ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

মহানায়কের দেশে ফেরা: অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০১২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০২০
মহানায়কের দেশে ফেরা: অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা

‘নতুন করে গড়ে উঠবে এই বাংলা, বাংলার মানুষ হাসবে, বাংলার মানুষ খেলবে, বাংলার মানুষ মুক্ত হয়ে বাস করবে, বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাবে- এই আমার সাধনা, এই আমার জীবনের কাম্য। আমি যেন এই কথা চিন্তা করেই মরতে পারি-এই আশীর্বাদ, এই দোয়া আপনারা আমাকে করবেন।’

মুক্ত স্বদেশে নেমে এভাবেই যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ার এবং এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন হাজারের বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ও স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

ওই দিন বিশাল জনসমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন বাঙালির স্বাধীনতার এই মহান স্থপতি।

তাদের উদ্দেশ্যে নাতিদীর্ঘ ভাষণে জাতিকে দেন দিক-নির্দেশনাও।

আজ ১০ জানুয়ারি। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। ১৯৭২ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে রক্তস্নাত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন। মহান এই নেতার প্রত্যাবর্তনে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয় পূর্ণতা পায়।

স্বয়ং বঙ্গবন্ধু তার এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে ‘অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদাররা বাঙালির অবিসংবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমন্ডির বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়।

তাকে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়। বাঙালি যখন স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে, বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের কারাগারে প্রহসনের বিচারে ফাঁসির আসামি হিসেবে মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন।

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালিদের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হওয়ার পর বিশ্বনেতারা বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেন। আন্তর্জাতিক চাপে পরাজিত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শেষ পর্যন্ত বন্দিদশা থেকে বঙ্গবন্ধুকে সসম্মানে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। লন্ডন হয়ে ১০ জানুয়ারির এক পড়ন্ত বিকেলে ঢাকায় ফিরলেন মহানায়ক।

তবে এর আগে যাত্রাবিরতি করলেন দিল্লিতে।  সেই শীতের সকালে দিল্লির আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানাতে সব প্রটোকল ভেঙে ছুটে এসেছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি আর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।

যেন মহানায়কের পদস্পর্শে ধন্য হলো ঐতিহাসিক দিল্লি। সেখানে সংক্ষিপ্ত এক ভাষণে ভারতবর্ষের জনগণ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদানের জন্য কৃতজ্ঞতা জানান স্বাধীন বাংলাদেশের এই স্বপ্নদ্রষ্টা।

ইন্দিরা গান্ধীর কাছে জানতে চাইলেন, কখন বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় বাহিনী ফেরত আসছে? জবাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘যখন আপনি চাইবেন। ’ তাহলে আগামী স্বাধীনতা দিবসের আগেই হোক। তা-ই হবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অতি অল্প দিনেই ভারতীয় সৈন্যদের দেশে ফেরত পাঠানো হয়।

দেশে ফেরার একদিন পর বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে মন্ত্রিসভা পুনর্গঠন করলেন। হাত দিলেন ভঙ্গুর অর্থনীতির সদ্য জন্ম নেওয়া দেশ পুনর্গঠনে।

এক কোটি ছিন্নমূল শরণার্থী ভারত থেকে দেশে ফিরছে। চারদিকে লাখ লাখ স্বজন হারানো মানুষের আহাজারি। বাতাসে বারুদের গন্ধ। দেশের যোগাযোগব্যবস্থা পলায়নরত পাকিস্তান সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ ধ্বংস করে রেখে গেছে। তাদের পোঁতা মাইনে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম সম্পূর্ণ অচল।

ব্যাংকগুলোর ভল্ট শূন্য। খাদ্য গুদামগুলোতে নেই এক ছটাক চাল। বেসামরিক প্রশাসন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চীন-মার্কিন-সৌদি বলয় বাংলাদেশের জন্য একটি প্রচণ্ড বৈরী পরিবেশ সৃষ্টি করে রাখার জন্য সদা তৎপর।

দেশের অভ্যন্তরে এ দেশীয় পাকিস্তানি দালাল ঘাতক রাজাকার-আলবদর, জামায়াত আর চীনপন্থী অতিবামরা একাট্টা হয়ে চালাতে লাগলো একের পর এক অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা। আজ এই পাটের গুদামে আগুন দেয় তো কাল ওই সার কারখানায় বিস্ফোরণ।

চরম অস্থিতিশীল পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র পরিচালনা ও দেশ পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন, তিন বছর তিনি দেশের মানুষকে কিছু দিতে পারবেন না! এই তিন বছর হবে দেশ গড়ার প্রাথমিক পর্যায়।

সম্পূর্ণ একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের জন্য তিন বছর এমন কোনো সময় নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপ আর জাপানকে সার্বিক সহায়তা দিয়েছিল অর্থনৈতিক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র। সেই বিচারে বঙ্গবন্ধু দেশ পুনর্গঠন কাজগুলো করেছিলেন একক প্রচেষ্টায়।

সঙ্গে ছিল এক ঝাঁক লোভ-লালসামুক্ত ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ দলীয় নেতা-কর্মী ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সহায়তা কামনা করেন। অনেকেই সাড়া দেয় তার ডাকে।

এই সাড়ে তিন বছরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে ভারতীয় বাহিনীকে সসম্মানে নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে সক্ষম হয়েছিলেন। ভারত থেকে দেশে ফেরা প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে পুনর্বাসন করে তার সরকার।

বাংলাদেশকে তিনি জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, ওআইসি, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনসহ অন্য বিশ্ব সংস্থার সদস্য করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার এক বছরের মাথায় বিশ্বের অন্যতম আধুনিক একটি সংবিধান রচনা ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের এক অমর কীর্তি। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড।

উচ্চশিক্ষা একটি জাতির অন্যতম ভিত্তি। সেই  ভিত্তি মজবুত করতে তিনি গঠন করে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন।

আজীবন দুখী মানুষের পক্ষে সংগ্রাম করা মানুষটি চেয়েছিলেন, বীরের জাতি বাঙালি বিশ্বে মাথা উঁচু করে বাঁচবে। একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ, ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ। কিন্তু ঘাতকের বুলেট তাকে সে সুযোগ দেয়নি।

স্বাধীনতাবিরোধীদের একটি চক্র সপরিবারে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবসহ সপরিবারে তাকে হত্যা করে। ঘাতকের হাত থেকে রেহাই পায়নি ১০ বছরের শিশু শেখ রাসেলও।

ওই সময় দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুকন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোটবোন শেখ রেহানা। পিতার অসম্পূর্ণ কাজ সম্পন্ন করতে এখন দিন-রাত এক করে কঠোর পরিশ্রম করে চলেছেন শেখ হাসিনা।

দেশের কল্যাণে নানা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে চলেছেন তিনি। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এখন বাস্তব। উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে এরই মধ্যে ফ্রেমওয়ার্ক গড়ে দিয়েছেন তিনি। তা হচ্ছে- ভিশন ২০২১, ২০৩০ এবং ২০৪১। রয়েছে শতবর্ষব্যাপী ডেল্টা প্ল্যান।

বঙ্গবন্ধু যখন দেশে ফিরছিলেন, তখন দিল্লি থেকে তার সঙ্গী হয়েছিলেন বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ফারুক চৌধুরী।

এক স্মৃতিকথায় তিনি লেখেন, ‘ব্রিটিশ রয়েল প্লেনটি যখন ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরের ওপর চক্কর দিয়ে অবতরণের সুযোগ খুঁজছে, তখন নিচে মহানায়ককে বরণ করার জন্য হাজার হাজার মানুষ। বঙ্গবন্ধু মাথায় হাত দিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন। ’

‘আমি তার কাছে গিয়ে বললাম, নিচে তাকিয়ে দেখুন। বঙ্গবন্ধু প্লেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে শুধু একটা কথাই বললেন, এত মানুষকে খাওয়াব কী?’

সেই সময় থেকে দেশের মানুষ কয়েকগুণ বেড়েছে। বর্তমানে ১৬ কোটির বেশি মানুষকে বাংলাদেশ বর্তমানে শুধু খাওয়ায়-ই না, তাদের খাদ্যের যোগান দেওয়ার পর বাকিটা রপ্তানিও করে।

দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে সোনার বাংলাকে শশ্মানে পরিণত করে পাকিস্তানিরা। পুরো দেশ নিমজ্জিত হয় কালো অন্ধকারে। পুরো জাতির অপেক্ষা, কখন আসছেন প্রিয় নেতা। তিনি এলেন, অবশেষে বাঙালির অপেক্ষার প্রহর কাটলো। তার সেই ফেরার মধ্য দিয়ে দূর হয় অন্ধকার; যেন অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা করে বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাঝে পূর্ণতা পায় বাঙালির স্বাধীনতা। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের এই দিনে জাতির পিতার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। আর গড়ে ওঠুক তার স্বপ্নের সোনার বাংলা- এই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: উপাচার্য, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মেলান্দহ, জামালপুর

বাংলাদেশ সময়: ১৫১২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০২০
এসএইচ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।