ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

দূরপ্রাচ্যে যুদ্ধের ঘনঘটা: জাপানের যুদ্ধকৌশলগত তৎপরতা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১০২ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৫, ২০২০
দূরপ্রাচ্যে যুদ্ধের ঘনঘটা: জাপানের যুদ্ধকৌশলগত তৎপরতা

পটভূমি
দূরপ্রাচ্যে যুদ্ধের ঘনঘটা শুরু হয়েছে। এই যুদ্ধ ঠাণ্ডা যুদ্ধ। কিন্তু যে কোনো সময়ই তা উত্তপ্ত যুদ্ধে রূপান্তরিত হতে পারে। এই যুদ্ধের একপক্ষ হলো-করোনা ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল হিসাবে খ্যাত গণচীন আর বিপক্ষে হলো যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানসহ দক্ষিণ চীন সমুদ্রবর্তী দক্ষিণপূর্ব এশিয়াভুক্ত দেশসমূহ। যেমন- ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও ব্রুনেই। 

এই ঠাণ্ডা যুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছে গণচীনের চীন সাগরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে। গত কয়েক দশক ধরে গণচীনের অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক ও প্রাযৌক্তিক উন্নয়ন চীনকে সামরিক শক্তিকে বলীয়ান হতে সাহায্য করেছে, যা দেশটিকে পরাশক্তির মর্যাদায় উন্নীত করেছে।

ফলশ্রুতিতে গত দুই দশক ধরে দেশটি চীন সাগরে তার আধিপত্যের বলয় বিস্তৃতিতে মনযোগ দিয়েছে। কিন্তু গণচীনের শক্তিমত্তার কাছে তার প্রতিপক্ষ দেশগুলো সামরিক শক্তিতে বেশ দুর্বল। সে জন্য তাদের গণচীনের সামরিক তৎপরতার মুখে জবাব দেওয়ার মতো কৌশলগত ও সামিরক শক্তি নেই। তবে গণচীনের প্রতিপক্ষ দেশগুলোর মধ্যে সামরিক শক্তিতে সমর্থ জাপান এই তৎপতার মুখে বসে নেই। জাপান যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিলে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে নানা কৌশলগত তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে চীন সাগরকে ঘিরে চীন ও জাপানের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব বেশ দৃশ্যমান হয়েছে। এই দ্বন্দ্বে জাপানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রও যোগ দিয়েছে।  

এই করোনা মহামারির মধ্যেও গণচীন স্বল্পশক্তির পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্র সন্দেহ প্রকাশ করেছে (ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল, এপ্রিল ১৫, ২০২০)। এর মধ্যে আজ আবার দক্ষিণ চীন সাগরে যুক্তরাষ্ট্র ও অষ্ট্রেলিয়ার যৌথ নৌ মহড়া অনুষ্ঠিত হলো (সূত্র: এবিসি নিউজ, এপ্রিল ২২, ২০২০)। এর মধ্যেই জাপানও নানা সামরিক ও কৌশলগত কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।

চীন সাগরে গণচীনের সম্প্রসারণবাদী নীতি 
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দৃশ্যমান এই দ্বন্দ্বের রহস্য উদ্ঘাটন করতে হলে-বিষয়টি তলিয়ে দেখতে হবে। এই দ্বন্দ্বের মূলে রয়েছে মূলত চীন সাগরে গণচীনের অস্বভাবী সামরিক ও কৌশলগত তৎপরতা। চীন সাগর দুই অংশে বিভক্ত- পূর্ব চীন সাগর ও দক্ষিণ চীন সাগর। গণচীন চীন সাগরের প্রায় পুরোটাই তার নিজের জলসীমা বলে দাবি করে। গণচীন তার এই দাবির পক্ষে একটি মানচি্ত্র এঁকেছে যাতে দেখা যায়, দূরপ্রাচ্যের অনেক দেশ গণচীনের কাছে তার দ্বীপময় ভূখণ্ড হারাবে আর অর্থনৈতিক জলসীমার ওপর সার্বভৌমত্ব হারাবে। এই দ্বীপময় ভূখণ্ডের মধ্যে রয়েছে পূর্ব চীন সাগরে অবস্থিত জাপানের সেনগোকু দ্বীপ আর দক্ষিণ চীন সাগরে অবস্থিত ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, ব্রুনেই, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার জলসীমায় অবস্থিত স্পার্টলি দ্বীপপুঞ্জের নানা দ্বীপ।  

১৯৭০-এর দশকেই গণচীন পূর্ব চীন সাগর ও দক্ষিণ চীন সাগরে তাদের অধিকার দাবি করে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে গণচীন প্রতিষ্ঠা হলে দেশটি চীন সাগরে তাদের অধিকারের কথা প্রকাশ করে। তবে তখন এ দাবীর পক্ষে দেশটি তেমন কোন জোড়ালো তৎপরতা দেখায়নি। কিন্তু ২০১১ সালে গণচীন হঠাৎ করে চীন সাগরে তাদের কর্তৃত্বের ব্যাপারে ব্যাপক তৎপর হয়ে ওঠে এবং প্রতিপক্ষ দেশগুলোকে চীন সাগরে অধিকারের দাবিদার দেশগুলোর বিরুদ্ধে কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে। চীনা কমিনিষ্ট পার্টি নিয়ন্ত্রিত পত্রিকায়- চীন সাগরে চীনের কথা মতো কাজ না করলে কামানের গুলিতে জবাব দেওয়া হবে বলে প্রতিপক্ষ দেশগুলোকে শাসিয়ে দেয়। এরপর ২০১৩ সাল থেকে চীন ভিয়েতনামের দাবিকৃত পারাসেল দ্বীপপুঞ্জ ও মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও ব্রুনেই-এর দাবিকৃত স্পার্টলি দ্বীপপুঞ্জে সামরিক ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার্য রানওয়ে নির্মাণ শুরু করে এবং সেখানে এখনও নানা ধরণের স্থাপনা নির্মাণ চলছে। এই স্থাপনা নির্মাণের সাথে সাথে জলে ও অন্তরীক্ষে গণচীনের সামরিক যানের আনগোনা বাড়তে থাকে। এই তৎপরতাকে সামরিক বিশেষজ্ঞগণ সামরিক মহড়া বলে বর্ণনা করেছেন।  

গণচীনের সম্প্রসারণবাদী তৎপরতার পরিপ্রেক্ষিতে দূরপ্রাচ্যের দেশসমূহের প্রতিক্রিয়া 
গণচীনের এই তৎপরতার জবাবে জাপান ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশসমূহ সরাসরি প্রতিবাদ করে আসছে। তাছাড়া এ দেশগুলো আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক জোটে নানা পর্যায়ে শলামর্শ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পুরো চীন সাগর দখলে গেলে, চীন সাগরে সার্বভৌমত্ব হারানো দেশগুলোই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা নয়, বরং দক্ষিণ চীন সাগরে স্বার্থ রয়েছে এমন সব দেশ নানা রকম বাধ্যবাধকতায় নিপতিত হবে। চীন সাগর অতিক্রমকারী যে কোন বিদেশি জাহাজকে গণচীনের জলসীমা ব্যবহার করছে বলে ধরা হবে। সেজন্য যুক্তরাষ্ট্র, অষ্ট্রেলিয়া ও ভারতসহ বিশ্বের নানা দেশ বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে এবং কৌশলগত তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।  

গণচীনকে মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রের নীতির পরিবর্তন ও দূরপ্রাচ্যের দৃশ্যপটে জাপানের নব আবির্ভাব
চীন সাগরকে ঘিরে গণচীনের সাম্প্রতিক এই আধিপত্যবাদী তৎপরতার প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক ও কৌশলগত নীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতির পরিবর্তনের উদ্দেশ্য হল-চীন সাগরে গণচীনের সম্প্রসারণবাদী উদ্যোগকে সামরিক ও কৌশলগতভাবে মোকাবেলা করা। কিন্তু গণচীনকে সামরিক ও কৌশলগতভাবে মোকাবেলা করতে কৌশলগত মিত্র প্রয়োজন। সেজন্য যুক্তরাষ্ট্র এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশসমূহের সাথে শলা-পরামর্শ করে যাচ্ছে। তার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র তার এক সময়ের শত্রু জাপানকে নির্ভরযোগ্য মিত্র হিসাবে বেছে নিয়েছে। কারণ জাপান গণচীনের সম্প্রসারণবাদী উদ্যোগকে মোকাবেলা করতে এমনিতেই তেতিয়ে রয়েছে। কেননা চীন সাগরে গণচীনের সম্প্রসারণবাদী নীতি কার্যকর হলে দূরপ্রাচ্যের দেশ হিসাবে জাপান ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। জাপানের কৌশলগত সক্ষমতা ও যুদ্ধ সক্ষমতা উভয়ই রয়েছে। কিন্তু জাপানের এই সক্ষমতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তোর কাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বন্দী হয়ে রয়েছে।  

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পরাজয় বরণ করে ও দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের অধীনস্থ হয়ে পড়ে। সে সময় জাপান যুক্তরাষ্ট্রের চাপে তার সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধনীতি পরিত্যাগ করে এবং সাংবিধকভাবে র্নিযুদ্ধ নীতি গ্রহণ করে।  দেশটি তার সামরিক বাহিনীকে পুনর্গঠন করে ক্ষুদ্রাকারে সীমিত স্বদেশ রক্ষা বাহিনীতে রূপান্তর করতে বাধ্য হয়। জাপানের সশস্ত্র বাহিনীর এই পুনর্গঠনের আওতায় জাপানের সমরাস্ত্র উৎপাদন ও বিক্রয় বন্ধ হয়। তখন জাপানের প্রতিরক্ষার ভার নেয় যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিকে সামরিকভাবে সুরক্ষা দিতে যুক্তরাষ্ট্র জাপানের নানা স্থানে সেনানিবাস স্থাপনের অনুমতি লাভ করে। সেই সময় থেকে জাপান যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর খরচ যোগাতে  প্রতি বছর প্রায় দুই হাজার কোটি ডলার করে গুনছে। অর্থ্যাৎ যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থ দিয়ে জাপান তার সুরক্ষা কিনছে।  

জাপানের সামরিক ও কৌশলগত সক্ষমতা অর্জন
গণচীনকে মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও কৌশলগত পরিবর্তনের অংশ হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র সাম্প্রতিককালে জাপানের উপর থেকে সশস্ত্র বাহিনীর সম্প্রসারণ, অস্ত্র উৎপাদন ও অস্ত্র বিক্রয়ের বিধি-নিষেধ শিথিল করে। কাজেই জাপানের অনুকূলে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত নীতিতে এই পরিবর্তন একটি বিস্ময়কর আন্তর্জাতিক ঘটনা। কারণ এর ফলে জাপান সামরিক শক্তিতে বলীয়ান হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ লাভ করে। কয়েক বছর আগেই জাপানের অনুকূলে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত নীতি পরিদৃষ্ট হতে থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে জাপানের কিছু পরাশক্তি সদৃশ সামরিক ও কৌশলগত তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। জাপানের এই তৎপরতা অব্যাহত থাকলে জাপান নিঃসন্দেহে পুনরায় এশিয়ার পরাশক্তি হিসাবে অবির্ভূত হবে। জাপানের এই তৎপরতার শুরুটা নিয়ে আলোকপাত করা যাক।  

গণচীনের সম্প্রসারণবাদী তৎপরতা মোকাবেলা করতে শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান সম্মিলিতভাবে কৌশলগত কার্যক্রম গ্রহণ করে। কিন্তু ১৯৪৭ সালে প্রণীত সংবিধান অনুসারে জাপানের যুদ্ধ করার অধিকার নেই। কাজেই সংবিধানের বাধ্যবাধকতার জন্যই জাপান গণচীনকে মোকাবেলায় যুদ্ধে লিপ্ত হতে পারবে না। তাছাড়া জাপান যেন যুদ্ধে লিপ্ত না হতে পারে, সেজন্য যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে প্রত্যক্ষ নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু গণচীনকে মোকাবেলার স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র জাপানের ওপর থেক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমস্ত বাধা প্রত্যাহার করে। বাধা প্রত্যাহারের এ বিষয়টি প্রথমবারের মতো নজরে আসে গত ১৯৯৪ সালের জুলাই মাসে। তখন জাপান যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সমর্থনে সংবিধানের নবম সংবিধি সংশোধন করে, এবং শিনজো আবের নেতৃত্বাধীন সরকার বিষয়টিকে জাপানের যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার সাংবিধানিক অধিকার সৃষ্টি হয়েছে বলে ব্যাখ্যা প্রদান করে। এই সংশোধনীর মাধ্যমে জাপান যে কোন দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অধিকার ফিরে পায়। অধিকার ফিরে পাওয়ার বিষয়টি নিছক সংবিধানের সংশোধনী থেকে উৎসরিত হয়েছে তেমন নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী মিত্র তৈরিতেই জাপানকে এ সুযোগ প্রদান করে। এই সাংবিধানিক সংশোধনীকে গণচীন, উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া সরাসরি বিরোধিতা করে এবং তারা এর মাধ্যমে সাম্রজ্যবাদী জাপানের আসল চেহারা বেরিয়ে আসবে বলে বর্ণনা করে।  

জাপানের যুদ্ধ সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ
গত এক দশকে জাপানের ইতিহাস হলো-সামরিক শক্তিতে বলীয়ান হওয়ার ইতিহাস আর চীনকে রুখে দাঁড়ানোর ইতিহাস। গত বছর থেকে জাপান পূর্ণ উদ্যমে তার সামরিক শক্তি গঠনে মনযোগ দেয়। দেশের অভ্যন্তরে, আঞ্চলিক পর্যায়ে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জাপানের কৌশলগত তৎপরতা চোখে পড়ার মতো। জাপান এখন সামরিক বাহিনী গঠন, অস্ত্র উৎপাদন ও বিক্রয় এবং বিভিন্ন দেশের সাথে সামরিক সহযোগিতা ইত্যাদি বিষয়ে মনযোগ দিয়েছে। দেশটি জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে যুদ্ধ সক্ষমতা বাড়াতে উচ্চপ্রাযৌক্তিক পরিকল্পনা হাতে নিয়ে এগুচ্ছে। জাপান এই উদ্যোগের অংশ হিসাবে সম্প্রতি (৫ জানুয়ারি, ২০২০) জাপান বিমান বাহিনীর পূর্বতন নাম কোওকুউ জিয়েতাই অর্থ্যাৎ জাপান বিমান স্বরক্ষা বাহিনী (Japan Air Self Defense Force)-এর নাম পরিবর্তন করে জাপান মহাকাশ প্রতিরক্ষা বাহিনী (Japan Aerospace Defense Force) নামকরণ করেছে। এর মাধ্যমে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতার মাধ্যমে মহাকাশ যুদ্ধে সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সামরিক সহযোগিতার অংশ হিসাবে নতুন প্রজন্মের যুদ্ধ বিমান ( F-35 stealth fighter jet) নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তাছাড়া জাপান তার পূর্বতন পারমাণিক অস্ত্র বিষয়ক নীতি থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দিয়েছে। জাপান এখন পর্যন্ত পারমাণমিক অস্ত্র নিরোধ চুক্তিতে সই করেনি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো যে- এই জাপানই পারমাণমিক অস্ত্রে আক্রান্ত হওয়া দেশ হিসাবে এতোদিন যাবত পারমাণবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে এসেছে।  

জাপান তার দেশাভ্যান্তরীণ বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে অস্ত্র উৎপাদন ও বিক্রয়ের লাইসেন্স দিয়েছে। তারা এখন ব্যাপক হারে সামরিক অস্ত্র উৎপাদনে মনযোগ দিয়েছে। দেশে তৈরি এসব সমরাস্ত্র প্রাযৌক্তিকভাবে অত্যন্ত উন্নত মানের। এসব অস্ত্র দিয়ে তার সামরিক বাহিনীকে সমৃদ্ধ করছে। ২০০৫ সাল থেকে নৌবাহিনীকে আক্রমণে সক্ষম ডুবোজাহাজে সজ্জিতকরণে মনযোগ দিয়েছে। এ পর্যন্ত ১১টি ডুবোজাহাজ নৌবাহিনীতে যুক্ত হয়েছে। সর্বশেষ ৭ এপ্রিল ২০২০ তারিখে মিৎসুবিসি ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান নির্মিত সোওরিয়োও নামের একটি নতুন ডুবোজাহাজ নৌবাহিনীতে ষুক্ত হয়েছে (সূত্র: দ্যা ডিপ্লোম্যাট)।  

জাপান তার বিমান বাহিনীর সক্ষমতা বাড়াতে আক্রমণাত্মক যুদ্ধবিমান যুক্ত করছে। তার বেশিরভাগ দেশে নির্মিতি। দেশটি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৩৫টি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান সংগ্রহের চুক্তি সই করেছে। ইতোমধ্যে জাপান আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা মিশনে যোগ দিয়েছে। জিবুতিতে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করেছে। সাম্প্রতিককালে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, জাপান গণচীনের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা গড়তে উদ্যোগী দেশগুলোতে চুক্তির মাধ্যমে অথবা সাহায্য হিসাবে সমরাস্ত্র সরবরাহ করছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই সমরাস্ত্র ক্রেতার দেশের তালিকায় প্রথমে রয়েছে ফিলিপাইন। গত মার্চ মাসে  মিৎসুবিসি ফিলিপাইনকে নয় কোটি ডলার মূল্যমানের রাডার প্রতিরক্ষা সরবরাহের কাজ হাতে নিয়েছে। সাম্প্রতিককালে জাপানের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ন্যাশানাল ইলেকট্রিক কোম্পানী (এনইসি) ভিয়েতনামে কৃত্রিম উপগ্রহসহ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপনের ঠিকাদারী কাজ হাতে নিয়েছে (সূত্র; নিক্কেই এশিয়ান রিভিউ, এপ্রিল ২০, ২০২০)।  

জাপানের যুদ্ধকৌশলগত তৎপরতা
জাপানের এতোসব সামরিক আয়োজন জাপানের যুদ্ধ সক্ষমতা ও কৌশলগত সক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছে। এই সক্ষমতা লাভের ফলে জাপান গণচীন, রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার কৌশলগত তৎপরতার জবাব দিয়ে চলেছে। জাপান দূরপ্রাচ্যে তার সামরিক শক্তি ও কৌশলগত শক্তির সিংহভাগই ব্যয় করছে গণচীনকে মোকাবেলায়। তার প্রধান উদ্দেশ্য হলো- পূর্ব চীন সাগরে জাপানের দাবীকৃত সেনগোকু দ্বীপ রক্ষা ও তার সমুদ্রসীমার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা। তার চেয়েও বড়ো যে উদ্দেশ্যে তা হলো দক্ষিণ চীন সাগরে গণচীনের সম্প্রসারকে সামরিকভাবে মোকাবেলা করা। গণচীন আকাশে ও সমুদ্রে যুদ্ধ মহড়া চালানোর সময় বারবার জাপানের সীমানায় ঢুকে পড়ছে বলে জাপান প্রতিবাদ করে আসছে। জাপান তার জলসীমায় ও আকাশ সীমায় গণচীনের সামরিক তৎপরতা মোকাবেলা করে যাচ্ছে বলে জানাচ্ছে।  

গত অর্থনৈতিক বছরে (এপ্রিল ২০১৯-মার্চ ২০২০) জাপান ৬৭৫ বার তার আকাশে গণচীনের যুদ্ধবিমানের তৎপরতা মোকাবিলা করেছে বলে জানিয়েছে (সূত্র: দ্যা ডিপ্লোম্যাট, এপ্রিল ১০, ২০২০)। জাপানের সমুদ্রসীমায় গণচীনের যুদ্ধজাহাজের মহড়া অব্যাহতভাবে চলছে এবং প্রায়ই জাপানের দাবীকৃত জলসীমায় গণচীনের মৎস্য আহরণকারী জাহাজ ঢুকে মাছ ধরছে। জাপান এই সব তৎপরতার বিরুদ্ধে বর্তমানে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেছে। দূরপ্রাচ্যের এই দেশটি কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ হিসাবে গণচীন থেকে তার সমস্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কল-কারখানা স্থানান্তরের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যেন জাপানের উৎপাদন শৃঙ্খলের কোন অংশ গণচীনের ওপর নির্ভরশীল হয়। সেজন্য শিনজো আবে সরকার গণচীনে অবস্থিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কল-কারখানা স্থানান্তরে আর্থিক সহায়তা প্রদানের কথা ঘোষণা করেছে। জাপান সরকারের এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গণচীন থেকে পাততারি গোটানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এই উদ্যোগের অংশ হিসাবে ইতোমধ্যে আইরিস আওইয়ামা নামক একটি প্রতিষ্ঠান গণচীন থেকে স্থানান্তরের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। গণচীন থেকে জাপানি প্রতিষ্ঠানের স্থানান্তরের এই পরিকল্পনার বিষয়টি গণচীনের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসার ইঙ্গিতবহ।  

যুদ্ধযুদ্ধ খেলার ভবিষ্যৎ
একদিকে চীন সাগের গণচীনের অব্যাহত আধিপত্যবাদী সামরিক কৌশল ও অন্যদিকে দূরপ্রাচ্যের দেশসমূহের সমুদ্রসীমায় তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সামরিক প্রস্তুতি দৃরপ্রাচ্যকে দীর্ঘমেয়াদী দ্বন্দ্বে ঠেলে দিচ্ছে। একদিকে গণচীন চীন সাগরে তার অধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ অব্যাহত রেখেছে, আবার অন্যদিকে দূরপ্রাচ্যের দেশসমূহও চীন সাগরে তাদের অধিকার রক্ষায় লড়তে প্রস্তত হচ্ছে। কোন পক্ষই যখন তার অবস্থান থেকে সরে আসছে না, তখন বর্তমান দ্বন্দ্বটি যে যুদ্ধে গড়াবে না-তার কোন নিশ্চয়তা নেই। আর যুদ্ধ যদি বাধে তখন পাশেই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া। কাজেই যুদ্ধ বাধলে যে তা মহাযুদ্ধে গড়াবে না-তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। কাজেই দূরপ্রাচ্যের যুদ্ধের এই দামামা বিশ্ববাসীকে একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ যুদ্ধে কে জিতবে বা কে হারবে তা অনিশ্চিত। তবে এই যুদ্ধযুদ্ধ খেলার সুবাদে, জাপান তার হৃত সামরিক শক্তি কিছুটা হলেও পুনরুদ্ধার করেছে তা নিশ্চিত। কাজেই আগামীতে যে জাপান দৃশ্যপটে পরাশক্তি হিসাবে আবির্ভূত হলেও আশ্চর্যের কিছু থাকবে না।  
   
লেখক: অধ্যাপক, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ই-মেইল: razaul_faquire@du.ac.bd

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।