তিনি ১৯২৪ সালের ১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া উপজেলার নাসিরাবাদ গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর বাবা আলী আহমদ ছিলেন অবিভক্ত বাংলার এবং পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাবস্থাপক পরিষদের সদস্য।
এই বরেণ্য শিক্ষাবিদ ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক উত্তীর্ণ হন এবং একই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেন।
অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ তাঁর কর্মজীবনে শিল্প-সংস্কৃতি, শিক্ষা-সাহিত্য সকল ক্ষেত্রে অবদান রেখে গেছেন। সমসাময়িক বিভিন্ন ব্যক্তির সাক্ষাতকারে এ তথ্য উপস্থাপিত হয়েছে। বর্তমানে তাঁর যে সব ছাত্র-ছাত্রী জীবিত আছেন তাঁদের স্মৃতিচারণে খান সারওয়ার মুরশিদের অজানা অনেক গৌরবান্বিত তথ্য উঠে এসেছে। ২০০১ সালে প্রকাশিত ‘কালের কথা’ গ্রন্থটি খান সারওয়ার মুরশিদ এর একটি অনন্য দলিল।
নিউ ভ্যালিউজ পত্রিকাটি প্রকাশিতহয় ১৯৪৯ সালে, পাকিস্তানোত্তর নানা জিজ্ঞাসা এবং সাংস্কৃতিক শূন্যতার পটভূমিতে। পত্রিকাটি ধর্মীয় রাজনীতির সংকীর্ণতা, রাষ্ট্রীয় আচরণে সামন্ত ও স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা, অহেতুক রাষ্ট্রপূজা, এ সবের রিরুদ্ধে তরুণ বুদ্ধীজীবীদের মনে যে প্রতিবাদ সৃষ্টি হচ্ছিল সে সময়ে তাঁর এ পত্রিকার পেছনে সক্রিয় ভূমিকা ছিল। পত্রিকাটির আরো একটি ভাবনা ছিল নতুন রাষ্ট্রে হিন্দু-মুসলিমের মিলিত জাতীয়তার বিকাশ।
দূরদৃষ্টি সম্পন্ন একজন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি খান সারওয়ার মুরশিদ বাংলাদেশের বহুমাত্রিক ক্ষেত্রে কাজ করে গেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ‘সংস্কৃতি সংসদের’ প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলের লেখক সংঘের সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন।
১৯৫২ সালে বাংলাভাষা-আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তৎকালীন পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠী ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের জন্মশতবার্ষিকী পালনে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। তিনি পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর প্রবল বাধা পেরিয়ে বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদ, ড: গোবিন্দ চন্দ্র দেব, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীসহ রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালন করেন। খান সারওয়ার মুরশিদ রবীন্দ্র জন্মশতবার্র্ষিকী কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। রবীন্দ্র জন্মশতবার্র্ষিকী পালনের পর বনভোজনের আয়োজন করা হয়, আর সেখানেই আজকের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান ছায়ানটের সৃষ্টি।
অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান রেখেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফার নীতি নির্র্ধারক ও পরিকল্পনাকারীদের অন্যতম ছিলেন তিনি। তৎকালীন মুজিবনগর সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের উপদেষ্টা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর পরিবারের সবাই বিশেষ করে তাঁর স্ত্রী নূরজাহান মুরশিদ, দুই মেয়ে-ছেলে সকলেই জড়িত ছিলেন।
সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশ গঠনে তিনি কাজ শুরু করেন। ১৯৭২-৭৪ সাল পর্যন্ত খান সারওয়ার মুরশিদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উপাচার্য থাকাকালে ‘ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ’গঠন করেন। তিনি ফরাসি বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী আঁদ্রে মালরোকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সমর্থন জানানোর সম্মানার্থে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানান এবং সম্মানজনক ডিলিট ডিগ্রি প্রদান করেন।
১৯৭৫-১৯৮৩ সাল পর্যন্ত খান সারওয়ার মুরশিদ পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি কমনওয়েলথ এর সহকারী মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮৩ সালে দেশে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৮৪ সালে অবসর গ্রহণ করেও তিনি সংখ্যাতিরিক্ত শিক্ষক হিসেবে ২০০৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সে সময় তিনি সুশীল সমাজকে নিয়ে নাগরিক ঐক্য গড়ে তোলেন। ২০০১-২০০৪ সাল পর্যন্ত তিনি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য পুরুস্কার পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে শিক্ষা ও গবেষণায় অসামান্য অবদানের জন্য তাঁকে আজীবন সম্মানণা প্রদান করা হয়। ২০০৬ সালে জাহানারা ইমাম স্মৃতিপদক, ২০০৮ সালে কন্ঠশীলন ও ২০১১ সালে তিনি বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার পান।
এই বরেণ্য শিক্ষাবিদ ২০১২ সালের ৮ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য নাগরিক স্মরণসভায় বিশিষ্ট্য ব্যক্তিরা অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদের কর্মজীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম বলেন, সারওয়ার মুরশিদ এ সমাজটাকে বদলাতে চাইতেন। তিনি ছিলেন সব মিলিয়ে একজন বুদ্ধিজীবী- যিনি সৃজনশীল কাজে নিপুনতার বিষয়ে ছিলেন আপোষহীন। তিনি আরো বলেন, খান সারওয়ার মুরশিদ গভীরভাবে চিন্তা করতে পারতেন।
অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ সম্পর্কে গণফোরাম এর প্রতিষ্ঠাতা ড. কামাল হোসেন বলেন, তিনি ছিলেন আজীবন সংগ্রামী। স্বাধীনতাত্তোর ও পরে দেশের রাজনীতি ও শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। মূল্যবোধের ভিত্তিতে সমাজ পরিবর্তনের কাজ করেছেন খান সারওয়ার মুরশিদ। দেশের সব ধরনের সংগ্রামে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকলেও তিনি সেটা প্রকাশ করতেন না।
এই মহান শিক্ষাবিদ সংগ্রামী মানুষটি এ দেশের কথা ভেবেছেন, মানুষের কথা ভেবেছেন, বিনিময়ে তিনি কিছুই আশা করেননি। আগামী প্রজন্মের কাছে অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ একজন আদর্শ শিক্ষক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী নবজাগরণের মূর্ততার প্রতীক। এই বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও সংগ্রামী চেতনার বাহককে জাতীয়ভাবে আজ পর্যন্ত কোন সম্মান জানানো হয়নি। এই বরেণ্য শিক্ষাবিদ এর ৯৩তম জন্মবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
মামুন আব্দুল্লাহ: উন্নয়নকর্মী
বাংলাদেশ সময়: ১৪০০ ঘণ্টা, জুন ২৯, ২০১৭
জেডএম/