ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

আমাদের জীবনে বই আসুক ফিরে ফিরে

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৭
আমাদের জীবনে বই আসুক ফিরে ফিরে আমাদের জীবনে বই আসুক ফিরে ফিরে/ছবি: বাংলানিউজ

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবই ম্লান হয়ে যায়। শাশ্বত রয়ে যায় কেবল বই। বইই জ্ঞান, বইই আনন্দ, বইই চিরন্তন। কৈশোরে পরিচয় সৈয়দ মুজতবা আলীর সঙ্গে। বই নিয়ে অনেক কথাই বলেছেন তিনি।

আমরা বই পড়ি আর  না পড়ি, মুজতবা আলীর সেই বাণীটি কিন্তু সবাই জানি, ‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত যৌবনা- যদি তেমন বই হয়’।  

তিনি চলে গেছেন সময়ের ওপারে।

কিন্তু আসলেই কি তিনি আমাদের মাঝে নেই? বাংলা সাহিত্যের পূর্ণতা কি মুজতবা আলীকে ছাড়া ভাবা যায়? তিনি কি তার উপন্যাস, ছোট গল্প, অনুবাদ, রম্য রচনা ও ভ্রমণ কাহিনীর মধ্য দিয়ে আজও কি ফিরে ফিরে আসেন না আমাদের জীবনে? 

কেমন বইয়ের কথা বলেছেন মুজতবা আলী? সাফ কথা, যার যেমন পছন্দ, তেমন বই। মূল কথা হলো, ‘বই’। অনন্ত যৌবনা এ বইয়ের বয়স কখনো কমে না। সেই 

মুজতবা আলীই আবার বলে গেছেন, ‘বই কিনে কেউ কখনো দেউলিয়া হয় না’। বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয়েছেন কি-না, জানি না। তবে আমরা যে বই না কিনে দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছি, তা পরিষ্কার।

এক সময় দেশের প্রায় প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় প্রতি বছরই বইমেলা হতো। স্কুল-কলেজের বড় ভাইয়েরা সেসব মেলার আয়োজন করতেন। তারা নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলতেন। সেসব সংগঠনের পক্ষ থেকে খেলাধুলার আয়োজন করা হতো, সাংস্কৃতিক আয়োজন করা হতো। এলাকার মুরুব্বিরা তা উপভোগ করতেন, আর্থিক সহায়তাও করতেন। কিছু না করতে পারলেও অন্তত দোয়া করতেন। কিন্তু এখন সে সব সংগঠন প্রায় নেই বললেই চলে। স্কুল-কলেজ থেকেও আজ  আর  কোনো বইমেলার আয়োজন করা হয় না। আমাদের মাঝে ‘বই? সেওতো বাড়িতে একটা আছে অবস্থা’ চলছে।  

আমাদের জীবনের বইয়ের উপস্থিতি কই? এক সময় পরিবারের মা-বাবা-ভাই-বোন সবাই বই পড়তেন। এখন তাদের জীবনে এতো সময় কই? ছেলে-মেয়েদের বই পড়িয়ে, হোম ওয়ার্ক করিয়ে হাতে যা একটু-আধটু সময় থাকে, সেখানে জায়গা করে নিয়েছে, স্টার জলসা-স্টার প্লাস।

দিন বদলায়, জীবন বদলায়, বদলায় সমাজ ও চিন্তা। কিন্তু গত তিন দশকে আমাদের জীবনে যে আমূল পরিবর্তন হয়েছে, তাতে বদলে গেছে আরও অনেক কিছুই। পরিবর্তনকে রোধ করা যায় না, নিয়ন্ত্রণও করা যায় না। কিন্তু সে পরিবর্তন যদি জাতির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যমূলে আঘাত করে তা মেনে নেওয়া কঠিন বৈকি।  

বই পড়া ছিল আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এদেশে মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত প্রতিটি পরিবারেই ছোট-বড় একটি বুকসেলফ ঘরের শোভা বর্ধন করতো। নজরুল-রবীন্দ্রনাথ-শরৎ ছিলেন না, এমন কোনো পরিবার পাওয়া যেতো না। বইয়ের আদান-প্রদান হতো। ক্লাসে পাঠ্য বইয়ের মাঝে লুকিয়ে ছেলে-মেয়েরা বই আনতো, বন্ধুকে দিতো। বাবা-মায়ের চোখের অন্তরালেই গড়ে উঠতো একেকজন বইপ্রেমিক পূর্ণাঙ্গ মানুষ। দৃষ্টির অন্তরালেই গড়ে উঠতো একেকজন সৃজনশীল লেখক, পাঠক ও সুনাগরিক।  

বাবা-মা যে বিষয়টি জানতেন না তাও নয়, তারা শুধু চাইতেন, ছেলে-মেয়েরা যেনো পাঠ্য বইয়ের ওপর গুরুত্ব দেয়। তাই অন্য বইগুলোকে একটু নিয়ন্ত্রণ করতেন মাত্র।  

বইয়ের সঙ্গে আমার যে আত্মিক সম্পর্ক, তা বড় দুই বোনের হাত ধরে। দু’জনই সাহিত্যের ছাত্রী। তাই জ্ঞান-বুদ্ধি হওয়ার আগেই আমার রবীন্দ্র-নজরুল শেষ। কিছুটা বড় হওয়ার পর বোঝার জন্য আবার নতুন করে পড়তে হয়েছে। বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গেও পরিচয় একইভাবে। হাতের নাগালেই পেয়ে  যাই বিশ্ব সাহিত্যের রথি-মহারথিদের অনুবাদ করা সব বই। দুই বোন সাহিত্যপ্রেমিক হওয়ায় ঘরের দেয়ালে শোভা পেতো কবি-সাহিত্যিকদের ছবি। মনে পড়ে, বৈঠকখানার দেয়ালে তিনজনের ছবি ছিল- মাইকেল, কায়কোবাদ আর জীবনানন্দ। এর পরের বোন ইতিহাসের ছাত্রী। কয়েকদিন পর দেখলাম, তাদের পাশে শোভা পেল আওরঙ্গজেবের ছবি। বড় দুই বোন কয়েকদিন রাগ করে অবশেষে আওরঙ্গজেবকেও মেনে নিলেন।  

আমাদের সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় টিভি সিরিয়াল ছিল ম্যাকগাইভার। ঘরে ঘরে তখন ম্যাকগাইভারের পোস্টার। আমিও একটা পোস্টার কিনে মাইকেলের পাশে লাগিয়ে দিলাম। এ নিয়ে পরিবারে তুলকালাম। বড়রা আমাকে মাইকেল বোঝালেন, আমি তাদেরকে ম্যাকগাইভার বোঝালাম।  

আমার মতো সবারই বইয়ের সঙ্গে, শিল্প-সাহিত্য ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় পরিবারের বড়দের হাত ধরে।  

এখন বড়রা তো নানা কাজে ব্যস্ত। পরিবারে বই আসবে কিভাবে? আইন করে, ওপর থেকে চাপিয়ে দিয়ে কোনো সুঅভ্যাস গড়ে ওঠে না। বই পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে পরিবার থেকেই। আমাদের সেই পারিবারিক সংস্কৃতি আজ আর নেই।
 
এক সময় বিয়ে-জন্মদিনসহ নানা আয়োজনে বই উপহার দেওয়ার কথা ভাবা হতো। এখন সে ভাবনা অলীক কল্পনামাত্র। পাড়া-মহল্লায় পত্রিকার স্টলগুলোতে সেবা প্রকাশনীর একটা কর্নার থাকতো। টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে বই কেনার অভ্যাস গড়ে ওঠার পেছনে রয়েছে সেবা প্রকাশনীর অবদান। সেই সঙ্গে আমরা পাই হুমায়ূন আহমেদ ও ইমদাদুল হক মিলনকে। হুমায়ূন-মিলন আর সেবা পড়েনি, এমন বন্ধু খুঁজে পাওয়া ভার।  

বই আলো। অন্ধকারেও বই আলোর পথ দেখায়। যুগে যুগে, কালে কালে বই আলোর পথ দেখিয়ে গেছে, দেখাবে আগামীতেও। সাহিত্য, ইতিহাস, সভ্যতা, দর্শন, সংস্কৃতি, রাজনীতি, ধর্ম, সমাজ ও বিজ্ঞানের সেকাল, একাল ও আগামীকালের কথা বইয়ের মাধ্যমেই আমরা জানতে পারি। বই থেকে যতো দূরে  সরে যাবো, অন্ধকার আমাদের ওপর ততোই জেঁকে বসবে।  

এ কারণেই ওমর খৈয়াম স্বর্গেও কেতাব নিয়ে যেতে চান! 

মঙ্গলবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) রাতে পর্দা নামছে অমর একুশে গ্রন্থমেলার। কিন্তু আমাদের জীবনে বইয়ের মেলা আর বই ফিরে ফিরে আসুক।  

বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৭
এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।