ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

নাগরিকত্ব বিল বিতর্ক

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৭
নাগরিকত্ব বিল বিতর্ক

নাগরিকত্ব বিল নিয়ে দেশে-বিদেশে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা দেখা দিয়েছে। গত বছর নতুন এ বিলের খসড়া পাস হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট সবার নজরে আসার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় প্রতিক্রিয়া ও বিতর্ক। আইনজীবী ও বিশেষজ্ঞগণ খসড়ার নেতিবাচক দিক উল্লেখ করে গণমাধ্যমে নিবন্ধ লেখেন।

নাগরিকত্ব ও প্রবাসীবিষয়ক নানা সংগঠন তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দেশে বিদেশে সভা-সমাবেশের আয়োজন করে। টিভিতে আয়োজন করা হয় টকশো’র।

সংশ্লিষ্টদের তীব্র প্রতিক্রিয়ার পর সম্প্রতি এক সেমিনারে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক আইনটি প্রবাসীবান্ধব করা এবং খসড়া বিলের কিছু ধারা-উপধারা সংশোধনের কথা উল্লেখ করেন।

নাগরিকত্ব আইনের পটভূমি সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু প্রকাশিত হয়নি। যে কোনো আইনই জনস্বার্থে প্রণীত হয় এবং আগের আইন যুগোপযোগী করতে নতুন আইন তৈরির প্রয়োজন হয়। ধরে নেয়া যায়, দেশের বিদ্যমান সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট ১৯৫১ এবং বাংলাদেশ সিটিজেনশিপ অর্ডার ১৯৭২’র হালনাগাদ করা, ভবিষ্যত রাষ্ট্রহীনতা সংক্রান্ত নতুন ইস্যু প্রতিরোধ, দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা ইস্যুর সমাধান আইনের লক্ষ্য হতে পারে।

কিন্তু আইনের খসড়া সংবলিত যে বিলটি পাস হয়েছে, তা আগ্রহীমহলের নজরে আসার পরে বলা হচ্ছে যে, নাগরিকত্ব, দ্বৈত নাগরিকত্ব, প্রবাসে জন্ম নেয়া শিশুর নাগরিকত্ব- এসব ইস্যুগুলোকে জটিল করে তুলবে। প্রকাশিত নিবন্ধ এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপ, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়ায় সভা-সেমিনারে এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।

আইনের মুখ্য স্টেকহোল্ডার প্রবাসী বাংলাদেশি এমনকি জনসাধারণের মতামত নেওয়া হয়নি এবং সরকারিভাবে আইনের খসড়াও প্রকাশ করা হয়নি।

খসড়া বিলটি নিয়ে বিতর্ক ওঠে যে, এই খসড়া সংবিধান, জাতিসংঘ সনদ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও নারী-শিশু অধিকারের পরিপন্থি ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ। খসড়াটি দুর্বলভাবে লিখিত বলেও বলা হয়। আলোচনায় বলা হয়, খসড়ায় প্রবাসী ও দ্বৈত নাগরিকদের ক্ষেত্রে নাগরিক অধিকার সীমিত ও শর্তযুক্ত করা হয়েছে। নাগরিকত্ব পাওয়ার নানা সংজ্ঞা ও শর্তের জন্য নাগরিক বিভেদ তৈরি এবং প্রবাসে জন্ম নেয়া শিশুর নিবন্ধন না করা হলে রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ার ঝুঁকিও রয়েছে। এ আইনের বহু ধারা উপধারা অস্পষ্টতাজনিত অপব্যবহারের সুযোগ থাকায় সামাজিক ন্যায়বিচার ক্ষুন্ন হওয়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করা হয়।

খসড়া বিলের ৫ (ক) ধারায় প্রবাসীদের সন্তান জন্মের দু’বছরের মধ্যে জন্মনিবন্ধন করতে বলা হয়েছে। ‘খ’ ধারায় জন্মগ্রহণকারী দেশের নিবন্ধন না থাকলেও বংশগত নাগরিক হতে পারবে না বলে বলা হয়েছে। সময় বেঁধে দেয়ায় বাবা মা’র গাফিলতি কিংবা অভিবাসনের ক্ষেত্রে অপেক্ষমান প্রবাসীর সদ্যজাত সন্তান স্থানীয় জন্মসনদ না পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে পড়বে। এমনকি নাগরিক হওয়ার যোগ্যতার ক্ষেত্রে পিতার দোষ-ত্রুটির জন্য সন্তানকে নাগরিকত্ব অধিকারবঞ্চিত করা হয়েছে। যা আন্তর্জাতিক শিশু সনদে প্রদত্ত শিশু অধিকারের পরিপন্থি। খসড়ার ৬ নম্বর ধারায় প্রবাসীদের বাবা, মা, পিতামহ, মাতামহ বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণের আগে বাংলাদেশের নাগরিক হলে নাগরিকত্বের সুযোগ রাখা হয়েছে।

তবে দেশে বসবাসরত জন্মসূত্রেপ্রাপ্ত নাগরিকদের তুলনায় বৈষম্যমূলক সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছে। প্রবাসী নাগরিকদের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, রাষ্ট্রপতি পদ এবং সংসদ সদস্যপদসহ যে কোনো স্থানীয় সরকার পদে নির্বাচন এবং বিচার বিভাগ ও সরকারি চাকরিতে নিয়োগের মতো নাগরিক অধিকারের ওপর বাধা আরোপ করা হয়েছে।

১১ নম্বর ধারার মাধ্যমে বৈবাহিক সূত্রে বিদেশি নাগরিকদের বাংলাদেশী নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ অবারিত করা হয়েছে। তবে এর ১৩ নম্বর ধারা জন্মসূত্রে নাগরিক ছাড়া বংশগত, দ্বৈত নাগরিকত্ব, সম্মানসূচক, দেশীয়করণ, বৈবাহিক সূত্রের নাগরিকদের অধিকারের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা আরোপ করায় নাগরিকদের মর্যাদার ক্ষেত্রে বিভাজন তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধান সব নাগরিকের সমান অধিকার দিয়েছে এবং কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষমমূলক আচরণ না করার অঙ্গীকার করেছে।

সংবিধানের ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯ অনুচ্ছেদে নাগরিক সমান অধিকার, রাজনীতি কিংবা সরকারি কর্মে নিয়োগে অধিকারের বিষয়গুলোর বিস্তারিত উল্লেখ আছে। জাতিসংঘ সনদ, সার্বজনীন মানবাধিকার, নাগরিক ও রাজনৈতিক বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তিসমূহেও সব মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করা ও বৈষম্য নিরসনের অঙ্গীকার রয়েছে। এ অবস্থায় খসড়া আইনের ধারাগুলো আন্তর্জাতিক চুক্তির সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে বিশেষজ্ঞরা পত্রিকায় বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন। আইনের খসড়া নিয়ে অল ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন-আয়েবা কর্তৃক কুয়ালালামপুরে আয়োজিত বাংলাদেশ গ্লোব্যাল সামিটে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়। প্রবাসীদের বিশ্বসম্মেলনে বিশ্বের নানা দেশ থেকে আসা কমিউনিটি প্রতিনিধিরা এ আইনকে প্রবাসীবান্ধব করা এবং প্রবাসীদের পরবর্তী প্রজন্মকে দেশমুখী করতে সহায়ক আইন প্রণয়ন ও উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান। এ নিয়ে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস-রামরু সচেতনতামূলক সেমিনারের আয়োজন করে ঢাকায়।

বৃটেনের প্রবাসী কমিউনিটির বিভিন্ন সংগঠন গোলটেবিলে প্রতিক্রিয়া জানায়। যুক্তরাজ্য প্রবাসীদের প্রতিক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে লন্ডন হাইকমিশন থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে বিশেষ নোট পাঠানো হয়। সর্বশেষ সেন্টার ফর নন রেসিডেন্স বাংলাদেশিজ-এনআরবি রাজধানীতে এক সেমিনারের আয়োজন করে খসড়ার নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরে। সেমিনারে আইনমন্ত্রী ইতোমধ্যে প্রকাশিত উদ্বেগের বিষয়গুলো নিরসন করে খসড়া সংশোধনের বিষয়টি উল্লেখ করেন।

বিশ্বজুড়ে ডায়াসপোরা কমিউনিটি ও তাদের দ্বিতীয়-তৃতীয় প্রজন্ম নিজ দেশ-উন্মুখ। প্রবাসী বাংলাদেশী ও তাদের নতুন প্রজন্মের রয়েছে স্বভাবজাত শেকড়ের টান। তারা দেশে বিনিয়োগ করতে চায়, প্রবাসের অর্জিত অভিজ্ঞতা দেশকে ফিরিয়ে দিতে চায়, বসবাস ও নিয়মিত যাতায়াত করতে চায়। কোনো আইনি বাধা যাতে প্রবাসী ও তাদের বংশজাত লাখো মানুষকে দেশ বিমুখ না করে সে জন্য সতর্ক দৃষ্টি রাখা জাতির জন্য কল্যাণকর। আশার কথা, আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছেন, নাগরিকত্ব আইন হবে প্রবাসীবান্ধব। প্রবাসে বসবাসরত এককোটি ৩০ লাখ বাংলাদেশির ক্ষতি হয় এমন কিছুই করা হবে না।

লেখক:সিনিয়র সাংবাদিক, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বাংলানিউজ

বাংলাদেশ সময়: ২০২৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৭
এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।