কাঁটা চামচ আর ছুরি দিয়ে কই মাছের দো-পেঁয়াজা কিংবা ইলিশ ভাজি কীভাবে খাওয়া সম্ভব, সাদা ভাতের সঙ্গে আলু ভর্তা আর ডাল কখনও হাত না লাগিয়ে কাঁটা চামচ দিয়ে খেয়ে দেখেছেন! তারা সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করেছেন। সেদিন স্থানীয় পত্রিকার এক বন্ধু রিপোর্টার মুখ ফুটে বলেই ফেললেন, তোমাদের মজার বিরিয়ানি, জর্দা রাইস আবার কবে হবে? মনে মনে দ্রুত হিসাব কষলাম এবং একটা পরিকল্পনা বানিয়ে ফেললাম।
একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এই দিনটি বিশ্বময় সার্বজজনীন হওয়া উচিত। যেই ভাবা সেই কাজ। লম্বা একটা অতিথি তালিকা বানিয়ে ফেললাম। যথারীতি নিমন্ত্রণপত্রও পাঠিয়ে দিলাম।
এখানে এসে গরুর ফার্ম করার স্বপ্ন নিয়ে কাজ শেখার জন্য যে গোয়ালে একমাস ছিলাম, সেই ফার্মের মালিক ও তার ছেলে-মেয়ে, যে কবরস্থানের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য কিছুদিন কাজ করেছিলাম, তার ম্যানেজার, যে রেস্টুরেন্টে পাঁচদিন কাজ করেছিলাম তার মালিক থেকে শুরু করে চার্চের ফাদার, শহরের মেয়র, ল্যাংগুয়েজ স্কুলের শিক্ষক, অফিসের সহকর্মী, সুপারভাইজার, প্রতিবেশী, কাছে-দূরের কয়েকজন প্রবাসী বাংলাদেশি। সর্ব সাকুল্যে অতিথি সংখ্যা ৪৮।
আমার বাসার আয়তন মাশাল্লাহ, বড়ই আছে, কিন্তু এতোগুলো লোককে তো আর কলাপাতা, শালপাতায় খেতে দেওয়া যায় না। প্রচুর চেয়ার-টেবিল প্রয়োজন। ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। আমারও বেশ ভালোভাবে উপায় হয়ে গেলো। বাজার করা, মেনু সিলেকশন, ঘর গোছানো সবই প্রায় শেষ।
হঠাৎ মনে হলো, এতো মানুষ আসবে, যাদের অনেকেই আমার জন্মভূমি বাংলাদেশের নামটি পর্যন্ত জানেন না, এমনকি সারাজীবনে একবারও শোনেননি। গুগলিং করে ভারত আর বার্মার মাঝখান ছোট্ট লাল-সবুজের দেশটিকে খুঁজে দেখিয়ে দিতে হয়। তাদের এক পলকে বাংলাদেশটা দেখিয়ে দিলে কেমন হয়? আইলো খাইলো, তারপর চইলা গেলো- বিষয়টা একটু অসম্পূর্ণই মনে হলো। আবার যেমন ভাবা, তেমন কাজ। স্থানীয় কমিউনিটি অফিসের প্রজেক্টরটা ধার করে নিলাম। ট্যুরিজম নিয়ে অমিতাভ রেজার তৈরি করা ‘দ্য বিউটিফুল বাংলাদেশ’ ডাউনলোড করলাম, বাংলাদেশ নিয়ে আরেকটি ছোট ডকুমেন্টারি নামালাম। আর অবশ্যই আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি!
খুঁজতে খুঁজতে পেলাম এবারের মাতৃভাষা নিয়ে ইউনেস্কোর একটা ভিডিও চিত্র। মনটা সত্যিই আনন্দে ভরে গেলো। অতিথিদের সঙ্গে শেয়ার করার জন্য ভিডিও চিত্রটি দ্রুত ডাউনলোড করলাম। কিন্তু........
দুই.
ইউনেস্কোর উদ্যোগে একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন করা! এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার কারণ ছিলো, পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম ভাষাজন জাতির মায়ের ভাষা বাংলা। যদিও ভারতীয় বাঙালিদের তাদের মাতৃভাষার জন্য তেমন কোনো ক্ষয়-ক্ষতির শিকার হতে হয়নি। এককালের পূর্ববাংলা পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়ার অপচেষ্টার প্রতিবাদে সেদিন বাংলার রাজপথ উত্তাল হয়ে উঠেছিলো। রাজপথেই অকাতরে জীবন দিয়েছিলেন আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় ভাষা শহীদ সালাম, জব্বার, রফিক, বরকতসহ নাম না অনেক তাজা প্রাণ। ১৯৫২ সালের এই একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা শহীদদের রক্তঋণ কোনো কিছুর বিনিময়ে শোধ হওয়ার নয়। ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে শহরে-বন্দরে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, পাড়া-মহল্লায় গড়ে ওঠা শহীদ মিনারগুলো।
খুব ভোরে ছেলে-বুড়ো সবাই মিলে খালি পায়ে, বাংলা বর্ণমালাখচিত সাদা-কালো পাঞ্জাবি-শাড়িতে, মুখে চিরায়ত একুশের সেই গান- আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো.....গাইতে গাইতে প্রভাত ফেরির মিছিল শহীদ মিনার পানে। ফুলে ফুলে ঢেকে যায় শহীদ মিনারের বেদী। মাসজুড়ে চলে বইমেলা। ভাষা নিয়ে নানান আয়োজন-উদ্যোগ। পুরো ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে সর্বস্তরে বাংলা। মাতৃভাষা নিয়ে এমন আয়োজন, আবেগ-ভালোবাসা প্রদর্শনের এমন উদাহরণ বিশ্বে দ্বিতীয়টি নেই। তবুও আমাদের বাংলা উপেক্ষিত ভাষা হিসেবেই এখনও বিবেচিত হচ্ছে। সেই উপেক্ষা যদি ইউনেস্কো করে তখন শুধু অবাক হওয়া নয়, হতাশও হতে হয়।
তিন.
এবার আসি আসল কথায়, যে কারণে এই লেখা লিখতে বসা। সেই ভিডিও চিত্রের কাহিনী।
এ বছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের জন্য ইউনেস্কো যে ভিডিও চিত্র নির্মাণ করেছে তার শিরোনাম ‘What's your Mother Language’। এই ভিডিওতে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় প্রায় সব ভাষাতেই নিজের মাতৃভাষার পরিচয় দিয়েছে বিভিন্ন ভাষাভাষী নারী ও পুরুষ। ভিডিওটি একবার নয়, দুইবার নয়, তিন-তিনবার দেখলাম, আমার মায়ের মুখের মিষ্টি ভাষাটি কোথাও খুঁজে পেলাম না। নিজের অজান্তেই কখন যে চোখের কোণা বেয়ে দু'ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো! আমাদের এত্তো আবেগ কেন! অবহেলা, বঞ্চনা, উপেক্ষা এতোটুকুনও সহ্য হয় না। দুঃখজনক হলেও নির্মম সত্যি যে, এই ভিডিওটিতে আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলা স্থান পায়নি। অথচ ভিডিওটিতে ক্রোয়েশিয়ান, সিয়েরালিওনের ভাষাও স্থান পেয়েছে। যাদের সম্মানে এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা। পৃথিবীতে একমাত্র যে জাতি তাদের মায়ের ভাষার জন্য অকাতরে নিজেদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলো!
যে বাংলা ভাষার জন্য এমন বিসর্জন, আজ সেই বাংলা একটি দেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা এবং যে দিবসটিকে স্মরণ করে এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সূত্রপাত সেই বাংলা ইউনেস্কোর এই উদ্যোগে স্থান না পাওয়া সত্যিই দুঃখজনক এবং দুর্ভাগ্যজনকও বটে।
আমাদের সরকার, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশের ইউনেস্কো কি বিষয়টি সম্পর্কে জানে? আর জেনে থাকলে তারা এ বিষয়ে কি কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে ?
২০ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে এ লেখা লিখতে লিখতেই ঠিক করলাম, আমার ঘরোয়া অনুষ্ঠানে ইউনেস্কোর ওই ভিডিও চিত্রটি দেখাবো না। বুকের মধ্যে বিরাজ করবে চাপা অভিমান, তবুও আমি গর্বিত বাংলা মায়ের সন্তান হিসেবে, আমার মায়ের মুখের মিষ্টি-মধুর ভাষা বাংলা আমার অহংকার। যতো দূরেই যাই, যেখানেই থাকি, অহর্নিশ আমি বাংলাতেই বাস করি, বাংলায় গান গাই।
লেখক: mohona2020@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৭২৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৭
এসএনএস