‘সেঁজুতিকে ফেরানো গেল না’ এই লেখাটি পীড়া দেয় হৃদয়ে। সেই থেকে অবহেলিত গ্রামীণ সাংবাদিকতার হালহকিকত নিয়ে লেখার ইচ্ছে জাগে।
শ্রদ্ধেয়-বিদগ্ধ সাংবাদিক সুমি খানের সেই লেখাটি অতি যত্নসহ পড়লাম। লিঙ্ক করলাম ফেইসবুকে। সহকর্মীদের মধ্যে আড্ডায় সরস হয়ে উঠল সেই লেখার গল্প। সত্যিই তো-সাংবাদিকতায় নারী ও মফস্বল সাংবাদিকেরা কত না অবহেলা-অবজ্ঞায় দিন কাটায়, তার ইয়ত্তা নেই। সুমি খানের লেখায় নারী সাংবাদিকদের কথাই উঠে এসেছে। কিন্তু অভাগা মফস্বল সাংবাদিকদের জীবনমান নিয়ে ভাবার যেন কেউ নেই। অভাগা যেদিকে যায়, সাগরও শুকিয়ে যায়--সেই অবস্থা। মফস্বল-গ্রামীণ সাংবাদিকেরা আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন, বুকভরা ভালবাসা নিয়ে এ গৌরবময় পেশায় সম্পৃক্ত হন। দেশ, জাতি ও আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে সঁপে দেন। কিন্তু তাদের জীবনে কত শত দুঃখ-বেদনা, দুর্দশা, হতাশা ও ব্যর্থতার কাহিনী লুকিয়ে আছে তা প্রকাশ পায় না। হৃদয়ের গহীনে পুষে জীবন কাটান তাঁরা। রয়ে যায় শুধু জীবনের খাতায়। সেই তাগিদেই এ লেখার উদ্রেক।
আসা যাক, মফস্বল-গ্রামীণ সাংবাদিকতার মনস্তাত্ত্বিক বেদনার কথা। সাংবাদিকতা পেশায় সম্পৃক্ত হয়েও আইনে সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় মেলে না। ১৯৭৪ সালে প্রণীত বাংলাদেশ সংবাদপত্র আইনে সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দেয়নি। ১৯৬০ সালে প্রণীত ওয়েজ বোর্ড রোয়েদাদে বলা হয়েছে ‘সৌখিন সাংবাদিক’। অর্থাৎ শখের বশে সংবাদপত্রে কাজ করা। আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রে যাদের ‘স্ট্রিংগার’ বলা হয়।
যুগে যুগে মানুষের চিন্তাচেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি, মনন-রুচি, বিশ্বাস-মূল্যবোধ পাল্টেছে। এর পেছনে অবশ্য সংবাদপত্রের প্রভাব অপরিসীম। সংবাদপত্রে প্রতিনিধিত্ব ও সংবাদ-সংক্রান্ত কাজে জড়িত থাকার পরও মফস্বল সাংবাদিকেরা ‘সাংবাদিক’ বলে স্বীকৃতিটুকু আজও পায়নি। অথচ গ্রামীণ-সমাজের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ ও সংবাদের মাল-মসলার জোগান দেয় এরা। গ্রামীণ সংবাদ বলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদও কম গুরুত্ব পায়। কারণ সেসব গ্রামীণ সাংবাদিকদের লেখা। প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন।
গ্রামীণ সাংবাদিকতার ইতিহাসে প্রোজ্জ্বল-দেদীপ্যমান নক্ষত্র হলেন কাঙাল হরিণাথ মজুমদার ও মোনাজাত উদ্দিন। কালজয়ী এ দুই সাংবাদিক নতুন প্রজন্মের কাছে শক্তি, প্রেরণা ও সৎ সাহসিকতার প্রতীক।
সার্ধশত বছর আগে এক নিভৃত পল্লীতে বসে দাপুটে সাংবাদিকতা করেছেন কাঙাল হরিণাথ। রাজশক্তির রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সততা ও অদম্য সাহসের সাথে সাংবাদিকতা করেছেন। তাঁর সম্পাদিত ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকায়’ তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে একটি সংবাদের শিরোনাম করেছেন ‘গরুচোর ম্যাজিস্ট্রেট’। এই শিরোনামই প্রমাণ করে গ্রামাঞ্চল-গ্রামীণ সাংবাদিকতা কত তেজস্বী ছিল। হ্যাঁ, এখনো গ্রামাঞ্চলে সেই তেজস্বী-প্রতিবাদী সাংবাদিক রয়েছে। নানা অপশক্তি-আগ্রাসনের সাথে লড়ছেন এরা। নেমে আসছে হুমকি-ধমকি, নির্যাতন-নিপীড়ন। তবুও কাঙাল হরিণাথ বা মোনাজাত উদ্দিনের মতো পথচলা থেমে নেই। সমাজ ও দেশের প্রতি দায়বদ্ধতায় অদম্য স্পৃহায় ছুটে চলেছেন সম্মুখপানে।
আশা জাগানিয়া বিষয়, আজকাল গ্রামাঞ্চালেও উদ্যমী-শিক্ষিত তরুণেরা ছুটে আসছেন এই পেশায়। এরা সাংবাদিকতা পেশাকে বেছে নিয়েছে ব্রত হিসেবে। নানা প্রতিকূলতা ও কণ্টাকাকীর্ণ পথ মাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন-নতুন স্বপ্নের আশায়। কবিগুরুর ভাষায় বলতে হয় ‘মুক্ত করো ভয়, আপনা মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়। ’ শত বাঁধা-বিপত্তির দেয়াল টপকিয়ে লোভ-লালসার বেড়াজাল ছিন্ন করে নিজেকে জয় করে চলেছেন অনেকেই। কিন্তু কতটুকু সফল হতে পারছেন তাঁরা? গ্রামাঞ্চলে নেই পেশাগত উৎকর্ষ বৃদ্ধির সহায়তা। রুটি-রুজির চাহিদা মেটাতে না পেরে চলে যাচ্ছেন অন্য পেশায়। ধরে রাখা যাচ্ছে না তাঁদের। প্রশ্ন জাগে, কে ধরে রাখবে, তাঁদের। কার দায়িত্ব?
আশা-নিরাশার দোলায় দোদুল্যমান গ্রামীণ সাংবাদিকতার জীবনযাত্রা। চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে বিরাট ফারাক। হতাশা কুঁরে কুঁরে খাচ্ছে তাদের। তাঁদের ভেতরের এ কথা কখনো উঠে আসবে না পত্রিকার পাতায়। লাজ-লজ্জার ভয়ে হাঁড়ি ভাঙ্গার খবর প্রকাশ করেন না গ্রামীণ সাংবাদিকেরা। সত্যি বলতে কী, গ্রামীণ সাংবাদিকদের রুটি-রুজির বিষয়টি অনেকটা অনিশ্চিত। হাতে গোনা কয়েকটি পত্রিকা ছাড়া সিংহভাগ পত্রিকা সংবাদ পাঠানোর ফ্যাক্স, মেইল, টেলিফোন খরচটুকুও দেয় না। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর কাজ করেন তাঁরা। এই অবস্থায় সৎ ও সততার সাথে কিভাবে দায়িত্ব পালন করা যায় সেই প্রশ্ন চলে আসে অনায়াসে। প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, শূন্য উদরে কী সমাজ, দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল চিন্তা করা যায়?
কয়েককটি পত্রিকা সম্মানি ভাতা দেয়। খুবই সম্মানের কথা। কিন্তু যা দেওয়া হয় (লজ্জায় অঙ্ক অনুল্লেখ্য) তা কী সম্মানি-নাকি অসম্মানি ভাতা, আজও সেই হিসাব মেলাতে পারিনি। অথচ একই হাউসে নগর, মহানগরের সাংবাদিকেরা পান উচ্চ বেতন, ভাতাদিসহ নানা সুযোগ-সুবিধা। মফস্বল সাংবাদিকেরা সেই সুবিধার ছিটেফোঁটাও পান না। কী অদ্ভুত চিত্র আমাদের সাংবাদিকতা ইতিহাসে। এক ভাইয়ের পাতে রাজ্যের খাবার আর এক ভাইয়ের শূন্য উদর।
তবে এই কথাও অস্বীকার করার জো নেই যে, মফস্বল সাংবাদিকেরা নিজেরাই নিজেদের পায়ে কুড়াল ঠুকছে। নীতি-নৈতিকতা ভুলে দলাদলি, প্রতিহিংসায় আর অপসাংবাদিকতা ও কূপমণ্ডুকতায় জড়িয়ে পড়ছে। দেশের সবকটি উপজেলায় যেন একই হাল। পেশার মান বৃদ্ধি-স্বকীয়তার উৎকর্ষ সাধনের কোনো চিন্তাচেতনা নেই।
নিজের কর্মক্ষেত্র বোয়ালখালী উপজেলার কথাই যদি বলি, সাধারণ মানুষের একটি অভিযোগ শুনতে শুনতে মাথা নিচু হয়ে যায়। তা হল, সাংবাদিকেরা অনিয়ম-অন্যায়-দুর্নীতি আর নানা অসঙ্গতির চিত্র ধরে ধরেন। কিন্তু তাঁরা কতটুকু স্বচ্ছতা বজায় রাখেন। তারাই তো এসবে জড়িয়ে পড়েন। প্রশাসনের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে দালালি করেন। প্রশাসনের প্রেসনোট নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। গুটিকয় অসৎ চরিত্রের লোক এ পেশায় ঢুকে গৌরবের এই পেশাকে কলঙ্কিত করছে।
তবে সুখের কথা, নীতি-নৈতিকতা বজায় রেখে এখনো গ্রামীণ সাংবাদিকতা করে যাচ্ছে অনেকেই। তবে নৈতিকতা বির্বজিতদের কাজে সৎ ও নিষ্ঠাবান সাংবাদিকেরা হতাশায় ভোগেন। তবুও ছুটে চলেছেন সম্মুখ পানে। তাঁদের বিশ্বাস, সৎ, সুন্দর ও কল্যাণমুখী কাজের ভিড়ে অসত্য একদিন হারিয়ে যাবে। অসুন্দর-অকল্যাণ একদিন নিশ্চিত পরাভূত হবেই। যেমনটা হয়েছে ‘৭১ এর মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে।
নিজেদের মধ্যে দলাদলি আর অনৈক্যের কারণে রুটি-রুজির ন্যায্য দাবি নিয়ে কোথাও কথা বলতে পারছে না গ্রামীণ সাংবাদিকেরা। অনিশ্চয়তার মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছেন। অথচ, ওয়েজ বোর্ডের দাবি নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে সাংবাদিকেরা আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছেন। শুধু বাদ পড়েছেন মফস্বল সাংবাদিকেরা। মফস্বল সাংবাদিকদের দিকে কেউ চোখ তুলে তাকায়নি। কী সরকার, কী মালিক পক্ষ, কী অভিভাবকতুল্য বড় বড় সাংবাদিক নেতারা! অন্তত দুবেলা, দুমুঠো খেয়ে-পরে বাঁচার দাবিও উচ্চারিত হচ্ছে না।
এবার আসা যাক, সেঁজুতির কথায়। সেঁজুতিকে চিনি না, জানি না। যতটুকু জেনেছি তিনি বৃত্তি নিয়ে বিদেশে যাচ্ছেন পড়াশোনা করতে। রাগ-অভিমান নিয়ে। দেশে আর ফিরে না আসার কথা বলেছেন। তিনি সাংবাদিক। ভালবেসেছেন এই দেশ, মাটি ও মানুষকে। ভালবাসার টানে তাঁকে একদিন ঠিকই ফিরে আসতে হবে এই বাংলা সবুজ-শ্যামল দেশে।
সেঁজুতিরা ঢাকা বা মহানগরকেন্দ্রিক কাজ করেছেন বলে তাদের অভিমানের কথা উঠে এসেছে জোরালোভাবে। আর ‘ফ্রি সার্ভিস’ খ্যাত আমরা যারা মফস্বলে কাজ করি তারা কী পরিমাণ অবহেলা-অবজ্ঞা আর কষ্টে রয়েছি, তা নিশ্চয় অবগত আছেন সুমি আপারা। এখানেও তো রয়েছে অনেক নারী সাংবাদিক। সেঁজুতি যেতে চায়, যেতে দিন। নিজেকে গড়ে তুলতে দিন। মিশুক মুনীর হয়ে ফিরতে দিন। আর নতুন প্রজন্মদের বা মফস্বল সাংবাদিকদের জগৎটা অবারিত-প্রসারিত করার উদ্যোগ নিন। নতুবা হাজারো সেঁজুতি মাতৃভূমির মাটি ও মানুষের মায়া ত্যাগ করে পালিয়ে যাবে ভিন্ন দেশে।
মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন: বোয়ালখালী প্রতিনিধি, দৈনিক পূর্বকোণ, চট্টগ্রাম।
e-mail : nub.nazim@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১১৪৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৯, ২০১১