আমাদের ঢাকা, চট্টগ্রামের বাসা ও নিজ বাড়ি (কাগতিয়া) সবখানে শূন্যতা বিরাজ করছে। এই শূন্যতা কখনো পূরণ হবে না।
আমার এই ছোট্ট জীবনে অনেক জ্ঞানী-গুণীর সঙ্গে মেশার সুযোগ হয়েছে। আর বাবার মত প্রখর জ্ঞানী ও নিখাদ ভদ্রলোক খুব কম দেখেছি। আমার বাবা বলে বলছি না, যারা বাবার সঙ্গে একবার মিশেছেন, তাদের মন বাবা জয় করে নিয়েছেন। বাবা সবসময় গরিব, দুঃখী ও নির্যাতিত মানুষের কথা বলতেন এবং গোপনে তাদের সহায়তা করতেন। কোনোদিন তিনি প্রচারে বিশ্বাসী ছিলেন না। সত্য কথা বলতেন স্পষ্টভাবে। সমালোচনা করতেন সামনে, কোনো কিছুকে ভয় করতেন না। এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানে বাবার অবদানের কথা সবাই জানেন।
তিনি গর্ববোধ করে বলতেন, ‘আমি শিক্ষক-পিতার সন্তান। আমি মাথা উঁচু করে কথা বলব। ’ আমাদের সবসময় কোনও কিছুতে অতিরিক্ত বা লোক দেখানো কাজ করতে নিষেধ করতেন। বলতেন মধ্যপন্থা অনুসরণ করো। জীবনে কষ্ট পাবে না। সবকিছুতে তার উৎসাহ ছিল অনেক। বিশ্বকাপ ফুটবল, ক্রিকেট, রেসলিং রাত জেগে তিনি দেখতেন।
বিশ্বকাপ ফুটবলে তিনি আর্জেন্টিনা, ক্রিকেটে বাংলাদেশের পর ভারত, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, উয়েফা চ্যাম্পিয়ন লিগে বার্সেলোনার একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে গুনগুন করতেন। খুব পছন্দ ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে তার ছিল গভীর জ্ঞান। উপমহাদেশের ক্ষমতার পট পরিবর্তনের ইতিহাস আমার বাবার কাছ থেকেই শুনেছি। তিনি নিখুঁত ও সুন্দরভাবে বলতেন। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। তিনি বিভিন্ন মনীষীর জীবনী নিয়ে বলতেন। তার স্মরণশক্তি ছিল প্রখর।
আমাদের গ্রামের পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনদের কার কয়টি সন্তান, তারা কে কি করে, কার বিয়ে কোথায় হয়েছে, সব ছিল তার মুখস্থ। আমার খুব আশ্চর্য লাগে কিভাবে তিনি এতকিছু মনে রাখতেন! বাবা ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ সমর্থক।
রাউজান কলেজ, সরকারি সিটি কলেজ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় স্বাধীনতার বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছেন। মুক্তিযুদ্ধের পর রাজনৈতিকভাবে বাবার তেমন মূল্যায়ন হয়নি। এই নিয়ে তার মনে চাপা ক্ষোভ ছিল। তার পোশাক-আশাক, খাওয়া-দাওয়া সব কিছু ছিল রুচিসম্মত।
সাধারণ মানুষের কথা বেশি করে ভাবতেন। আমাদের সঙ্গে আলাপে বলতেন, আমাদের বাড়ি বা পাড়ার ওই লোক অসুখে কষ্ট পাচ্ছে, ওই মহিলাটি বিধবা, ওই লোকটা বৃদ্ধ, তাকে দেখার কেউ নেই। এদের বেশি বেশি করে সাহায্য করতে হবে। তিনি খোঁজখবর নিয়ে গোপনে সাহায্য পাঠাতেন। তার বাঁচার খুব ইচ্ছা ছিল। মৃত্যুর ৩০ মিনিট আগেও বাঁচার আকুতি জানিয়েছেন। কিন্তু বাঁচতে পারলেন না। এটাই নিয়তি ছিল।
আমার বাবা এ কে জাফর খান ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার কাগতিয়া গ্রামে এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সিরাজুল হক ছিলেন একজন স্বনামধন্য শিক্ষক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। তার মা আমেনা খাতুন ছিলেন গৃহিনী। শৈশব কেটেছে কাগতিয়া গ্রামে। বিনাজুরী নবীন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, রাউজান কলেজ থেকে এইচএসসি এবং সরকারি সিটি কলেজ থেকে বিকম পাস করেন ১৯৭২ সালে। পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনে সহকারী হিসাবরক্ষক হিসেবে যোগ দেন।
চাকরি জীবনে তিনি সৎ, দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটিসহ বিভিন্ন স্থানে চাকরি জীবনের সময় পার করেন। তিনি সর্বশেষ ২০০৮ সালে রাঙ্গামাটিতে কর্মরত থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণের পর থেকে তিনি এলাকার মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল ও সামাজিক উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে নিজেকে সম্পৃক্ত করে নেন। স্বাধীনতার উত্তাল আন্দোলনের সময় তাতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন। তিনি একজন সদালাপী ও অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি হিসেবে সমাজে পরিচিতি লাভ করেন।
২০১৬ সালে বিনাজুরী নবীন উচ্চ বিদ্যালয়ের গভর্নিং বডির সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি গত ৫ অক্টোবর ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মরহুম এ কে জাফর খানকে রাউজানের নিজ বাড়ি মাতব্বর জামে মসজিদ কবরস্থানে দাফন করা হয়।
# লেখক: প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী
বাংলাদেশ সময়:১৯৪০ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৮, ২০১৭
জেএম