ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

নিরাশ আঁধারে খোদা তুমি হে আশার নূর (২)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২২, ২০২০
নিরাশ আঁধারে খোদা তুমি হে আশার নূর (২)

হার অলীরা নূহে কিস্তি বা শনাছ
ছোহবতে ঈ খালকরা তুফাঁ শনাছ
দামানে উগীর হার এক বে গুমা
তারেহী আজ আখেরে আফত জমা।
- রুমী

পাপ অনাচার ঘিরে চারিধার, জেগেছে মহাপ্লাবন।
সে মহাপ্লাবনে নূহ নবী সম আল্লাহর প্রিয়জন
তরিকা তাদের নূহের কিস্তি, যে জন উঠিবে তাতে
আল্লাহ তাদের জান, মাল, ঈমান রাখিবেন ছালামতে।

 
- ভাবানুবাদ

যুগে যুগে মানুষ যখন নিজের কর্তব্যকর্মকে ভুলে পাপাচারে নিমজ্জিত হয়েছে, বিধাতা তাদের নানা প্রকার বিপদাপদ দিয়ে সঠিক পথে আনার ব্যবস্থা করেছেন। যতদিন মানব জাতি বিধাতার অনুশাসনকে মনে-প্রাণে ধারণ করে তাদের জীবনাচারকে সংযত করে চলেছেন, তাদের জীবন যাপনে কোনো দুঃখ-কষ্ট অবতীর্ণ হয়নি।

নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘আমার কাছে ৬টা কাজের প্রতিজ্ঞা করবে, আমি রাসুল তোমাদের বেহেশতের প্রতিজ্ঞা করলাম।
(১)    সদা সত্য কথা বলবে;
(২)    প্রতিজ্ঞা পূরণ করবে;
(৩)    যথা সময়ে আমানত ফেরত দেবে;
(৪)    অবৈধ প্রেম থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবে;
(৫)    অবৈধ কাজ থেকে তোমার দৃষ্টিকে সংযত করে রাখবে;
(৬)    অন্যায় কাজ থেকে তোমার হাত গুটিয়ে রাখবে।

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে, আমরা যদি রাসুলে পাকের উপরোক্ত অনুশাসনগুলি পালন করতে পারি; আমরা পরকালে বেহেশতের দাবিদার হতে পারবো এবং ইহলৌকিক জীবনেও পরিপূর্ণ শান্তি লাভ করতে পারবো।

হজরত আলী ইসলামের ৪র্থ খলিফা বলেছেন- ‘৫টা কারণে একটা দেশ বা একটা জাতি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। ’

(১)    দেশের বিদ্বান ব্যক্তিরা লোভী হলে কে দেশের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করবে?
(২)    দেশের নেতারা ঐশ্বর্যের পিছনে ছুটিলে সাধারণ মানুষ কাকে অনুসরণ করবে?
(৩)    দেশের ব্যবসায়ীরা অসাধু হলে সাধারণ মানুষ কাকে বিশ্বাস করবে?
(৪)    দেশের সৈন্যদল শুধু দেখার শোভাবর্ধন করলে কে দেশ রক্ষা করবে?
(৫)    দেশের প্রশাসন বিভাগীয় কর্মচারীরা ও ন্যায়দণ্ডধারী বিচারকমণ্ডলী দায়িত্বহীন হলে কে নিপীড়িত জনগণকে রক্ষা করবে?

এই ৫ কারণেই কোনো দেশ বা জাতি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।      - হাদিছে তিরমিজী শরিফ

এই পরিপ্রেক্ষিতে দেশবাসীর অবগতির জন্য সলিল চৌধুরীর ‘একগুচ্ছ চাবি’ কবিতাটি উল্লেখ করতে চাই।
একগুচ্ছ চাবি
সলিল চৌধুরী
উত্তরাধিকার সূত্রে
পেয়েছি শুধু এক গুচ্ছ চাবি
ছোটো-বড়ো মোটা-বেঁটে
নানারকমের নানা ধরনের চাবি
মা বললেন, যত্ন করে তুলে রেখে দে...
তারপর যখন বয়স বাড়লো
জীবন এবং জীবিকার সন্ধানে
পথে নামতে হোল
পকেটে সম্বল শুধু সেই এক গুচ্ছ চাবি
ছোটো বড়ো মোটা বেঁটে
নানারকমের নানা ধরনের চাবি......
কিন্তু যেখানেই যাই
সামনে দেখি প্রকান্ড এক দরজা
আর তাতে ঝুলছে
প্রকান্ড এক তালা
পকেট থেকে চাবির গুচ্ছ বের করি
এ চাবি সে চাবি
ঘোরাই ফেরাই-লাগেনা-খোলেনা 
ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরি-
মা দেখেন আর হাসেন
বলেন-'ওরে তোর-বাবার-হাতেও
ঐ চাবি দিয়ে কোনোদিন দরজা খোলেনি।
শুনেছি নাকি তার বাবার- হাতে খুলত...
আসল কথা কি জানিস?
এ সব চাবি হল
সততার সত্যের, যুক্তির, নিষ্ঠার।  
আজকাল আর ঐ চাবি দিয়ে 
এসব দরজা খোলেনা।
তবুও তুই ফেলে দিস্ না
তুই যখন চলে যাবি
তোর সন্তানদের হাতে দিয়ে যাস
এসব চাবির গুচ্ছ-
হয়তো তাদের হাতে
হয়তো কেন নিশ্চয়ই তাদের হাতে একদিন
ঐসব সততার, সত্যের, যুক্তির, নিষ্ঠার, চাবি দিয়ে
জীবনের বন্ধ দরজাগুলো
খুলে যাবে-খুলে যাবেই....|

এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সম্মানিত স্বাধীন বাংলাদেশের ভাইবোনদের জন্য আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট, আব্রাহাম লিঙ্কলনের লিখিত তার ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে স্কুলের হেডমাস্টারের কাছে পাঠানো চিঠির বাংলা তরজমা উদ্ধৃত করলাম।

মাননীয় মহাশয়,
আমার পুত্র এই বিদ্যালয়ে আজ তার প্রথম ক্লাস শুরু করতে চলেছে। আমি জানি ওর কাছে এই নতুন পরিবেশ বেশ কিছুদিন একেবারে অন্যরকম লাগবে। আমি তাই আশা করি এই কটা দিন আপনি ওকে একটু বেশিই স্নেহ করবেন। বিদ্যালয়ের এই ভিন্ন পরিবেশ ওর কাছে এক রোমাঞ্চকর আ্যডভেঞ্চার, যা ওকে ক্লাসে বসেই পৃথিবী ভ্রমণ করিয়ে দেবে, ওর অজান্তেই। সেই রোমাঞ্চকর আ্যডভেঞ্চার যা ওকে প্রথমবার পরিচয় করিয়ে দেবে যুদ্ধের সাথে…মৃত্যুর সাথে…দুঃখের সাথে। সেই রোমাঞ্চকর আ্যডভেঞ্চার যা ওকে শেখাবে এই জীবন বাঁচার জন্য সাহস, বিশ্বাস, আর ভালোবাসাই যথেষ্ট।

মাননীয় শিক্ষক মহাশয়, আমার পুত্রকে জ্ঞানার্জনের জন্য তাই আপনার কাছে পাঠালাম। ওকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন-এটাই আপনার কাছে আমার বিশেষ দাবি। আমার একান্ত অনুরোধ আপনার কাছে, ওর যা যা শেখা প্রয়োজন, তা যেন ওকে হাতে ধরে একটু স্নেহের সঙ্গে শেখাবেন দয়া করে।

মাননীয় শিক্ষক মহাশয়, আমার পুত্রকে অবশ্যই শেখাবেন-এই পৃথিবীতে সব মানুষই ভালো মানুষ নয়, সব মানুষই সৎ, সত্যবাদী নয়।

কিন্তু ওকে এ-ও শেখাবেন যে প্রত্যেক দুষ্টু মানুষের মধ্যেও ঠিক একজন বীর লুকিয়ে থাকে।
প্রত্যেক স্বার্থপর রাজনীতিকের মাঝেও একজন নিঃস্বার্থ নেতা থাকে।

আমি জানি এটা শিখতে ওর সময় লাগবে, তবুও যদি পারেন ওকে শেখাবেন পাঁচ ডলার কুড়িয়ে পাওয়ার চেয়ে এক ডলার খেটে রোজগার করা অনেক বেশি মূল্যবান।
ওকে শেখাবেন, হেরে যাওয়া কাকে বলে। কীভাবে হেরে যাওয়াকে মেনে নিতে হয় সম্মানের সঙ্গে।

কীভাবে জয়ের আনন্দ উপভোগ করতে হয়।
শিক্ষক মহাশয় ওকে শেখাবেন কীভাবে ঈর্ষা থেকে দূরে থাকতে হয়। ওকে শেখাবেন নিঃশব্দ হাসির সৌন্দর্য ঠিক কতটা সুন্দর হয়।

দেখবেন ও যেন আগেই এ কথা বুঝতে শেখে যারা অত্যাচার করে তারা চিরকালই দুর্বল হয়। তাদের সহজেই কাবু করা যায়।

শিক্ষক মহাশয় আমার পুত্রকে অবশ্যই শেখাবেন, পরীক্ষায় নকল করে পাস করার চেয়ে অকৃতকার্য হওয়া অনেক বেশি সম্মানজনক। ওকে শেখাবেন বইয়ের মাঝে কি অপার রহস্য লুকিয়ে আছে। কিন্তু ওকে ওর মতো করে কিছুটা সময় কাটাতে দিতে ভুলবেন না, যাতে ও আপন মনে ভাবতে পারে কি সম্পর্ক

পাখির সঙ্গে আকাশের
মৌমাছির সঙ্গে ফুলের
সূর্যের সঙ্গে সবুজ উপত্যকার।
ওকে শেখাবেন নিজের ওপর ওর যেন গভীর আস্থা থাকে, এমনকি যখন সবাই বলে ও ভুল।
ওকে শেখাবেন ভদ্রলোকের প্রতি ভদ্র আচরণ করতে, কঠোরদের প্রতি কঠোর।

দেখবেন আমার পুত্র যেন এ শক্তি পায় যাতে ও সেই উন্মত্ত জনতার স্রোত থেকে নিজেকে আলাদা করতে পারে যে স্রোতে সবাই গা ভাসিয়ে দেয়।

ওকে শেখাবেন ও যেন সবার কথা শোনে কিন্তু সঙ্গে এও শেখাতে ভুলবেন না যে ও যাই শুনুক তা যেন আগে সত্যের পর্দায় ছেঁকে নেয় এবং তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসা ভালোটাই যেন শুধু গ্রহণ করে-

ওকে এও শেখাবেন দুঃখের মাঝে কীভাবে হাসতে হয়।
কান্নার মধ্যে কোন লজ্জা থাকে না-এ কথা ওকে বুঝতে শেখাবেন।
শিক্ষক মহাশয় আমার পুত্রকে অবশ্যই শেখাবেন যারা নির্দয়, নির্মম তাদের ও যেন ঘৃণা করতে শেখে।

ও যেন শেখে কীভাবে অতিরিক্ত প্রশংসা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে হয়।
দেখবেন ও যাতে বুঝতে শেখে যে যদি কখনো ওর শক্তি আর বুদ্ধি বিক্রি করতে হয় ও যেন তাকেই করে যে এর সর্বোচ্চ দাম দেবে কিন্তু কোন অবস্থাতেই যেন ও ওর হৃদয় আর আদর্শকে বিক্রি না করে।

ওকে শেখাবেন যাতে ও মানুষের কষ্টে বিচলিত হতে শেখে।
ও যেন শেখে যেটা ও ঠিক মনে করবে তার জন্য শেষ অবধি লড়ে জেতে।
মাননীয় প্রধান শিক্ষক মহাশয়, আমার পুত্রকে স্নেহ করবেন কিন্তু আদর করবেন না। কেননা খাঁটি ইস্পাত আগুনে পুড়েই তৈরি হয়।
দেখবেন আমার সন্তানের যেন অধৈর্য হওয়ার সাহস না থাকে, থাকে যেন তার সাহসী হওয়ার ধৈর্য। ওকে এ শিক্ষাও দেবেন নিজের প্রতি ওর যেন গভীর আস্থা থাকে একমাত্র তবেই ওর গভীর আস্থা থাকবে মানবজাতির প্রতি।

এই হল আমার সুদীর্ঘ দাবি আপনার কাছে
দেখুন আপনার পক্ষে এর মধ্যে কতটা কি সম্ভব।
বড় মিষ্টি আর লাজুক, আমার ছেলেটা

উপরোক্ত কবিতা ‘একগুচ্ছ চাবি’ এবং আব্রাহাম লিঙ্কনের লিখিত চিঠির সারাংশ আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করতে হবে। নতুবা আমরা স্বাধীন দেশের সুনাগরিক হিসাবে বিশ্ব দরবারে প্রশংসার দাবিদার হতে পারবো না।

আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যেও আমূল পরিবর্তন আনতে হবে।
শিক্ষার সাথে দীক্ষা
বিদ্যার সাথে বিনয়
কর্মের সাথে নিষ্ঠা

জীবনের গভীরে মানুষের প্রতি ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধাবোধ। শিক্ষা ব্যবস্থায় অর্থকরী বিদ্যা, মূল্যবোধ, নৈতিকতা, আদর্শ চরিত্র গঠন এবং ধর্মীয় অনুভূতিকে যদি জাগ্রত করতে না পারি, আমাদের জীবনের সব আয়োজন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।

আমাদের জীবনাচারকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে আলোকিত ভালো মানুষ হওয়ার বিদ্যা অর্জন করতে হবে।

এমন সোনার দেশ, উদ্যমী মানুষ, প্রচুর পানি, উর্বর জমি ও সুন্দর আবহাওয়া থাকা সত্ত্বেও আমরা কঠিন পরিশ্রম সাধনা করে যদি আমাদের ভাগ্যকে সুপ্রসন্ন করতে না পারি, তাহলে আমাদের মতো অভাগা জাতি আর কে হতে পারে?

করোনা ভাইরাস আমাদের দীর্ঘদিনের অপকর্মের অর্জিত ফসল। বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মানবজাতিকে বিলাস ব্যসনের তুঙ্গে উঠিয়ে দিয়েছে। আমাদের জীবনাচারের এই অব্যবস্থাপনা আমাদের এই পরিস্থিতির ফলাফল। সুতরাং অনুশোচনার অনলে, ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমরা বিধাতার কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাই সমস্ত মানব জাতির জন্য।


লেখক: আলহাজ সুফী মোহাম্মদ মিজানুর রহমান
চেয়ারম্যান, পিএইচপি ফ্যামিলি

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২২, ২০২০
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।