ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

রাষ্ট্রভাষা নিয়ে ‘দুশমন’ ‘দরদী’ বিতর্ক

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৪০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৭
রাষ্ট্রভাষা নিয়ে ‘দুশমন’ ‘দরদী’ বিতর্ক ছবি: সংগৃহীত

ভারতবর্ষের স্বাধীনতার আগে থেকেই বাঙালি পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবি জানিয়ে আসছিল। বাঙালি তার সে ন্যায্য দাবি সভা-সমাবেশ বা লেখালেখির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছিল। তমুদ্দুন মজলিশও ছিল মূলত একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। সংগঠনটি মূলত পুস্তিকা ও লেখালেখির মাধ্যমেই বাংলা ভাষার দাবিটি পাকিস্তানি শাসকদের নজরে আনার চেষ্টা করেছে।

ভাষার এ দাবি পাকিস্তান সৃষ্টির পরেও অব্যাহত ছিল। গণপরিষদ ও গণপরিষদের বাইরে-উভয় ক্ষেত্রেই বাঙালি তার দাবি পেশ করে আসছিল।

গণপরিষদে প্রথম বিষয়টি উত্থাপন করেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ১৯৪৮ সালের ২৩ মার্চ তিনি গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকেও অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। কিন্তু তার বিরুদ্ধে নাজিমুদ্দিন-তমিজুদ্দিন গং ও আব্দুর রব নিস্তাররা ক্ষেপে গেলেন। ক্ষেপে যাওয়ারই কথা কারণ তাদের পেছনে ছিলেন পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর বড় বড় হোমরা-চোমরারা। তারাও প্রকাশ্যেই সেদিন বাংলার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান গণপরিষদে ধীরেন্দ্র নাথের বিরুদ্ধে সদম্ভে বললেন, “Pakistan is a Muslim state and it must have its Langua Franca-the language of Muslims. Mr. Dutta is a Congress member. He should realize that Pakistan has been created because of the demand of hundred million Muslims of the sub-continent. The language of the hundred million Muslims is Urdu and that language can only be taken as state language.”

শুধু লিয়াকত আলী খানই নন, পুরো পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাঙালি ও বাংলা সম্পর্কে এক ভ্রান্ত ও অবাস্তব ধারণা পোষণ করতো। মুসলমানদের কোনো নির্দিষ্ট ভাষা নেই। পৃথিবীর সব দেশেই কম-বেশি মুসলমান বাস করে। সবার ভাষাই কি তবে উর্দু? তাদের এসব অসংলগ্ন ধারণার জন্যই বাঙালিদের তারা ভিন্ন চোখে দেখতো। লিয়াকত আলী উর্দুকে মুসলমানদের ভাষা মনে করতেন। পাকিস্তান যেহেতু মুসলমানদের দেশ তাই উর্দুই হবে মুসলমানদের ভাষা-এই ছিল তার যুক্তি। তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অবদানের কথা বেমালুম এড়িয়ে গেলেন। আসলে তার বক্তব্য বাস্তবতার সঙ্গে কোনো মিল ছিল না।  

ধীরেন্দ্রনাথ দত্তও প্রধানমন্ত্রীর কথার প্রতিবাদ করলেন। তিনি বললেন, ‘শুধু উর্দুই মুসলমানদের ভাষা নয়। বরং বাংলা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের ভাষা। উর্দু কেবলমাত্র কর্তৃত্বের আসনে সমাসীন কয়েকজন লোকের প্রিয় ভাষা হতে পারে, কিন্তু এদেশে ৫৬% লোকের ভাষা বাংলা। উর্দু না জানার জন্য কাউকে অমুসলমান বলে চিহ্নিত করা ঠিক হবে না’। কিন্তু পাকিস্তানিরা ধীরেন্দ্রনাথের কথা শুনবে কেন? তারা তো শক্তির যুক্তিতে উর্দুকে চাপিয়ে দেবেই।

পাকিস্তানিদের কে বোঝাবে? প্রধানমন্ত্রীর পর এবং স্বয়ং গভর্নরও হুমকি ছাড়লেন বাংলার বিরুদ্ধে। জিন্নাহ সাহেব বললেন, “Let me make it very clear to you that the state language of Pakistan is going to be Urdu and no other language. Anyone who tries to mislead the people is really the enemy of the state. Without one state language no state can remain tied up solidly together and function.”

তিনি তার বক্তব্যের সমর্থনে আরো প্রলাপ বকলেন। লিয়াক আলী দিয়েছেন ধর্মের দোহাই আর জিন্নাহ দিলেন ঐক্যের দোহাই। তিনি বললেন, এ অঞ্চলে কেউ প্রকৃতপক্ষে বাঙালি, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, পাঠান নয়। আসলে সবাই মুসলমান। তাই মুসলমানের ভাষা উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা। রাষ্ট্রের ঐক্যের স্বার্থে তিনি পুরো পাকিস্তানের ৫৬% জনগণের ভাষাকে অস্বীকার করলেন।

আসলে স্বৈরাচারি ও অগণতান্ত্রিক ভাবধারা থেকেই এসব কথার উদ্ভব হয়। আমার কথার বিরুদ্ধে কথা বললেই যদি কেউ রাষ্ট্রের শত্রু হয়ে যায় তবে সেখানে আর যুক্তির জোর খাটেনা। গদির গরমে যা খুশি তাই বলা যায়।

কিন্তু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কায়েদে আযমকেও ছেড়ে দিয়ে কথা বলেননি। তিনি বলেন, “জাতির জনক কি বলতে চান উর্দু যারা চাইবেন না তারা দেশের দুশমন? তাহলে পূর্ব পাকিস্তান একটি ভাষাভিত্তিক দুশমনের দেশ? এ একটি বিচ্ছিন্নতাবাদ-এ বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্য দায়ী কে?” আসলে জাতির জনক হয়ে জাতির ৫৬% জনগণের ভাষা অস্বীকার করা এক অগণতান্ত্রিক চেতনারই নামান্তর।

জিন্নার কথামতো উর্দুকে মেলে নিলেই দেশ-দরদী আর বাংলার পক্ষে কথা বললেই দুশমন? এ কেমন কথা? সেদিন এভাবেই বাঙালিদের ভাষার জন্য বিচ্ছিন্নতাবাদী ও দেশের দুশমন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। আসলে কে দুশমন আর কে দরদী তা ইতিহাস থেকেই জানা যায়।

গণপরিষদের বাইরেও তারা নানাভাবে উর্দুর পক্ষে সাফাই গাইতে থাকলো। Pakistan Basic Principles Committee-ও একইভাবে উর্দুর পক্ষে সাফাই গাইতে লাগলো। এসব কমিটির কাজ ছিল সরকারি নীল নকশা বাস্তবায়নে সাহায্য করা। সেমতো প্রতিবেদন দাখিল করা।

এবার জিন্নার সমর্থনে এগিয়ে এলেন খাজা নাজিমুদ্দিন। তিনি বললেন, “ভাষা ষড়যন্ত্র বরদাস্ত করা হবে না। তাদের কে দমন করতে হবে”।

আব্দুল লতিফ সাহেব ফতোয়া দিয়ে বললেন, “সংক্ষেপে আমরা মতো হলো নিম্নশ্রেণীর মুসলমান জাতিগত যারা হিন্দুদের কাছাকাছি তাদের প্রাদেশিক শিক্ষার মাধ্যম বাংলা হওয়া উচিৎ কিন্তু উচ্চ ও মধ্যবিত্ত মুসলমানদের ভাষা হবে উর্দু। কোনো মুসলমানই সম্ভ্রান্ত মহলে সহধর্মীদের কাছে স্থান পাবেন না যদি তিনি উর্দু না জানেন”। কতটা অসংলগ্ন চিন্তাধারার অধিকারী হলে এমন বক্তব্য দেয়া যায় তা সহজেই বোধগম্য। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের সঙ্গে মিশতে হলেও উর্দু জানতে হবে। আর নিম্নবিত্তদের ভাষা বাংলা হতে পারে, কারণ তারা গরীব ও হিন্দু ঘেষা। তাদের এসব সাম্প্রদায়িক, বর্ণবাদী ও বৈষম্যমূলক বক্তব্যের জন্য বাঙালি আরো প্রতিবাদী হয়ে ওঠে।

পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী গণপরিষদের বাইরেও একইভাবে বাংলার বিরুদ্ধে প্রচার-প্রপাগান্ডা চালাতে শুরু করে। ১৯৪৭ সালের ২৭ নভেম্বর করাচীতে পাকিস্তানের প্রথম শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাবিদরা অংশগ্রহণ করেন। কেন্দ্রের শিক্ষামন্ত্রী তখন ফজলুর রহমান। সে শিক্ষা সম্মেলনে বেশকিছু অদ্ভুত দাবি তোলা হয়। সম্মেলনে নতুন রাষ্ট্রের জন্য নতুন এক শিক্ষা ব্যবস্থার দাবি উঠলো। সেখানে বলা হলো, পাকিস্তানে ইংরেজ আমলের শিক্ষা ব্যবস্থা আর চলবে না। তারা বললেন, যেহেতু পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র তাই এখানে বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার প্রভাব কমাতে হবে ও ইসলামি শিক্ষা বাড়াতে হবে। ইসলামি শিক্ষা বাড়াবে ভালো কথা, কিন্তু তাই বলে বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার প্রভাব কমাতে হবে কেন?

আসলে তারা ইসলামি শিক্ষার অন্তরালে উর্দুকে প্রাদেশিক শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে প্রচলন করতে চায়। এটি যতোটা না উর্দুর পক্ষে তার চেয়ে ঢেড় বেশি ছিল বাংলার বিপক্ষে একটি ষড়যন্ত্র। এর মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বোস্তরে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে উর্দুকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল।

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৭
এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।