আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, এবছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৫৯ জন মানুষ বিচার বহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন। এপ্রিলে সেই সংখ্যাটি আরও বেড়ে গেছে।
আমরা মাথা ঘামাতে শুরু করলাম, রমেল চাকমাকে নিয়ে। রমেল চাকমাকে নিয়ে কবিতা রচিত হলো, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদের ঝড় উঠলো, তার হত্যার প্রতিবাদে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ঢাকায় মানববন্ধন করল। খুবই প্রশংসিত উদ্যোগ এগুলো। কিন্তু কই, বিচার বহির্ভূত হত্যার শিকার ওই ৫৯ জন মানুষের পাশে তো কেউ দাঁড়ায়নি। কাজেই রমেল হত্যার দায় কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একার নয়। আমাদেরও দায় রয়েছে। ওই ৫৯ জন মানুষ বিচার বহির্ভূত হত্যার শিকার হলো, আমরা তার প্রতিবাদ করিনি বলেই কিন্তু রমেল হত্যার বিষয়টি সহজ হয়েছে।
খুব সম্ভবত, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামই বোধ হয় একমাত্র জায়গা যেখানে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে কেউ নির্যাতিত হলে মানুষ সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ করে। দেশের আর কোথাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে এতটা সংঘবদ্ধ অবস্থান দেখি না আমি। তাদের সাথে যোগ দেয় সারাদেশের সুশীল সমাজ। কিন্তু কী অদ্ভূত, যে কবি রমেলকে নিয়ে কবিতা লিখলেন, যে ছাত্র সংগঠনগুলো রমেল হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় মানববন্ধন করল, তারা এই ৫৯ টি বিচার বহির্ভূত হত্যায় নিরব থেকে গিয়েছিল!
গণমাধ্যমে দেখেছি, রমেল হত্যার দায় সেনাবাহিনী এবং পুলিশ পরস্পর পরস্পরের ওপর চাপানোর চেষ্টা করেছে। অবশ্য পাহাড়িরা সরাসরি সেনাবাহিনীর ওপর এই দায় চাপিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এ নিয়ে প্রচুর লেখা পড়েছি আমি। অনেকে বলছেন, রমেল হত্যার সাথে সেনাবাহিনীর নাম এসেছে বলেই হয়তো এত বেশি সোচ্চার সেখানকার মানুষ। তা যদি সত্য হয়, তবে অন্য বাহিনীগুলোর হাতে যারা মারা যাচ্ছে তাদের বিচার পাওয়ার কোনো অধিকার নেই? সেগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়? এজন্যই কি আমরা এই ৫৯টি বিচার বহির্ভূত হত্যার কোনো প্রতিবাদ জানাইনি? এজন্যই কি ঢাকার ছাত্র সংগঠনগুলো এতদিন নীরব ছিল? এজন্যই কি এতদিন কবি কোনো প্রতিবাদী কবিতা লেখেনি?
পাহাড়িদের এই প্রতিবাদ নিয়েও রয়েছে নানা ধরনের সমালোচনা। কেউ কেউ বলছে, ওই এলাকায় আরও অনেক খুন-খারাপি, অপহরণ, ধর্ষণ হয়, তখন তারা মুখ খোলে না। কেউ কেউ বলছে, পাহাড়িদের এই প্রতিবাদের সাথে রাজনৈতিক কারণ রয়েছে। আমার নিজের কাছেও বিষয়টি একটু অন্য রকম মনে হয়েছে। কেননা, রমেল হত্যার কয়েকদিন আগেই সেই নানিয়ারচর উপজেলার ঘিলাছড়ি এলাকা থেকে বাঙালি মোটর সাইকেল চালক ছাদেকুল ইসলামের গর্তে চাপা দেয়া মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। পাহাড়ের একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, কিন্তু পাহাড়িরা একটা টু শব্দও করেনি এই হত্যা নিয়ে।
এমনকি, দুদিন আগেই সংবাদপত্রে পড়লাম, সামান্য একটা বিয়েকে কেন্দ্র করে চট্টগামের ফটিকছড়িতে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর ৭৮ জনকে অপহরণ করা হয়েছে, অথচ এ নিয়েও পাহাড়িদের মধ্যে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া নেই! তার মানে, সব ধরণের হত্যা বা অপরাধের বিরুদ্ধে তারা সমানভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায় না। তাদের প্রতিক্রিয়া দেখানোর জন্য বিশেষ কোনো কারণ লাগে।
তা সে যে কারনেই হোক, রমেল চাকমার হত্যার বিচার চাওয়াতে কোনো দোষ নেই। আমিও চাই বিচার বহির্ভূত হত্যা বন্ধ হোক। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাজই হলো সুবিচার করা, সেখানে বিনা বিচারে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতেই একজন মানুষ মারা যাবে, তা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না।
পাহাড়িরা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলে, তারা সহ্য করে না। সারা বাংলাদেশে তার প্রতিবাদ ছড়িয়ে দেয় তারা। ওরা দেখিয়ে দিয়েছে, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে কীভাবে দাঁড়াতে হয়। আর আমরা, কিছু ঘটনার প্রতিবাদ করি, কিছু ঘটনার বেলায় মুখ বন্ধ করে বসে থাকি। আমরা অপেক্ষা করি, কখন সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা হাইপ তৈরি হবে, তারপর আমরা প্রতিবাদ করি। আসুন আমরা ওদের কাছে থেকে শিক্ষা নেই। সব ধরনের বিচার বহির্ভূত হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলি।
রোকেয়া লিটা, লেখক-সাংবাদিক, rokeya.lita@hotmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৯, ২০১৭