ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক টেলিফোনে জানতে চাইলেন- ‘আমি লুপাসের রোগী। করোনার ভ্যাকসিন নিতে পারবো কি?’
রোগটির নাম সিস্টেমিক লুপাস ইরাইথেমেটাস, সাধারণভাবে এসএলই বা লুপাস বলা হয়।
প্রচুরসংখ্যক মানুষ শরীরের সুরক্ষা প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত রোগে ভুগছেন। তাদের প্রধান জিজ্ঞাস্য হলো- করোনার টিকা নিতে পারবো কি? সুরক্ষা প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত এইসব রোগকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘অটোইমিউন’ রোগ।
ইমিউন শব্দের অর্থ হলো ‘সুরক্ষা’ বা রোগ সংক্রমণের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা। প্রতিটি মানুষের শরীরে রোগের বিরুদ্ধে সুরক্ষাশক্তি থাকে। এটি আবার দুই ধরনের। একটি হচ্ছে জন্মগত সুরক্ষা এবং অন্যটি হলো অর্জিত সুরক্ষাশক্তি। অর্জিত সুরক্ষাকে দু-ভাগে ভাগ করা হয়। জীবনযাপনের মধ্যদিয়ে প্রতিবেশ ও পরিবেশের নানাধরনের বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করে মানুষকে বাঁচতে হয়। এই প্রক্রিয়ায় মানুষ বিভিন্ন ধরনের রোগজীবাণুর সংস্পর্শে আসে। এতে মানুষের শরীরে এক ধরনের সুরক্ষাশক্তির জন্ম হয়। একে বলা হয় প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক সুরক্ষা। মানুষের শরীরে ওষুধ প্রবেশ করিয়েও সুরক্ষা অর্জন করা যায়। ওষুধগুলো খাওয়া, ইনজেকশন বা অন্যকোনো পদ্ধতিতে শরীরে প্রবেশ করানো হয়। এইসব ওষুধকে ‘টিকা বা ভ্যাকসিন’ বলা হয়। করোনা ভ্যাকসিন মানুষের শরীরে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে সুরক্ষাশক্তি তৈরি করে।
ভ্যাকসিন গ্রহণে অনেকে সংশয়গ্রস্ত কেন?
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও বিপুলসংখ্যক মানুষ দীর্ঘমেয়াদী অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত। এদের মধ্যে অনেকে ‘অটোইমিউন’ রোগে ভুগছেন। ভ্যাকসিন নেওয়ার ব্যাপারে এই রোগীদের সংশয় সবচেয়ে বেশি। অটোইমিউন রোগগুলো শরীরের সুরক্ষাতন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত। সুরক্ষাতন্ত্রের মূল কাজ হলো বাইরে থেকে কোনো আক্রমণকারী শরীরে প্রবেশ করামাত্র তাকে শনাক্ত করে ধ্বংস করার অভিযান শুরু করা। এই ব্যবস্থা শরীরের অভ্যন্তরস্থিত এবং বহিরাগত সবকিছুকে চিহ্নিত করতে সক্ষম। মাঝেমধ্যে কোনো এক অজানা কারণে সুরক্ষাতন্ত্র শরীরের ভেতরের কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বা কোনো ব্যবস্থাকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে। তারপর যথারীতি সেগুলোর ওপর আক্রমণ শুরু করে দেয়। শরীরের নিজস্ব কিছু অংশের ওপর সুরক্ষাতন্ত্রের এই আক্রমণ একনাগাড়ে চলতে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় অনেকগুলো রোগ উৎপন্ন হয়। শরীরের নিজস্ব সুরক্ষাতন্ত্রের ভুল পদক্ষেপের কারণে সৃষ্ট রোগকে বলা হয় ‘অটোইমিউন’ রোগ। এই রোগীরা নিজ শরীরের সুরক্ষাতন্ত্রের এই ত্রুটি সম্পর্কে কমবেশি জ্ঞাত। তাই করোনা টিকা তাদের জন্য নিরাপদ কিনা সে বিষয়ে তারা চিন্তিত।
প্রধান প্রধান অটোইমিউন রোগ কোনগুলো?
চিহ্নিত অটোইমিউন রোগের সংখ্যা শতাধিক। প্রধান প্রধান অটোইমিউন রোগ হলো- ডায়াবেটিস টাইপ-১, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, সোরিয়াসিস, এসএলই বা লুপাস, মাল্টিপল স্কেলেরোসিস, ইরিটেবল বায়োল ডিজিজ (আইবিডি), থাইরয়েডের একাধিক রোগ, অ্যাডিসনস ডিজিজ, মায়াস্থেনিয়া গ্রাভিস, পারনিসিয়াস অ্যানেমিয়া, সিলিয়াক ডিজিজ ইত্যাদি।
অটোইমিউন হলেও, প্রতিটি রোগের ধরন আলাদা। যেমন রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস হলো শরীরের বিভিন্ন অস্থিসন্ধির অসুখ কিন্তু সোরিয়াসিস হচ্ছে একধরনের চর্মরোগ। আইবিডি এবং সিলিয়াক ডিজিজ এই দুটো রোগেই হজমের সমস্যা হয়। কিন্তু মায়াস্থেনিয়াতে হঠাৎ হঠাৎ শরীরের মাংসপেশি বিবশ হয়ে যায়। অ্যডিসনস ডিজিজে রক্তের পটাশিয়াম ও সোডিয়ামের পরিমাণ কমে যেতে থাকে। ডায়াবেটিস রোগের বিষয়ে আমরা সবাই কমবেশি জানি। অটোইমিউন রোগগুলো শরীরের বিভিন্ন স্থানে বা তন্ত্রে প্রকাশিত হলেও সবগুলোর মূল কিন্তু একই জায়গায়। আর সেটা হলো শরীরের সুরক্ষাতন্ত্র। অনেকটা রসুনের মতো।
অটোইমিউন রোগীরা চিন্তিত কেন?
আগেই বলেছি, অটোইমিউন রোগে আক্রান্তদের সুরক্ষাতন্ত্রে কিছুটা গোলমাল থাকে। এদের নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়। এইসব ওষুধ শরীরের সুরক্ষা শক্তিকে কমিয়ে দেয়। ফলে এই রোগীরা করোনায় আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত বেশি হয়। এরকম বাস্তবতায় করোনা ভ্যাকসিন গ্রহণের পর এই রোগীদের শরীরে সুরক্ষা। শক্তি তৈরি হবে কি? অটোইমিউন রোগে আক্রান্তদের শরীরে করোনা ভ্যাকসিন পূর্ণ সুরক্ষা শক্তি তৈরি করে। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীরা আমাদের এমনটাই জানিয়েছেন। এই রোগীরা অন্যসব মানুষের মতো ভ্যাকসিন গ্রহণ করতে পারবে। এতে তাদের শরীরে অতিরিক্ত কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি হবে না। অন্য সবার যেটুকু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে এদের ক্ষেত্রেও তেমনি হবে।
অতিরিক্ত সাবধানতার প্রয়োজন আছে কি?
সাধারণভাবে অটোইমিউন রোগীদের অতিরিক্ত কোনো সাবধানতার দরকার নেই। তবে ভ্যাকসিন নেওয়ার আগে কারও অসুস্থতা হঠাৎ তীব্রতর হয়ে গেলে সেই সময়ে তারা ভ্যাকসিন নেবেন না। এছাড়া রোগে দীর্ঘদিন ভুগে ভুগে যাদের অবস্থা প্রান্তিক পর্যায়ে চলে গিয়েছে তাদের জন্য করোনা ভ্যাকসিন নেওয়া উচিত হবে না। একটি রোগ বিভিন্ন মানুষের শরীরে ভিন্ন ভিন্ন উপসর্গ ও প্রভাব সৃষ্টি করে। ব্যক্তিভেদে রোগের তীব্রতা ভিন্ন হয়। ওষুধের প্রতি সংবেদনশীলতা পুরোপুরি ব্যক্তিসংশ্লিষ্ট। তাই অটোইমিউন রোগীদের উচিত হবে তাদের নিজস্ব কোনো সমস্যা বা জিজ্ঞাসা থাকলে ব্যক্তিগত চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা। সর্বশেষ কথা হলো- এখন পর্যন্ত যতগুলো করোনা ভ্যাকসিন তৈরি হয়েছে তার সবগুলোই অটোইমিউন রোগীর জন্য নিরাপদ।
লেখক: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
বাংলাদেশ সময়: ১২০৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০২১