ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

চট্টগ্রামের সাংবাদিকতার উজ্জ্বল মুখ মর্তুজা ভাই

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫৬ ঘণ্টা, আগস্ট ২৯, ২০১৭
চট্টগ্রামের সাংবাদিকতার উজ্জ্বল মুখ মর্তুজা ভাই

চট্টগ্রামের সাংবাদিকতার প্রবীণ ব্যক্তিত্ব সৈয়দ মর্তুজা আলীর মৃত্যু সংবাদ এলো সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে। মঙ্গলবার (২৯ আগস্ট) সকালে অবসর জীবন-যাপন কালে সেখানে তার মৃত্যু হয়।  দুপুরের দিকে সাংবাদিক ও গল্পকার মুস্তফা নঈম মৃত্যু সংবাদটি জানালে বহু স্মৃতি এসে ভিড় করে।

সাংবাদিকতা থেকে অধুনা দূরে থাকলেও আশি এবং নব্বই দশকে সৈয়দ মর্তুজা আলী ছিলেন চট্টগ্রামের সাংবাদিকতার এক উজ্জ্বল পুরুষ। বৃহত্তর ফরিদপুরের এই সজ্জন ও বন্ধু বৎসল মানুষটি তার পেশাজীবনের পুরোটাই কাটিয়েছেন চট্টগ্রামে।

তৎকালের প্রধান ইংরেজি দৈনিক অবজারভারের তিনি ছিলেন দীর্ঘকালীন ব্যুরো প্রধান। কাজির দেউড়িস্থ ইয়াসমিন ম্যানসনে পুরনো বিমান অফিসের পাশে তার দফতরে আমাদের বহু দিন কেটেছে উষ্ণ আড্ডা ও আলোচনায়। তরুণ লেখক-সাংবাদিকদের প্রতি ছিল তার উদার মনোভাব। আর ছিল পেশাগত বিশুদ্ধতার দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী ব্যক্তিত্ব।

কলেজ শিক্ষক স্ত্রী আর পেশাজীবনই ছিল সৈয়দ মর্তুজা আলীর সব কিছু। পেশার বাইরে তিনি অন্য কোনও বিষয়ে সংশ্লিষ্ট থাকেন নি। কাজের প্রতি নিবেদন তাকে একদা প্রসিদ্ধ ও আন্তর্জাতিক সাপ্তাহিক ‘নিউজউহক’-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছিল। পাশাপাশি নিবিড় সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতায় পার্বত্য চট্টগ্রামের সংঘাত ও সমস্যা নিয়ে তিনি রচনা করেছিলেন চমৎকার একটি গবেষণাধর্মী গ্রন্থ, যা একটি মূল্যবান দলিল স্বরূপ।

সাংবাদিক সৈয়দ মর্তুজা আলীর আরেকটি বিশেষ পরিচয় অনেকেরই অজানা। তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের আদি শিক্ষকদের একজন। নতুন বিভাগটি স্থাপিত হলে সেখানে অভিজ্ঞ শিক্ষকের স্বল্পতা দেখা দেয়। অধ্যাপক হায়াত হোসেন ও অধ্যাপক মনিরুজ্জামান বিভাগটিকে কাঠামো দেওয়ার সময় চট্টগ্রামের অভিজ্ঞ ও পেশাদার সাংবাদিকদের ক্লাস নেওয়ার আমন্ত্রণ জানান। বিভাগের পূর্ণ বিকাশের পূর্ব-পর্যন্ত তিনি আরো অনেকের সঙ্গে ক্লাস নেওয়াসহ নানাবিধ একাডেমিক কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রভূত সহযোগিতা করেন। তার সেই অবদান যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ভিত্তি স্থাপনকারী দিনগুলোর স্মৃতির পাতায় অম্লান হয়ে রয়েছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সৈয়দ মর্তুজা আলীর ছিল গভীর সম্পর্ক। তার আত্মীয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রফেসর ড. শামসুল হক নানা কাজে চট্টগ্রাম এলে তার বাসাতেই থাকতেন। সে সুবাদে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের সঙ্গে তার মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ও বলিষ্ঠ শিক্ষক প্রফেসর ড. আর.আই. চৌধুরীর তিনি ছিলেন স্নেহধন্য।

প্রফেসর ড. আর.আই. চৌধুরী পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হলে সৈয়দ মর্তুজা আলী সাংবাদিকতা বিভাগ খোলাসহ নানা বিষয়ে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করেন। যে কোনও ইতিবাচক ও কল্যাণকর কাজের পেছনে তার ছিল গভীর মমতা ও সহযোগিতার মানসিকতা। যে কারণে পেশা ও শিক্ষা ক্ষেত্রে সকলের প্রিয়জন ছিলেন তিনি। ছিলেন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মানুষ।

নব্বই দশকের শেষ দিকে সৈয়দ মর্তুজা আলী ক্রমে ক্রমে সাংবাদিকতা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিলেন। এর কারণ যত না ছিল বয়সের চাপ, তারচেয়ে বেশি ছিল পেশাগত পরিবেশের কুপ্রভাব। অবজারভার তখন মালিকানার দ্বন্দ্বে আক্রান্ত ও ক্ষয়িষ্ণু। নানা ধরনের পত্র-পত্রিকা বের হয়ে শত শত সাংবাদিকের মাধ্যমে মহৎ পেশার যেমন বিকাশ হচ্ছিল, তেমনি নানা ক্ষয় আর দুর্নামও হচ্ছিল। আলাপে-আলোচনায় সব কথা স্পষ্ট করে না বললেও এটা বোঝা যেত যে, পরিবর্তিত পরিস্থিতির অনেক কিছুই তিনি মেনে নিতে পারছেন না; অনেক বিষয়ের সঙ্গেও তার খাপ খাচ্ছিল না। ফলস্বরূপ, তিনিই বরং ধীরে ধীরে নিজেকে অবসরের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন। এমনই পরিস্থিতিতে একবার ইংল্যান্ড থেকে আসার সময় প্লেনে ওঠার আগে বা পরে স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। তার শারীরিক অবস্থাটিও তখন বেশ নাজুক হয়ে পড়ে।

আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার সময় লক্ষ্য করি, তিনি কথা বলছেন জড়িয়ে। হাত কাঁপছে। একদার তীব্র প্রাণাবেগ সম্পন্ন মানুষটি রোগ ও বয়সের চাপে আগের মতো প্রাণোচ্ছল নেই। অনেকটাই ম্রিয়মান হয়ে পড়েছিলেন। চট্টগ্রামের নানা অনুষ্ঠান ও উৎসবেও তাকে আর সরব ও সব সময় দেখা যাচ্ছিল না।

শুধু পেশাজীবন থেকেই নয়, তিনি যেন প্রিয় কর্মক্ষেত্র থেকেও নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছিলেন। আত্মীয়-পরিজনের কাছে ঢাকা বা বিশ্বের অন্যান্য স্থানেই সময় কাটাচ্ছিলেন। সবার অগোচরেই চট্টগ্রাম থেকে একজন উজ্জ্বল সাংবাদিকের চলে যাওয়ার ঘটনাটি ঘটে যায়।

মৃত্যু তার সঙ্গে সকলের চির বিচ্ছেদ রচনা করলো। তথাপি চট্টগ্রামের সাংবাদিকতার ইতিহাস ও স্মৃতিতে তিনি উজ্জ্বল হয়ে বিরাজ করবেন। তার ছাত্র, ভক্ত, অনুজ সহকর্মীদের মাঝে তিনি রয়ে যাবেন।

এক জীবনের কর্ম ও ব্যক্তিত্বের দ্যুতিতে তিনি উজ্জ্বল হয়ে ছিলেন ভালোবাসার শহর চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে, বিশেষত সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সৈয়দ মর্তুজা আলী যে অবদান রেখে গেছেন, মৃত্যুতেই তা নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার নয়। অম্লান হয়ে তিনি রয়ে যাবেন চট্টগ্রামের ইতিহাসের পাতায় ও মানুষের অন্তরে।

ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি-গল্পকার-গবেষক। অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।  
 
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫০ ঘণ্টা, আগস্ট ২৯, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।