্ষাগুলো নেয়া হয়? সবচেয়ে বড় কথা এই দেশের শিশুদের অন্যায় করতে শেখানো ছাড়া এই পরীক্ষাগুলো নিয়ে কী লাভ হচ্ছে?

আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে যারা খোঁজখবর রাখেন তারা এই বিষয়গুলো জেনে কখনো হতাশা অনুভব করেন কখনো ক্ষুব্ধ হয়ে যান। আমার জন্য বিষয়টি আরো অনেক বেশি বেদনাদায়ক কারণ আমি একই সাথে অপরাধবোধে ভুগতে থাকি। কারণ এই সরকার যখন জোট সরকারকে নির্বাচনে হারিয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে তখন শিক্ষা নিয়ে নানা ধরণের পরিকল্পনা করার সময় দেশের অনেক বড় বড় শিক্ষাবিদের সাথে আমাকেও ডেকেছিল। আমাকে সরকার কিংবা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যখন যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করেছি (বড় বড় মিটিংয়ে অন্য সবাই ঢাকা শহরের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতেন – আমাকে যেতে হতো সিলেট থেকে ট্রেনে বাসে গাড়িতে!)।

আমাদের দেশের শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটিতেও অন্য অনেকের সাথে আমিও একজন সদস্য ছিলাম। আমি মনে করি আমাদের দেশের জন্যে সেই শিক্ষানীতিটি চমৎকার একটা শিক্ষানীতি ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেই শিক্ষানীতির উপর আমাদেরকে না জানিয়ে কাঁচি চালানো হয়েছে।

আমরা যে খসড়া শিক্ষানীতিটি মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছিলাম সেখানে মাত্র দু’টি পাবলিক পরীক্ষার কথা বলা হয়েছিল। যে শিক্ষানীতিটি গ্রহণ করা হয়েছে সেখানে কীভাবে কীভাবে জানি তিনটি পাবলিক পরীক্ষার কথা চলে এসেছে। যদি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আমরারাই এতোগুলো শিক্ষাবিদ থেকে বেশি জানেন এবং বুঝেন এবং তাদের ইচ্ছামতো পাবলিক পরীক্ষার সংখ্যা বাড়িয়ে দিতে পারেন তাহলে কেনো এতোগুলো শিক্ষাবিদকে একটা শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে দিলেন?

সবচেয়ে মজার কথা হচ্ছে শিক্ষানীতিতে তিনটি পাবলিক পরীক্ষার কথা বলা হলেও আমরা জানি এই দেশের ছেলেমেয়েদের একটি নয় দু’টি নয় এমনকি তিনটিও নয়, চার চারটি পাবলিক পরীক্ষা দিতে হয়! যারা এই সিদ্ধান্তগুলো নেন আমার কেনো জানি মনে হয় তাদের ছেলেমেয়েরা আমাদের দেশের মূল ধারার শিক্ষা ব্যবস্থায় লেকাপড়া করে না, তারা সম্ভবত ইংরেজি মাধ্যমের ও-লেভেল কিংবা এ-লেভেলে পড়াশোনা করে। তাই সাধারণ ছেলেমেয়েদের দুঃখকষ্ট যন্ত্রণার কথা তারা কোনোদিন টের পান না, কিংবা সেটা নিয়ে মাথা ঘামান না।

পি.এস.সি. এবং জে.এস.সি. পরীক্ষাতে ছোট শিশুদের নকল করতে শেখানোই যে আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার একমাত্র সমস্যা তা কিন্তু নয়। আমরা সবাই জানি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস এখন মোটামুটি নিয়মিত ঘটনা হয়ে গেছে। মাত্র কিছুদিন আগে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। সরকার তোতাপাখির মত বলে গেছে যে আসলে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি।

আমাদের দেশের বড় বড় শিক্ষাবিদেরা নিজেদের উদ্যোগে তদন্ত করে নিশ্চিত হয়েছেন যে আসলেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে কিন্তু তাতে উনিশ বিশ কিছু হয়নি। ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নে যারা পরীক্ষা দিয়েছে তারাই সবার আগে মেডিকেলে ভর্তি হয়েচে। যারা সারা বছর মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করেছে দুর্বৃত্তরা তাদেরকে এই দেশে তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে দেয়নি। কমবয়সী ছেলেমেয়েদের জীবনের শুরুতে এই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতাটুকু তাদেরকে যে হতাশার দিকে ঠেলে দিয়েছে তার দায়িত্ব কে নেবে?

এই দেশে পদ্মা ব্রিজ তৈরি হচ্ছে, এই দেশে বঙ্গবন্ধু স্যাটালাইট মহাকাশে পাঠানো হবে, এই দেশে নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হবে কিন্তু যে ছেলেটি বা মেয়েটির জীবনের সব স্বপ্ন এই দেশ কেড়ে নিয়েছে তার কাছে এর কোনো গুরুত্ব নেই। আমাদের এই দেশটি গড়ে তুলবে নূতন প্রজন্ম, এখন যারা শিশু কিশোর কিশোরী কিংবা তরুণ তরুণী। তারা যদি এখন বুঝে যায় এই দেশে সসতার মূল্য নেই এই দেশ আসলে অসৎ অপরাধী দুর্বৃত্তদের, তাহলে তারা কোন আশায় ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকবে? একটি দেশের সরকার যে এতো অবহেলায় একটা জাতির ভবিষ্যৎকে পা দিয়ে ধূলোয় মাড়িয়ে দিতে পারে সেটি নিজের চোখে দেখেও আমার বিশ্বাস হয় না।

যখন প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়না তখনো কি পরীক্ষা ভালো হয়? না, আমরা এখন সেটাও দাবি করতে পারি না। আমাদের দেশে লেখাপড়া নিয়ে যে বাণিজ্য হয় সেরকম বাণিজ্য বুঝি আর কোথাও হয়না। দেশে যখন সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি শুরু হয়েছিল ঠিক তখনই সৃজনশীল গাইড বই বের হতে শুরু করল। এর থেকে আর বড় রসিকতা কি হতে পারে? দেশে যখন এরকম ঘটনা ঘটে তখন সাধারণত সংবাদ মাধ্যম বিষয়টি নিয়ে হইচই শুরু করে। বিষয়টি দশ জনের চোখে পড়ে। দুর্বৃত্তরা তখন পিছিয়ে যায়। আমাদের দেশে সেটি কখনোই হবে না কারণ এই দেশের যত বড় বড় পত্রিকা রয়েছে তারা নিজেরাই তাদের পত্রিকায় গাইড বই ছাপিয়ে যাচ্ছে। দেশে গাইড বই বেআইনি কিন্তু যখন সবার সামনে পত্রিকাগুলো তাদের পত্রিকায় দিনের পর দিন গাইড বই ছাপিয়ে যাচ্ছে তখন তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার একটি মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না।

এই দেশের ছেলেমেয়েদের সাথে আমার এক ধরনের যোগাযোগ আছে, কিছু একটা অঘটন ঘটলেই তারা আমার কাছে সেটা নিয়ে অভিযোগ করে। তাই যখন সৃজনশীল গাইড বই বের হতে শুরু করল এবং শিক্ষকেরা সেই গাইড বই থেকে প্রশ্ন তুলে নিয়ে তাদের ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষা নিতে শুরু করল তখন ছেলেমেয়েরা আমার কাছে নানাভাবে অভিযোগ করতে শুরু করল। আমি তখন তাদেরকে বলেছি স্কুলের পরীক্ষায় একজন শিক্ষক গাইড বই থেকে প্রশ্ন তুলে দিতেই পারে এবং একজন ছেলে বা মেয়ে গাইড বই মুখস্থ করে সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সেই শিক্ষকের কাছে ভালো নম্বর পেয়েও যেতে পারে। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না।
কারণ যে পরীক্ষাগুলো তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে সেই পরীক্ষায় কখনোই কোন গাইড বই থেকে কোন প্রশ্ন দেয়া হবে না। গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষকেরা সেই প্রশ্নগুলো প্রথমবারের মত তৈরি করবেন এবং পৃথিবীর কেউ আগে সেই প্রশ্নগুলো দেখবে না। কাজেই গাইড বই মুখস্থ করে কখনোই সেই প্রশ্নের উত্তর দেয়া যাবে না। সেই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য ছেলেমেয়েদের পাঠ্য বইটা মন দিয়ে পড়তে হবে, তার বিষয়বস্তুটা বুঝতে হবে। কাজেই গাইড বই নামক এই কুৎসিত বিষয়টা একটা ছেলে বা মেয়ের জীবনে কোন ভূমিকা রাখে না।

ঠিক তখন একটা ভয়ানক ঘটনা ঘটল, আমি দেখতে পেলাম পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নগুলো গাইড বই থেকে নেয়া শুরু হয়েছে। সৃজনশীল পরীক্ষার মত এতো সুন্দর একটা পরীক্ষা পদ্ধতি মুহূর্তের মাঝে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধূলিসাৎ করে দিল। সৃজনশীল পদ্ধতি শুরু করার আগে ছেলেমেয়েরা শুধু পাঠ্য বই মুখস্থ করত। এখন তারা পাঠ্যবই এবং একাধিক গাইড বই মুখস্থ করে। একটা ছেলে বা মেয়ের সৃজনশীলতা যাচাই করার আর কোন উপায় থাকলো না। এখানেই যদি শেষ হয়ে যেতো তাহলেও একটা কথা ছিল, এখানেই কিন্তু শেষ নয়। সারা পৃথিবীতে স্কুলে কিংবা কলেজে ছেলেমেয়েরা ক্লাস করে, সেখানে শিক্ষকেরা পড়ান।

আমাদের দেশে শিক্ষকেরা ক্লাস রুমে পড়ায় না। তারা প্রাইভেট পড়ান, একসাথে অনেককে নিয়ে ব্যাচে পড়ান। একেকটা ব্যাচে কোন একটা ঘরে অনেক ছেলেমেয়ে
গাদাগাদি করে থাকে এবং শিক্ষকেরা আন্তরিকভাবে তাদেরকে পড়ান কারণ পড়ানোর জন্য তারা ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে নগদ টাকা নেন। আমি সাংবাদিক নই তাই অনুসন্ধান করে একজন শিক্ষক ঘণ্টা খানেকের মধ্যে কতো টাকা কামাই করে ফেলেন সেটা বের করতে পারবো না, কিন্তু যারা ব্যাচে পড়েছে তারা বলেছে টাকার পরিমাণ পঞ্চাশ থেকে সত্তুর হাজার হতে পারে! আমি যতদূর জানি বেশিরভাগ শিক্ষকই নাকি এরকম, কিন্তু এখনো একজন দুজন শিক্ষক আছেন যারা প্রাইভেট পড়ান না, ব্যাচে পড়ান না। তারা সত্যিকারের শিক্ষকের মত ক্লাসরুমে এসে পড়ান। এইসব শিক্ষকদের জীবন খুব কষ্টের, ভালো ভালো স্কুল কলেজে তারা টিকতে পারে না, তাদের শক্তিশালী সহকর্মীরা তাদের মফস্বলে বদলি করে দেন।

এই দেশের স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েদের জীবন খুবই বিচিত্র। তারা কোন একটা স্কুল কিংবা কলেজের ছাত্র কিংবা ছাত্রী, কিন্তু তাদের লেখাপড়া হয় কোচিং সেন্টারে কিংবা কোন একজন শিক্ষকের বাসায়। ছাত্র কিংবা ছাত্রীরা এর মাঝে কোন অস্বাভাবিকতা খুঁজে পায় না, বাবা মায়েরা এটাকেই নিয়ম বলে মেনে নিয়েছেন। কোচিং সেন্টারগুলোর রমরমা ব্যবসা- যখন পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয় তখন মাঝে মাঝে কোনো কোনো কোচিং সেন্টারের নাম শুনতে পাই। কিছুদিন আগে একটি কোচিং সেন্টারের মালিক আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন। সৌজন্যের কথা শেষ করে বললেন, ‘আমার একটা কোচিং সেন্টার আছে, সেখানে একটা অনুষ্ঠান করবো আপনাকে প্রধান অতিথি হিসেবে নিতে চাই। ’

আমি কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, ‘যদি দেশের পকেটমাররা একটা সংগঠন তৈরি করে তাদের বার্ষিক ডিনারে আমাকে প্রধান অতিথি হিসেবে নিতে চায় আমার কী যাওয়া উচিৎ হবে?’

ভদ্রলোক একেবারে থতমত খেয়ে বললেন, ‘না উচিৎ হবে না। ’
আমি বললাম, ‘‘তাহলে আমারও আপনার কোচিং সেন্টারের অনুষ্ঠানে যাওয়া উচিৎ হবে না। কারণ আমার কাছে কোচিং সেন্টার আর পকেটমারের সংগঠন মোটামুটি একই ব্যাপার!’’

ভদ্রলোক খুবই মনক্ষু্ন্ন হয়ে চলে গেলেন। আমি জানি আমার এই লেখা পড়ে দেশের অনেক মানুষ মনক্ষুন্ন হবেন, বলবেন, ‘‘হতে পারে কোচিং সেন্টার বিষয়টা ভাল না-তাই বলে পকেটমারের সাথে তুলনা করতে হবে! ছিঃ ছিঃ ছিঃ!’’
স্কুল কলেজের কোচিংয়ের পাশাপাশি ভর্তি কোচিং বলেও একটা অন্য রকম কোচিং আছে। রাস্তাঘাটে, দেয়ালে ভর্তি কোচিংয়ের বিজ্ঞাপন দেখি। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম দিয়ে ভর্তি কোচিং করা হয়। মেডিকেল কোচিং করার জন্য বাংলাদেশের প্রত্যন্ত শহর থেকে ছেলেমেয়েরা ঢাকায় চলে এসে বাসা ভাড়া করে থাকে। অথচ আমরা জানি
পুরো ব্যাপারটা প্রতারণা ছাড়া আর কিছু না-পুরো দেশটা কিছু প্রতারকের হাতে আটকা পড়ে আছে।

অথচ কত সহজেই এই পুরো ব্যাপারটা নিষ্পত্তি করা যেতো। এইচএসসি শেষ হওয়ার এক সপ্তাহের ভেতর যদি ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে নেয়া যেতো তাহলে চোখের পলকেই এই পুরোপুরি অর্থহীন কোচিং ব্যবসার মূল উৎপাটন করে দেওয়া যেতো!

আমি যখন এটা লিখছি তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা চলছে। বাবা মায়েরা তাদের ছেলে মেয়েদের নিয়ে এক শহর থেকে অন্য শহরে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। সেখানে তাদের থাকার যায়গা দূরে থাকুক বাথরুমে যাবার সুযোগ পর্যন্ত নেই। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা দিয়ে তারা বাসে ওঠে, সারারাত জার্নি করে অন্যকোন অচেনা শহরে গিয়ে হাজির হয়। তাদের খাওয়া নেই, ঘুম নেই। শ্রান্ত ক্লান্ত বিধ্বস্ততার মাঝে তারা ভর্তি পরীক্ষা দেয় এর চাইতে নিষ্ঠুর কোন ব্যাপার আমার চোখে পড়ে না। এবং আমাদের দেশের কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের সাথে এই নিষ্ঠুরতাগুলো কারা করছে? করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। কেন করছে? শুধু মাত্র বাড়তি টাকার জন্যে! শুধু মাত্র বাড়তি কিছু টাকার জন্যে!! শুধু মাত্র বাড়তি কিছু টাকার জন্যে!!! (না একই বাক্য তিনবার লেখাটি কোন মুদ্রণ প্রমাদ নয়- আমি ইচ্ছা করেই লিখেছি যেন যারা পড়ছে তারা বিষয়টি জানে। )

খুব সহজেই সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেয়া সম্ভব। আমাদের দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু টাকার লোভ ছেড়ে এই ধরনের ভর্তি প্রক্রিয়ার মাঝে যেতে রাজি নয় তাই আমরা একবার ছোট দুটি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে প্রক্রিয়াটা শুরু করেছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল সবাইকে দেখানো কাজটি কত সহজ। এবং সেটি দেখে পরেরবার হয়তো আরো বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে আসবে। প্রায় সব আয়োজন শেষ করার পরও সেটি করা যায়নি কারণ এই দেশের বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে দিল। আমি তাই দেশের বামপন্থী নেতাদের, বড় বড় কমিউনিস্টদের খুঁজে বেড়াই জিজ্ঞেস করার জন্যে, ‘‘আপনারা দেশের শোষিত মানুষের কষ্ট লাঘব করার জন্যে রাজনীতি করেন! তাহলে এই কমবয়সী কিশোর কিশোরীরা কি দোষ করেছে? তাদের কষ্ট একটুকু কমানোর জন্যে চেষ্টা হলে আপনারা কোন যুক্তিতে তার বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন?’’
আমি এই প্রশ্নটি করার জন্য এখনো কাউকে খুঁজে পাইনি।
২.
আমি যেহেতু ছোটদের জন্যে লেখালেখি করি তাই ছোট ছেলেমেয়ে আমার কোনো লেখা দেখলেই এটা তাদের জন্য লেখা মনে করে সেটা পড়ে ফেলার চেষ্টা করে বলে শুনেছি। আমার এই লেখাটাও যদি তাদের চোখে পড়ে যায় এবং তারা যদি এটা পড়ে ফেলে তাহলে তাদের খুব মন খারাপ হবে-কারণ এই পুরো লেখাটিতে এখন পর্যন্ত আমাদের দেশের লেখাপড়া নিয়ে একটি ভালো কথা লেখা হয়নি। এই দেশের লেখাপড়ার ব্যাপারে বলার মত ভালো কথা একটিও নেই সেটাও তো সত্যি নয়।

যেমন এই দেশের প্রায় ত্রিশ লক্ষ ছেলে মেয়ে পিএসসি পরীক্ষা দেয় এবং তার মাঝে ছেলে মেয়ে প্রায় সমান সমান। সত্যি কথা বলতে কী ছেলে থেকে মেয়েদের সংখ্যা একটু বেশী।

জেএসসি পরীক্ষা দেয় প্রায় বিশ লক্ষ, এসএসসি পরীক্ষা দেয় প্রায় পনেরো লক্ষ  এবং এইচএসসি পরীক্ষা দেয় প্রায় দশ লক্ষ ছাত্রছাত্রী। যদি হিসেব করি তাহলে দেখবো শুধু স্কুল আর কলেজেই তিন কোটি ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করে-সবাই যখন ঠিক করে লেখাপড়া করবে তখন কি অসাধারণ একটা ব্যাপার ঘটবে সেটি কেউ চিন্তা করে দেখেছে? এইতো সামনে ইংরেজি নববর্ষ এবং তখন দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া হবে। জানুয়ারির এক তারিখ স্কুলের ছেলে-মেয়েরা তাদের নতুন বইগুলোকে বুকে চেপে ধরে মুখে বিশাল একটা হাসি নিয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে এর থেকে সুন্দর দৃশ্য পৃথিবীতে আর কি হতে পারে? শুধু তাই নয় পাঠ্য বইগুলো আগের তুলনায় অনেক ভাল হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীরা আর কিছু না পড়ে যদি শুধুমাত্র পাঠ্য বইগুলো মন দিয়ে আগাগোড়া পড়ে তাহলেই কিন্তু লেখাপড়া পুরোটা হয়ে যাবে-তাদের প্রাইভেট টিউটর, কোচিং কিংবা ব্যাচে পড়তে যেতে হবে না! গাইড বই যদি ভুলেও খুলে না দেখে তাহলেতো কথাই নেই।

আমি নিশ্চিত আগে হোক পরে হোক আমাদের দেশের লেখাপড়ার বিষয়টা ঠিক হয়ে যাবে, তার প্রধান কারণ তার জন্যেতো এই মুহূর্তে আলাদা করে কিছু করতে হবে না। ছেলে-মেয়েদের আমরা শুধু একটুখানি উৎসাহ দেব, তাদের মাথার ভেতরের মস্তিষ্কটাকে একটুখানি উসকে দেব, হাতে নতুন বই তুলে দেব, শিশুদের একটুখানি সম্মান দেব-এর বেশীতো আমরা কিছু চাইছি না। একটা দেশে, যেই দেশের মানুষ কী আমাদের সেটুকুও দেবে না?
নিশ্চয়ই দেবে। যদি না দেয় আমি আমার ভাঙ্গা রেকর্ডটি বাজিয়েই যাব!

বাংলাদেশ সময়: ০১১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।