ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

আমরাই হতে পারি চীনের বিকল্প উৎপাদনকারী

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০০ ঘণ্টা, মে ১২, ২০২০
আমরাই হতে পারি চীনের বিকল্প উৎপাদনকারী

প্রায় দুই মাস করোনা ভাইরাসের প্রভাবে সারা পৃথিবীর সঙ্গে আমরাও গৃহবন্দি। আমাদের কৃষি ব্যবস্থা ছাড়া সব উৎপাদন বন্ধ। যদিও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিদের্শে কিছু কিছু ফ্যাক্টরি চালু করা হয়েছে। আজ প্রত্যেকটি মানুষের জীবনে ভিন্ন ভিন্ন উপলব্ধি দেখতে পাই। যাদের একটু স্বচ্ছলতা আছে তারা লকডাউন মানছেন, তারা ঘর হতে বের হচ্ছেন না। এর মাঝে কিছু কিছু মানুষ অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। আবার কোথাও কোথাও দেখেছি মানবতার চরম বিপর্যয়। আপনজনের লাশটা পর্যন্ত সৎকারের ব্যবস্থা করছে না। করোনো এই নিষ্ঠুরতায় দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কতটুকু বিধ্বস্ত তা সত্যিই আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। আজ করোনো আক্রান্ত সব শ্রেণীর মানুষ করোনার চেয়ে বিপর্যস্ত চিকিৎসা না পাওয়ার ভয়ে।

আমি শুধু এই মুহূর্তে উপলব্ধি করতে চাই, যেখানে ডাক্তার নার্সদের আমরা সঠিক সুরক্ষা সামগ্রীর ব্যবস্থা করতে পারি না। ভালো মানের পিপিই মাস্ক দিয়ে তাদের আস্থা অর্জন করতে পারি নাই।

সেই ডাক্তার নার্সরা কিভাবে করোনো রোগীদের আস্থা অর্জন করবেন। করোনা চিকিৎসার জন্য কুর্মিটোলা ও কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল নির্বাচন করে আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এই হাসপাতাল দুটির কোনোটিতেই সেন্ট্রাল অক্সিজেন ও ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা ছিল না। অথচ করোনা রোগের চিকিৎসায় সবচেয়ে জরুরি অক্সিজেন ও ভেন্টিলেশন। এখন আমি বলতে পারি, এতোদিন যারা বলেছিল, আমরা করোনা মোকাবিলায় প্রস্তুত, তাদের দায়িত্ব কর্তব্যে যথাযথ জ্ঞান নাই। অথবা তারা সমস্ত কিছু জেনেও জনগণকে বোকা বানাতে চেয়েছেন। তাইতো আমার প্রশ্ন স্বাস্থ্য মন্ত্রালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, আইইডিসআরের বড় বড় কর্মকর্তাদের প্রতি। তারা কি সঠিক পরিস্থতির উপলব্ধিপূর্বক প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে পেরেছেন?

এখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি স্বাস্থ্য মস্ত্রণালয়ের কাজে তদারকি না করতেন, তাহলে এ পর্যন্ত যতটুকু হয়েছে ততটুকুও হতো না। প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ না করলে টেস্টের সংখ্যা বাড়তো না। বৃদ্ধি পেতো না করোনা হাসপাতাল ও পিসিআর ল্যাবের সংখ্যা। এই কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক লুজইগ বলেছেন- যা বলা যায়, তা প্রাজ্জালন বলা যায়। যে বিষয়ে বলা সম্ভব নয়, সে বিষয়ে নীরব থাকাই বিধেয়। তাই এই দার্শনিকের উপদেশ মতে এই স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য নিষ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করতে চাই না।

২০১৯ সালে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ ছিল ২৯ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ৬ শতাংশের মতো। পাশাপাশি ভারতের স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ ছিল ৬২ হাজার ৩৯৩ কোটি রুপি, যা তাদের জিডিপির ২.৫ শতাংশ। আমার প্রশ্ন, ভারতের জিডিপির চেয়ে মাথাপিছু বরাদ্দ বেশি হলেও ৩০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের সুবিধা জনগণ পেয়েছে তো? কেননা এই করোনা বিপর্যয়ের পর স্বাস্থ্য খাতের বেহাল অবস্থা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

তাই অনেকের মতো আমি মনে করি, স্বাস্থ্য খাতের বিনিয়োগের গুণগত মানের যথাযথ পর্যালোচনা করা দরকার।

দ্বিতীয়ত, এখানে আমি কৃষির উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়ে কিছু আলোচনা করতে চাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বারবার বলেছেন, একখণ্ড কৃষি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে। বিশ্ব জুড়ে যেখানে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, সেখানে আমাদের বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। কিন্তু এর ভেতরে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না। এটা যে  শুধু করোনার বিপর্যয়ের জন্য তা কিন্তু নয়। আমরা সব সময়ই দেখতে পাই কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য তাদের প্রাপ্ত অর্থের চেয়ে পাঁচ থেকে দশগুণ বেশি দামে খুচরা বাজারে বিক্রি হয়। এতে যেমন কৃষকরা তাদের ন্যায্যমূল থেকে বঞ্চিত হয়, তেমনি  গ্রাহকরা অধিকমূল্যে ক্রয়ের কারণে বাজারে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পায়।

কৃষিকদের উৎপাদিত পণ্য যদি ব্যবসায়িক দৃষ্টি ভঙ্গি থেকে না দেখা হয়, তাদের সুরক্ষা না করা হয়, তাহলে দিন দিন ঋণে জর্জরিত হয়ে সমস্ত কৃষক ভূমিহীন হয়ে পড়বে।  

আমি মনে করি, আমাদের ১৭ কোটি লোকের খাদ্যের চাহিদা মেটাতে আধুনিক বিপণন ব্যবস্থার বিকল্প নাই। এতে কৃষকরা যেমন উৎসাহিত হবে তেমনি ভোক্তারাও ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনতে পারবে।  

সরকার যেভাবে সার বীজ সঠিকভাবে কৃষকদের হাতে পৌঁছে দিয়ে কৃষি উৎপাদন দ্বিগুণ করেছে। তেমনিভাবে কৃষি বিপণন ব্যবস্থায় আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করা দরকার। আমি এখানে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশের কৃষি বিপণন ব্যবস্থার কথা বলতে চাই।  

বঙ্গবন্ধুর আর্দশ ছিল উৎপাদন ও কৃষি বিপণন ব্যবস্থা সমবায়ভিত্তিক করা। এই পদ্ধতি সফল প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করতে পারলে কৃষকের একদিকে যেমন দরকাষাকষির ক্ষমতা বাড়বে, তেমনি তাদের পণ্যের গুণগতমান অক্ষুণ্ন রেখে বেশি দামে কৃষি পণ্য বিক্রয় করতে পারবে। ফলে তাদের আর্থিক উন্নতি কৃষি ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারকে ত্বরান্বিত করে প্রতি একর জমি থেকে পূর্বের তুলনায় অধিক ফলন ও আয় পেতে সক্ষম হবে, যা পরবর্তী সময়ে আরও অধিক উৎপাদনে উৎসহিত করতে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

তৃতীয়ত, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের অর্থনীতির অচল অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ৭৩ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। তা সঠিক বলেই আমার কাছে মনে হয়েছে।

যদি এই প্রণোদনা থেকে সঠিকভাবে ক্ষুদ্র মাঝারি ও বৃহৎ ব্যবসায়ীদের দুই থেকে তিন মাসের মূলধন বরাদ্দ দিয়ে সহায়তা করা যায়, তাহলে প্রত্যেকটি কলকারখানা আবারও উৎপাদনে ফিরে আসবে। এই প্রণোদনা সঠিকভাবে ব্যবহারের জন্য মাননীয় অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে সব ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধি নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি করা দরকার। এই কমিটি যাদের প্রণোদনা দেবে তার তালিকা স্ব স্ব ব্যাংকগুলো পাঠাবে। যাতে এর অপব্যবহার করতে না পারে। আমরা সবসময় দেখেছি গুটি কয়েক ব্যক্তি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এই সুবিধার অপব্যবহার করে আসছে। যারা স্বভাবজাত ঋণ খেলাপি, তারা যেন এই প্রণোদনা না পায়, সেদিকেও এই কমিটিকে খেয়াল রাখতে হবে।

আমি মনে করি, এই প্রণোদনার সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান দুই থেকে তিন মাসের মূলধন যোগান দিতে পারে, তাহলে আবার আমাদের উৎপাদন ব্যবস্থা ঘুরে দাঁড়াবে এবং সত্যিই আলোর মুখ দেখবো। আজ চীন ছাড়া বিশ্বের সব দেশ উৎপাদন ব্যবস্থার বাইরে। এই প্রণোদনা পেলে চীনের বিকল্প উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে নিজেদেরকে তৈরি করতে পারবো। তৈরি পোশাকে আমরা যেখানে বিশ্বের দ্বিতীয় উৎপাদনকারী দেশ, তেমনি অন্য ক্ষেত্রেও চায়নার বিকল্প ভারত, ভিয়েতনামের মতো আমরাও আত্মপ্রকাশ করবো।  

সর্বশেষ কবি শামসুর রাহমানের ‘বিপন্ন হয়ে যায়’ কবিতার কয়েকটি লাইন দিয়ে শেষ করতে চাই-

‘এই ভাঙচুর লক্ষ্য করে তুমি এর ব্যাখ্যা চেয়ে
আমাকে বৃথায় করো অপ্রস্তুত। কতোই ব্যাখ্যাতীত
বিষয় রয়েছে ভবে’, অমীমাংসা যার অসহায়
করে রাখে মানুষকে, মাঝেমধ্যে অস্তিত্বের ভিত
ভয়ানক কেঁপে ওঠে। কাল সন্ধ্যা নেমেছে
ডুবছে পীড়ন গাঙ্গে, আবারো ভাসায় কিনারায়


লেখক: সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, বিকেএমইএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।