ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

টুঙ্গীপাড়া: যেখানে ঘুমিয়ে আছেন বঙ্গবন্ধু

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৫৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৪, ২০১৭
টুঙ্গীপাড়া: যেখানে ঘুমিয়ে আছেন বঙ্গবন্ধু টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধে কয়েকজন দর্শনার্থী। ছবি:মহসিন হোসেন

টুঙ্গিপাড়া থেকে ফিরে: গোপালগঞ্জের মধুমতি নদীতীরে টুঙ্গীপাড়ায় ঘুমিয়ে আছেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাশেই ঘুমিয়ে আছেন তার পিতা-মাতা। প্রতিদিন সেখানে ছুটে যাচ্ছেন ছেলে-বুড়ো, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাসহ হাজারো মানুষ। ছুটে যাচ্ছেন প্রশাসনের সর্বস্তরের কর্মকর্তা থেকে সর্বনিম্ম পদের কর্মীটি পর্যন্ত।

সবাই বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে ফুল দিয়ে, প্রাণের আকুতি ঢেলে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। কেউবা আবার ফাতেহা পাঠ করে তার আত্মার শান্তির জন্য সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে মন খুলে দোয়া করছেন।

এ যেন এক পবিত্র তীর্থ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি, আন্দোলন-সংগ্রাম, বর্ণাঢ্য জীবন ও ত্যাগ সম্পর্কে জানতে পেরে আনন্দিত, গর্বিত। তারা বঙ্গবন্ধুর কবরের পাশে শ্রদ্ধা জানান, তার জন্য কাঁদেন। যে যার ধর্মমতে তার জন্য প্রার্থনা করেন।

গ্রামটি পাটগাতী ইউনিয়ন পরিষদের অধীনে হলেও গ্রামের নামেই উপজেলা সদরের নাম হয়েছে টুঙ্গীপাড়া। গোটা টুঙ্গীপাড়াকেই আজ বদলে দিয়েছে বঙ্গবন্ধুর সমাধিস্থল।

সুজলা-সুফলা শস্যশ্যামলা এই বাংলার গ্রাম দেখলে এমনিতেই মনটা ভাল হয়ে যায়। তার ওপরে এমন এক অজপাড়া গাঁয়ের মধ্যে এত সুন্দর পরিপাটি রাস্তাঘাট। সাজানো গোছানো একটি সমাধিস্থল।

গোপালগঞ্জ জেলা সদর থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে শান্ত সুন্দর নিরিবিলি এই টুঙ্গীপাড়া গ্রামে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্ম হয় বাঙালি জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। আবার এই গ্রামেই প্রকৃতির মমতাঘেরা কোলে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন বঙ্গবন্ধু।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ১৯৯৯ সালের ১৭ মার্চ সমাধিসৌধের নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ৩৮.৩০ একর জমির ওপর ১৭ কোটি ১১ লাখ ৮৮ হাজার টাকা ব্যয়ে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সহযোগিতায় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এ সমাধিসৌধ নির্মাণ করে। টুঙ্গীপাড়ার বাগিয়া (বাইগার) নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে এ মাজার কমপ্লেক্স। লাল সিরামিক ইট আর সাদা-কালো টাইলস দিয়ে গ্রিক স্থাপত্যশৈলীর আদলে নির্মিত সৌধের কারুকার্যে ফুটে উঠেছে বেদনা ও শোকের আবহ।

কমপ্লেক্সের সামনের দু’পাশের উদ্যান পেরোনোর পরই বঙ্গবন্ধুর কবর। পাশেই তার বাবা-মায়ের কবর। এই তিন কবরকে ঘিরেই নির্মাণ করা হয়েছে মূল স্থাপনা। সাদা পাথরে নির্মিত গোলাকার এক গম্বুজ বিশিষ্ট সমাধিসৌধের ওপর দেয়ালে জাফরি কাটা। এর মধ্য দিয়ে সূর্যের আলো আসে। উপরে কারুকাজ করা কাচ ভেদ করেও আলো ছড়িয়ে পড়ে কবরে।

চারদিকে কালো টাইলস ও মাঝখানে শ্বেতশুভ্র টাইলসে বঙ্গবন্ধুর কবর বাঁধানো। উপরের অংশ ফাঁকা। কবর তিনটি ঘিরে রাখা হয়েছে সংক্ষিপ্ত রেলিং দিয়ে। ২০০১ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকন্যা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সমাধিসৌধের উদ্বোধন করেন। কমপ্লেক্সের মধ্যে রয়েছে পাঠাগার, গবেষণাকেন্দ্র, প্রদর্শনীকেন্দ্র, মসজিদ, পাবলিক প্লাজা, প্রশাসনিক ভবন, ক্যাফেটেরিয়া, উন্মুক্ত মঞ্চ, বকুলতলা চত্বর, স্যুভেনির কর্নার, প্রশস্ত পথ, মনোরম ফুলের বাগান ও কৃত্রিম পাহাড়।

মাজার কমপ্লেক্সের পাঠাগারে দেড় হাজারেরও বেশি বই রয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ‘আমার কিছু কথা’, শেখ হাসিনার লেখা ‘আমার পিতা শেখ মুজিব’, ‘ওরা টোকাই কেন’ প্রভৃতি গ্রন্থ।

এক নম্বর ফটকের প্রবেশমুখ ও দুই নম্বর ফটকের সামনে দুটি সাইনবোর্ডে সুন্দর দুটি  কবিতা লিখে রাখা হয়েছে। আগতদের অনেককে কবিতা দুটি পড়তে দেখা গেল।

এক নম্বর ফটকের সামনের কবিতাটি লিখেছেন সৈয়দ ফখরুদ্দিন মাহমুদ। ১৯৮৪ সালের ১৪ জুন।

"একটি অমর সমাধি"

 সৈয়দ ফখরুদ্দিন মাহমুদ

 

"দাঁড়াও পথিক বর"যথার্থ বাংগালী, যদি তুমি হও

 ক্ষণিক দাঁড়িয়ে যাও, এই সমাধি স্থলে

এখানে ঘুমিয়ে আছে, বাংগালীর সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা

এদেশের মুক্তিদাতা, বাংলার নয়নের মণি

শত দুঃখ জ্বালা স'য়ে, জীবনের বিনিময়ে যিনি

বাংগালীর দিয়ে গেছে স্থান, বিশ্বের দুয়ারে

বিনিময়ে দিয়েছে আত্মাহুতি, তার পুণ্যময়ী সতী

নিষ্পাপ কনিষ্ঠ সন্তান, পিতার আদুরে "রাসেল",

স্নেহের পরশ পেতে, সর্বদা ছিল যে তার

পিতার কাছে কাছে ঘেঁষে

নবপরিণীতা পুত্রবধূ দু'টি, হায়; কেহই তো পায়নি রেহাই

    উন্মাদের নির্মম বুলেট হতে

হতভাগ্য বাংগালী আজ তাই, অভিশপ্ত জাতি

   সুতরাং মুখ ঢাকো, মুখ ঢাকো তুমি

এ আমার প্রলাপ নহে, এ আমার পাপের জ্বালা

   এ আমার অন্তরের ব্যথা

তাই, হে পথিক বর! আরো একটু দাঁড়িয়ে যাও

হেথা পুণ্য ভূমে,"বাংগালী তীর্থভূমি, টুংগীপাড়া গ্রামে

জীবনে কখনও যে একদণ্ড তরে লভেনি বিশ্রাম

   আজ সে, গহন মাটির গোরে, তাঁরই শান্তির নীড়ে

   যেন করিছে আরাম

পার্শ্বে শায়িতা আছে স্নেহময়ী মাতা, আরো আছে পুণ্যবান পিতা

   কৃতজ্ঞ জাতিকী আর কহিব তোরে

জীবনে তো নিয়েছিস শুধু, প্রতিদানে কিছুই কি

   দেবার নেই তোরযদি থাকে

হে পথিক! তবপরে মোর মাত্র একটি অনুরোধ--

   তোমার হাতের ঐ--"ফুলমালা" হ'তে

অন্তত একটি "পাপড়ি", আর একবিন্দু "অশ্রুজল"

   ফেলে যেও ধীরে-- অবশ্য ক'রে এই সমাধিস্থলে

আর এমনি করেই "তার কাছে সমগ্র জাতির ঋণ"

   শুধরাতে হবে পলে পলে

আমার বিশ্বাসএরই মধ্য দিয়ে বাংগালীর ঘুচিবে অভিশাপ,

   আসিবে সুদিন
(১৪ই জুন, ১৯৮৪)

বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৪, ২০১৭
এমএইচ/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।