হ্যামিলনের গীর্জায় আঁকা ছবি থেকে মানুষ প্রথম গল্পটি জানতে পারে। ৭০০ বছর আগে হ্যামিলনের মানুষ ইঁদুরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল।
এমন সময় পাহাড় থেকে নেমে এলো এক রহস্যময় বাঁশিওয়ালা। বাঁশি বাজাতে বাজাতে মেয়রের দরবারে এসে হাজির। সেখানে সব সভাসদ হাজির। বাঁশিওয়ালা দাবি করলেন, “আমি, হ্যাঁ, আমিই পারবো এ শহরকে ইঁদুরের অত্যাচার থেকে বাঁচাতে”। মেয়রের গলায় তাচ্ছিল্যের সুর- “তুমি বাপু বাঁশি বাজাও, তাই করো, আমরা এমনিতেই পেরেশানিতে আছি, তুমি আর এর মধ্যে এসো না”। বাঁশিওয়ালা আবারও সেই একই কথা বললো। শেষে মেয়রও বললো, “ঠিক আছে, দেখো কী করতে পারো, দেখাও তোমার যাদু। ” বাঁশিওয়ালা বললো, ঠিক আছে, কিন্তু, আমার ইনাম যেন পুরোপুরি পাই। কথার যেনো কোনো হের ফের না হয়। ” মেয়র বললো, “ঠিক আছে, আগে দেখাওতো তোমার যাদু। ইঁদুর মুক্ত হলে তুমি পুরো ইনামই পাবে। ”
পাকা কথা শেষে, বাঁশিওয়ালা মেয়রের দফতর থেকেই বাঁশি বাজানো শুরু করলো। কিছুক্ষণ পরেই অফিসের ইঁদুরদলও বাঁশিওয়ালার পিছু পিছু ছুটলো। সবাই তো অবাক। বাঁশিওয়ালা বাঁশি বাজাতে বাজাতে শহরের সব বাড়ি, মহল্লার অলি-গলি, অফিস-আস্তাবল ঘুরে এলো। শহরের লাখ লাখ ইঁদুর তখন তার পিছুপিছু ছুটছে। শেষে সব ইঁদুর যখন ঘর আর গর্ত থেকে বেরিয়ে এসেছে তখন বাঁশিওয়ালা তার বাঁশিতে আরো তীব্র যাদুকরী ও রহস্যময় সুর তুলে শহরের সব ইঁদুর নিয়ে ধীরে ধীরে দূর পাহাড়ে হারিয়ে গেলো। হ্যামিলন তখন ইঁদুরমুক্ত। ঘরে ঘরে সবাই যখন ইঁদুরমুক্তির আনন্দ উদযাপনে মত্ত, তখন পাহাড় থেকে নেমে এলো সেই বাঁশিওয়ালা। মেয়রের কাছে এসে বললো, “আমার পুরস্কারটি দিয়ে দিন আমি চলে যাই”। মেয়র অল্প কয়েকটি মুদ্রা দিয়ে বললো, এগুলো নিয়ে সরে পরো, নইলে বিপদ আছে”। বাঁশিওয়ালা বললো, “যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তার পুরোটাই দিতে হবে। ” কিন্তু মেয়র সে কথা মানলো না। প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে বললো, কি এমন কম্ম তুমি করেছো বাপু যে তোমাকে এতো মুদ্রা দেবো? সামান্য কয়েকটি ইঁদুর সরিয়ে তুমি এতো মুদ্রা চাইছো, এ তোমার কেমন আবদার? যাও যাও...”। এই বলে তাকে তাড়িয়ে দিলেন।
বাঁশিওয়ালা সেখান থেকে বেরিয়ে এলো। এবার তিনি বাঁশিতে নতুন এক সুর তুললেন। তার বাঁশির যাদুতে সেই সুর শুনে শহরের সব শিশু ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সবাই বাঁশিওয়ালার পিছু নিলো। এমনকি ছোট্ট শিশুরা হামাগুড়ি দিয়ে তার পিছু নিলো। এবার বাঁশিওয়ালা শহরের সব শিশুকে নিয়ে শহরের সেই একই পাহাড়ের দিকে ছুটে চললেন। ধীরে ধীরে তিনি শিশুদের নিয়ে হারিয়ে গেলেন পাহারের মাঝে।
কিছুক্ষণ পর বাবা-মার খেয়াল হলো। বাচ্চাদের খোঁজে নেমে পড়লেন। কিন্তু তাদের আর খুঁজে পাওয়া গেলো না। বাঁশিওয়ালার পিছু নেওয়া দুইটি শিশু পেছনে পড়ে যায়। তারা পাহাড়ের কাছাকাছি এসে বাঁশিওলায়াকে আর দেখতে পায়নি। এ দুই প্রত্যক্ষদর্শীর কাছেই শহরের সবাই জানতে পারে শিশুদের হারিয়ে যাওয়ার কাহিনী। এবার শহরে শোকের ছায়া। ইঁদুর মুক্ত হওয়ার সব আনন্দ সন্তান হারানোর বেদনার কাছে ম্লান হয়ে গেলো।
কিন্তু পরক্ষণেই তারা তাদের ভুল বুঝতে পারলো। তারা বাঁশিওলায়াকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করার ফলেই এই পরিণতি।
এটি গল্প নয়। সত্যি ঘটনা। হ্যামিলন শহরে এই কাহিনী নির্ভর নাটক মঞ্চায়নের মাধ্যমে প্রতি রোববার ঘটনাটি স্মরণ করা হয়। এখনো আছে সেই পাহাড়। আছে আজকের শিশুরা। কিন্তু সেদিনের সেই মেয়র নেই, বাঁশিওয়ালা, শিশু, এমনকি ইঁদুরও নেই।
আমাদের ব্যক্তি, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে হ্যামিলনের ওই ঘটনার প্রাসঙ্গিকতা ব্যাপক।
২।
হ্যামিলনের মতো অতো পুরনো শহর নয় ঢাকা। এর বয়স ৪০০ বছরের কিছু বেশি। কিন্তু ঢাকার ইতিহাস হ্যামিলনের চেয়ে সমৃদ্ধ। ইতিহাসের অনেক উত্থান-পতন ও বিবর্তনের সাক্ষী এই ঢাকা। ঢাকার এক সময়ের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাসেল মোরল্যান্ড স্কিনার ১৮৪০ সালে ঢাকায় একটি মিউনিসিপ্যাল কমিটি প্রতিষ্ঠা করেন। আর আধুনিক ঢাকার শুরু ১৮৬৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ১৮৮৫ সালে সর্বপ্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান হন আনন্দ চন্দ্র রায়। অবশ্য প্রত্যক্ষ ভোটে তিনি নির্বাচিত হননি। বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলে ঢাকার স্থানীয় প্রশাসনে আরো নানা পরিবর্তন হয়। স্বাধীন ঢাকায়ও অনেকে মেয়র হয়েছেন।
সবশেষ মেয়র আনিসুল হক। যিনি ঢাকাকে একটি আধুনিক ঢাকা করার স্বপ্ন ধারণ করেছেন। নির্বাচনের আগে তিনি যে ম্যানিফেস্টো দিয়েছেন তা পালনে তিনি ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়েছেন। অবাস্তব কোনো প্রতিশ্রুতি তিনি দেননি, অলীক কোনো স্বপ্নও দেখাননি। নির্বাচনের আগে তিনি নগর বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ করেছেন, পরিকল্পনা করেছেন, সে অনুযায়ী বাস্তবায়নে রাস্তায় নেমেছেন। নিবাচনের আগেও ঝাড়ু হাতে নেমেছেন, পড়েও পরিচ্ছন্ন ঢাকা গড়তে তিনি ঝাড়ু ছাড়েননি। পাশাপাশি তার সীমাবদ্ধতা ও অপারগতাকেও স্বীকার করেছেন। সত্যকে সত্য বলে স্বীকার করেছেন। অযুক্তিতে যুক্তির প্রলেপ লাগাননি। গণপরিবহন, জলাবদ্ধতা, খেলার মাঠ, এলইডি বাতি, পরিবেশ উন্নয়ন, সড়ক উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা নিয়ে তার কর্ম পরিকল্পনা ছিল। তা বাস্তবায়নে তিনি নিজের কাছেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন।
মেয়র হিসেবে তার সফলতা নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। এটাই স্বাভাবিক। ব্যবসায়িক হিসেবেও তিনি সফল। কিন্তু ব্যক্তি আনিসুল হক সব কিছুকেই ছাড়িয়ে গেছেন। বিটিভির যুগে তার অসাধারণ উপস্থাপনা আমাদের মনে আজও দাগ কেটে আছে। গানের জলসা থেকে শুরু করে সিরিয়াস ঘরানার অনুষ্ঠান উপস্থাপনেও তিনি অনন্য। নির্বাচন উপলক্ষে টেলিভিশন বিতর্কে বাংলাদেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে হাজির করার মতো অসাধ্য তিনি সাধন করেছেন। এ রকম বিতর্ক শুধু আমেরিকাসহ কয়েকটি দেশেই হয়ে থাকে। আজ থেকে দুই দশক আগে তিনি এরকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন, যা আজও আমরা দেখি না।
সৎসাহস, গণতান্ত্রিক চেতনা, দেশপ্রেম ও অঙ্গীকার সম্পন্ন একজন ব্যক্তির কাছেই সাফল্য ধরা দেয়। ব্যক্তি হিসেবে তিনি যেমন স্মরণীয়, মেয়র হিসেবেও তাই।
ইঁদুর দূর করতে হ্যামিলনের মেয়রের মতো তিনি বাঁশিওয়ালার স্মরণাপন্ন হননি। চিকুনগুনিয়া দূর করতে তিনি নিজেই ঝাড়ু, কোদাল নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন। হ্যামিলনের মেয়রের মতো তিনি প্রতিশ্রুটি ভঙ্গ করেননি, প্রতিশ্রুতি পালনে তিনি নিজেই স্বপ্নের বাঁশিতে আওয়াজ তুলেছেন। সে আওয়াজ ঢাকাবাসী বহুদিন মনে রাখবে।
বাংলাদেশ সময়: ২০২১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০২, ২০১৭