ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

টিক্কা বললেন, আমরা আগে গুলি চালাইনি

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২১৪ ঘণ্টা, মার্চ ১৯, ২০১৭
টিক্কা বললেন, আমরা আগে গুলি চালাইনি টিক্কা বললেন, আমরা আগে গুলি চালাইনি

জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। নিরস্ত্র বাঙালি সাময়িকভাবে পিছু হটতে থাকে। কিন্তু বীর বাঙালি যার কাছে যা আছে তাই নিয়ে ন্যায়যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাই একাত্তরের জুন-জুলাইয়ের দিকেই যুদ্ধ পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে।

বাঙালি রণাঙ্গনে ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে ওঠে। মূলত এপ্রিলে প্রবাসী সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকেই মুক্তিযুদ্ধ আরও বেগবান হয় এবং দেশের বাইরে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গড়ে উঠতে শুরু করে।

এ কাজে প্রবাসী সরকার ও মুক্তিযুদ্ধকালীন আমাদের বিদেশি বন্ধুদের ভূমিকা বিশেষভাবে স্মরণীয়।

মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকার সরকার আমাদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে সত্যি, কিন্তু সেদেশের জনগণ প্রথম থেকেই আমাদের পাশে ছিলেন। তারা সবসময়ই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে নৈতিক সমর্থন দিয়েছেন। সেদেশের সাধারণ মানুষ, শিল্পী, কবি ও সাংবাদিকরা  নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।

১৯৭১ সালের ১ আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আয়োজন করা হয়। জর্জ হ্যারিসন ও পণ্ডিত রবিশঙ্কর এ কনসার্টের আয়োজন করেন। বাংলাদেশের পক্ষে এরকম অসংখ্য মানবিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এ ধরনের ব্যতিক্রমী আয়োজনে স্বাধীনতার লড়াইয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণকারীরাও অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।

মু্ক্তিযুদ্ধের পক্ষে ব্যাপক বৈশ্বিক জনমত ও কূটনৈতিক সমর্থনের ফলে পাকিস্তানি শাসকচক্র ক্রমেই নৈতিকভাবে দুর্বল ও রণাঙ্গনে কোণঠাসা হতে থাকে। দিন যতোই এগোতে থাকে, এ প্রবণতা ততোই বাড়তে থাকে। ফলে অক্টোবর-নভেম্বর থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যে হানাদার বাহিনী বিভিন্ন জায়গায় পিছু হটতে থাকে।

ভারতের ভূখণ্ডে পাকিস্তানের সামরিক হামলার প্রেক্ষিতে ৬ ডিসেম্বর দিল্লি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ফলে মুক্তিযুদ্ধ চূড়ান্ত বিজয়ের দিকে ধাবিত হয়। রাশিয়ার সমর্থন আমাদের দিকে থাকলেও চীন ও আমেরিকা পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে ছিল। ফলে এ অঞ্চলে পরাশক্তিগুলো তাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখছিল।

আমেরিকা যুদ্ধে সরাসরি অংশ না নিলেও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার এবং ‘ওয়াশিংটন স্পেশাল একশন গ্রুপস’ বাংলাদেশ প্রশ্নে কী করা যায় তা নিয়ে ভাবনায় পড়ে গেলেন। পাকিস্তানকে সাহায্য করার জন্য তারা এখানে তৃতীয় দেশের মাধ্যমে অস্ত্র পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। সেইসঙ্গে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব উত্থাপন করে কিভাবে পাকিস্তানকে রক্ষা করা যায় তা নিয়ে আলোচনার ব্যবস্থা করলো আমেরিকা। পাশাপাশি তারা বাংলাদেশ থেকে মিত্রবাহিনীর সদস্যদের প্রত্যাহার করার জন্যও জোর চেষ্টা চালায়।

এদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ৫ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সংকটের রাজনৈতিক সমাধানে একটি প্রস্তাব রাখে।

পাকিস্তানিরা বাঙালির গেরিলা হামলার তোড়ে ভেসে যায়। ডিসেম্বরের প্রথম থেকেই বিভিন্ন অঞ্চল শত্রুমুক্ত হতে থাকে। ৭ ডিসেম্বর যশোর ও সিলেট শত্রুমুক্ত হয়। এদিকে মিত্র বাহিনীর অভিযানও অব্যাহত থাকে। ফলে মিত্রবাহিনী তাদের আত্মসমর্পণ করতে আহ্বান জানায়। কিন্তু পাকিস্তানিরা তাদের শেষ রক্ষার চেষ্টা হিসেবে বিদেশি প্রভুদের দ্বারস্ত হলো। ফলে আমেরিকা বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠানোর উদ্যোগ নেয়। এতে তারা কিছুটা উৎসাহ বোধ করে। ফলে আত্মসমর্পণ করতে টালবাহানা করতে থাকে। কিন্তু ভারত মহাসাগরে সোভিয়েত ইউনিয়নের ২০ নৌবহরের আগমন বার্তা শুনে সপ্তম নৌবহর পিছু হটে।

বিশ্ব গণমাধ্যম প্রথম থেকেই বাংলাদেশের পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছিল। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের সরকার ও গণমাধ্যম অনেক ক্ষেত্রেই বিপরীতমুখী অবস্থান গ্রহণ করে। সেদিনকার গণমাধ্যমের নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি ও বাঙালিদের প্রতি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্যই বিশ্বজনমত বাংলাদেশের প্রতি ঝুঁকে পড়ে।

যুদ্ধ শুরু হওয়ার তিন দিন পর অর্থাৎ ১৯৭১ সালে ২৯ মার্চ সিডনি মর্নিং হেরাল্ডের সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ‘প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ক্ষমতা আছে- ট্যাংক, গোলন্দাজ বাহিনী ও যুদ্ধবিমান দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের শহরগুলোতে সাময়িক বিজয় তিনি হয়তো দেখতে পারবেন। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে ঘাঁটি থেকে হাজার মাইল দূরে তার সেনাদল দিয়ে তিনি কেমন করে আশা করেন যে, গেরিলা যোদ্ধাদের পরাস্ত করবেন, যে যুদ্ধ তেতে উঠবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের শক্তিতে, যে যুদ্ধ চলতে থাকবে অনির্দিষ্টকাল, পূর্ব পাকিস্তানের দুর্গম গ্রাম্য প্রান্তরে? কেবল ইয়াহিয়া খানের শুভবুদ্ধির উদয় হলেই এই ট্র্যাজেডি দীর্ঘায়িত হওয়া রোধ করা যেতে পারে। কিন্তু মনে হচ্ছে তার (ইয়াহিয়ার) অঙ্গীকার সংঘর্ষের দিকেই। ’

মার্চের প্রথম দিকেই ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশ স্থগিত করেন। ফলে, শুধু বাঙালি নয়, বিশ্বের অপরাপর গণমাধ্যমও বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয়নি। তারা ইয়াহিয়া খানের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। যা সেসময়ের পত্র-পত্রিকায় উঠে আসে।

যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ৩০ মার্চ দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট ‘পাকিস্তান ট্র্যাজেডি’ শিরোনামে এক সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, ‘আলোচনা সফল হচ্ছে না ভেস্তে যাচ্ছে, এর কোনটা পাকিস্তানের ক্ষমতাসীনেরা অনুধাবন করছেন, তা স্পষ্ট নয়। তবে কোনো ধরনের আভাস না দিয়েই কিংবা সশস্ত্র উস্কানি ছাড়াই গত শুক্রবার রাতে মেশিনগান, রিকয়েললেস রাইফেল দিয়ে গুলি চালানো হয়েছে, ট্যাংক থেকে গোলা নিক্ষেপ করা হয়েছে মূলত নিরস্ত্র অথবা স্বল্প প্রতিরোধ সৃষ্টিকারী পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর। ---পাকিস্তান সরকার সংবাদপত্রের ওপর সেন্সরশিপ আরোপ করেছে এবং সব বিদেশি সংবাদদাতাদের নেওয়া নোট ও ছবির ফিল্ম বাজেয়াপ্ত করে তাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করেছে। ’

শুধু তাই নয়, টিক্কা খান ও রাও ফরমান আলীদের মিথ্যাচারের জুড়ি ছিল না সেসময়। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা ও অন্যান্য স্থানে নির্বিচারে গণহত্যার আদেশ টিক্কা খানই দিয়েছেন। যদিও এর সিদ্ধান্ত অনেক আগেই হয়ে গিয়েছিল। সে অনুযায়ী তড়িঘড়ি করে ইয়াহিয়া ঢাকা ছাড়েন। কিন্তু মিথ্যাবাদী টিক্কা খান বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে ছাত্র হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। কিন্তু আমরা ছাত্র কিংবা কোনো একক দলকে আক্রমণ করিনি। যখন আমাদের ওপর গুলি চালানো হয়েছে, আমরা পাল্টা গুলি চালিয়েছি। ’ কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, ২৫ মার্চ তারা যেভাবে অতর্কিতে নিরস্ত্র ছাত-জনতা তথা বাঙালির ওপর আক্রমণ চালিয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হলে যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, তা বর্বরতার সব মাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে।

টিক্কা বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় তো বন্ধ ছিল। সেখানে যারা ছিল তাদের থাকার কোনো কারণ ছিল না। যারা ভেতরে ছিল, তাদের বেরিয়ে আসতে বলেছি, তখন তারা গুলি চালায়। আমাদের তখন পাল্টা গুলি চালাতে হয়েছে। ’

এভাবে নরহত্যা ও গণহত্যা পরিচালনা করে তারা তা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করতো। গণমাধ্যমের কাছে তারা মিথ্যা খবর প্রচার করতো। বাঙালির বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালাতো। আর দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমের ওপর সেন্সরশিপ আরোপ করে সত্য প্রকাশে বাধা দিতো। প্রতিবেদন, ছবি ও ফিল্ম কেড়ে নিয়ে বিদেশি সাংবাদিকদের বাংলাদেশ ছাড়তে বাধ্য করতো।

আরও পড়ুন
** ‘টাইগার নিয়াজী’ হয়ে গেলেন ‘বাংলার শৃগাল’
** ইয়াহিয়াকে নিকোলাইয়ের হুমকি, সমর্থন চৌ এনলাইয়ের
** ভারতীয় সংসদে বাংলাদেশ নিয়ে উদ্বেগ​
** স্বাধীনতার রক্ত-কথন
** ২৫ মার্চ অধিবেশন! অন্তরালে অপারেশন সার্চ লাইট
** ‘পাকিস্তান রক্ষা’র জন্য হানাদারদের ভুট্টোর আগাম অভিনন্দন
** শক্তির ভারসাম্য খেলায় দৃষ্টি যখন বাংলাদেশে
** স্বাধীনতার পথের বন্ধুরা


বাংলাদেশ সময়: ০৮১০ ঘণ্টা, মার্চ ১৯, ২০১৭
এইচএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।